শেখ রাসেল দিবস

কী অপরাধ ছিল শেখ রাসেলের?

ড. মতিউর রহমান
ড. মতিউর রহমান ড. মতিউর রহমান , গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।
প্রকাশিত: ১০:০২ এএম, ১৮ অক্টোবর ২০২৩

ইতিহাসে গোষ্ঠীপ্রধান, সাম্রাজ্যপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান এর নিহত হওয়ার ঘটনা বিরল নয়। কিন্তু আধুনিক সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কোনো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান সপরিবারে নিহত হয়েছেন বলে জানা নেই। এও জানা নেই যে, কোনো জাতির মুক্তি সংগ্রামের মহান নেতা ও স্বাধীনতার মহান স্থপতির শিশুসন্তানকে বিনা অপরাধে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তার পরিবারের সব সদস্যসহ। অথচ এরকমই অপার বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটেছে এ বাংলার মাটিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বড় নিষ্ঠুরভাবে নির্দয় হায়েনার দল গুলির আঘাতে ছিন্নভিন্ন করে দেয় ছোট রাসেলের বুকটা।

যে কোনো ব্যক্তির জন্মদিন পালন সাধারণত উৎসবমুখর হয়। শিশুদের জন্মদিন উদযাপন আরও বেশি আনন্দময় হয়। সাধারণত জন্মদিনে কোনো ব্যক্তির সুস্থ, সুদীর্ঘ এবং সফল কর্মময় জীবন কামনা করা হয়। সেই সাথে তার পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সাফল্যও কামনা করা হয়।

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর থেকে বাঙালি জাতির জনক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার প্রিয় সহধর্মিণী, তাদের সন্তানরা, ছেলেদের স্ত্রীরা, আত্মীয়স্বজন যারা সেই ভয়াল রাতে ঘাতকের বুলেটের নির্মম আঘাতে শহীদ হয়েছিলেন তাদের জন্মদিন পালন উৎসব এক শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি করে। বুকজুড়ে হাহাকার তৈরি করে। আনন্দের বদলে অসীম শূন্যতা ও বেদনার সৃষ্টি করে। বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের জন্মদিনেও এমনই শোক ও বেদনা কাজ করে।

শেখ রাসেলের জন্ম ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর। বেঁচে থাকলে এ বছর ১৮ অক্টোবর তার বয়স ৫৯ বছর পূর্ণ হতো, ৬০তম বছরে পদার্পণ করতেন। মহা আনন্দের সাথে তার ৬০তম জন্মবার্ষিকী পালিত হতো। কিন্তু ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ঘাতকরা তার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেয়। মাত্র ১০ বছর ৯ মাস ২৮ দিনের জীবন ছিল তার।

শেখ রাসেল জন্ম নিয়েই তার বাবাকে দেখতে পাননি। বাবার আদর ও বুকের উষ্ণতাও পাননি। পাবেন কীভাবে? তার বাবা যে তখন এ হতভাগা দেশের গরিব, দুঃখী মানুষের তিনবেলা পেট ভরে ভাত খেতে পারার অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ব্যস্ত। তার প্রিয় গরিব, দুঃখী, মেহনতি মানুষের মুখে একটু হাসি ফোটানোর জন্য পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দিনরাত দেশের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে চলেছেন ক্লান্তিহীন ভাবে।

কনিষ্ঠ পুত্রের জন্ম মুহূর্তে প্রিয়তমা স্ত্রীর পাশে থাকার চেয়ে এদেশের গরিব, দুঃখী ও নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানো তার কাছে যে বেশি জরুরি। তিনি যে তাদের বড্ড ভালোবাসেন। সেজন্যই তো সেদিন ছিলেন চট্টগ্রামে, জনসভায়। শেখ রাসেল যে বছর জন্মগ্রহণ করেন সে বছর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে একের পর এক নাটকীয় ঘটনা ঘটতে থাকে।

