ভিসা নীতি আন্দোলন নির্বাচন
বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতিবিদসহ বেশ কিছু শ্রেণি পেশার মানুষের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার ঘোষণা এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। বিরোধী দল বিএনপি এটিকে দেখছে তাদের রাজনৈতিক বিজয় হিসেবে। উল্লসিত বিএনপি নেতা ও