স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম বেদনা শুরু হয়ে যায়। তার পিতা ততদিনে এদেশের সাধারণ মানুষের কাছে স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠেছেন। একমাত্র তিনিই পারবেন এদেশের গরিব, দুঃখী ও অসহায় মানুষকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে। তাদের বহু কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা এনে দিতে। সে কারণেই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর এবছরই তিনি প্রিয় দল আওয়ামী লীগের হাল ধরেন এবং দলকে প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর পরিশ্রম শুরু করেন।

১৯৬৪ সালের নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর ঘটে একের পর এক ঘটনা, যা বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ড সৃষ্টির ইতিহাসে যুগান্তকারী হিসেবে চিহ্নিত। ৬ দফা আন্দোলন, পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১১ দফা ও ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, অসহযোগ আন্দোলন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট, বঙ্গবন্ধু কতৃর্ক স্বাধীনতার ঘোষণা, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের কারাগারে প্রেরণ এবং দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন— এতসব ঐতিহাসিক ঘটনায় শেখ রাসেল তার বাবার কাছ থেকে ছিলেন বিচ্ছিন্ন এবং তার স্নেহ, মায়া, মমতা ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত। ২৫ মার্চের পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রায় ৯ মাসই শেখ রাসেলকে তার পরিবারের সাথে বন্দি অবস্থায় কাটাতে হয়েছে। শুধু বন্দি অবস্থায় নয়, ভয়, আতঙ্ক নিয়ে পরিবারের সাথে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে।

এই দীর্ঘ সময়ে বঙ্গবন্ধুকে একাধিকবার কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। কারাগারে যখন বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য তার পরিবারের সদস্যরা অনুমতি পেতেন, শেখ রাসেলও তাদের সাথে যেতেন। বঙ্গবন্ধুকে দেখে সে তার প্রিয় ‘হাসু আপু’কে বলতেন, “তোমার ‘আব্বা’কে আমি একটু ‘আব্বা’ বলে ডাকি?” এ কথা শুনে কোমলে, কঠোরে মেশানো বঙ্গবন্ধুর চোখের কোণেও পানি জমে উঠতো।

সে আরও জানতে চাইত তোমার আব্বা এখানে কেন? আমাদের বাড়িতে যায় না কেন? বঙ্গবন্ধুর প্রিয়তমা সহধর্মিণী, তার সব আন্দোলন, সংগ্রামের প্রেরণাদাত্রী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব শিশু রাসেলকে সব খুলে বলতেন। কেন তার বাবা কারাগারে থাকেন। কারণ, কারাগারই তার বাবার আরেকটা বাড়ি। এখানে তাকে প্রায়ই আসতে হয়। কারণ, তার বাবা এদেশের গরিব, দুঃখী ও অসহায় মানুষদের ভাত, কাপড়, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করছেন। অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। এদেশটাকে স্বাধীন করে তাদের মুখে হাসি ফোটাতে চান। এই দেশটাকে ‘সোনার বাংলা’ হিসেবে গড়ে তুলতে চান।

কিন্তু এখন যারা দেশ চালায় তারা তোমার আব্বার এ কাজগুলো পছন্দ করে না। এজন্য তারা তোমার বাবাকে মাঝে মধ্যেই বন্দি করে রাখে। যাতে সে গরিব, দুঃখী মানুষের কথা বলতে না পারে। তাদের অধিকার আদায়ে আন্দোলন সংগ্রাম করতে না পারে। মায়ের কাছ থেকে শুনে শুনে শিশু রাসেল— এর মনেও এদেশের গরিব, দুঃখী মানুষের প্রতি, দেশের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়। মাঝে মাঝে যখনই পরিবারের সাথে গ্রামে যান— গ্রামের শিশুদের জন্য জামা-কাপড় নিয়ে যান। বঙ্গমাতা তাকে আরও শেখান তোমার আব্বা যখন বাড়িতে থাকবে না তখন তুমি আমাকেই ‘আব্বা’ বলে ডেকো।

জন্মের দেড় বছরের মাথায়ই শেখ রাসেল জেনে যান কেন সে তার বাবাকে কাছে পান না। তারপরও অবুঝ শিশুমন বুঝতে চাইত না। বাবাকে কাছে না পেয়ে মাঝে মাঝে সে মুখ ভার করে বসে থাকত। ঠিকমতো খাবার খেতে চাইত না। খেলনাগুলো পড়ে থাকত। প্রিয় কুকুর টমি ঘেউ ঘেউ করলে মনে করত সে তাঁকে বকা দিয়েছে।

দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীন হওয়ার পর সেও বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে ‘জয় বাংলা’ বলে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। তার বড় দুই ভাই তখনও যুদ্ধ থেকে ফেরেনি। বাবা পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। অবশেষে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এলে শেখ রাসেল তাকে কাছে পায়। তার আপন জগৎ বিকশিত হতে থাকে। শৈশব পায় দুরন্তগতি। বাইসাইকেল চালিয়ে, মাছ ধরে তা আবার পুকুরে ছেড়ে দিয়ে, স্কুলে বন্ধুদের সাথে খেলা করে, স্কুল ও বাড়ির লেখাপড়া করে অতিবাহিত হতে থাকে তার নির্মল ও দুরন্ত শৈশব।

মায়ের মমতায়, বাবার অপত্য স্নেহ ও ভালোবাসায়, বড় দুই বোন ও ভাইদের আদর, ভালোবাসায় এবং স্কুলের শিক্ষক, বন্ধুবান্ধব ও বাড়ির প্রিয় লোকজনের স্নেহ এবং আদর যত্নে বেড়ে উঠতে থাকেন শেখ রাসেল। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস, যে দেশের মানুষের জন্য তার বাবা দিনের পর দিন জেলে কাটালেন, অত্যাচার, নিযার্তন সহ্য করলেন, যে গরিব, দুঃখীর মুখে হাসি ফুটিয়ে তার প্রিয় বাংলাদেশকে ‘সোনার বাংলা’ হিসেবে গড়ে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন— সেই মহামানবকে হত্যা করলো মানুষরূপী দানবরা। তার সাথে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশু শেখ রাসেলসহ বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সবাইকে, তার আত্মীয়দের, সরকারি দায়িত্ব পালনরত কর্মকর্তাদের।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে, যেখানে শেখ রাসেলের জন্ম ও বেড়ে ওঠা সেখানে বয়ে গেলো রক্তগঙ্গা। শেখ রাসেল ও তার নিষ্পাপ দুরন্ত শৈশবকে যে নরঘাতকরা হত্যা করলো তারা সেদিন শুধু শেখ রাসেলই নয়, সারা বিশ্বের নিষ্পাপ শিশুদের ও তাদের শৈশবকে হত্যা করে। অস্বীকার ও অপমান করে বিশ্বের কোটি কোটি শিশুর জীবনকে, শৈশবকে, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে ও অধিকারকে। বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের জন্য এ এক মহালজ্জা ও কলংকের বিষয়। সমাজ ও রাজনীতি সচেতন কোনো বিবেকবান মানুষের পক্ষে এ লজ্জা বহন করা কী সহজ?

শিশু শেখ রাসেলের জন্মদিনে কেন আমাদের আনন্দের পরিবর্তে শোকের বেদনা বইতে হয়? কেন তার প্রিয় ‘হাসু আপু’কে (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে দেশ ও বিশ্ববাসীর কাছে প্রশ্ন রাখতে হয় ‘কী অপরাধ ছিল আমার প্রিয় রাসেলের?’

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।

এইচআর/ফারুক/এএসএম

শিশু শেখ রাসেলের জন্মদিনে কেন আমাদের আনন্দের পরিবর্তে শোকের বেদনা বইতে হয়? কেন তার প্রিয় ‘হাসু আপু’কে (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে দেশ ও বিশ্ববাসীর কাছে প্রশ্ন রাখতে হয় ‘কী অপরাধ ছিল আমার প্রিয় রাসেলের?

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।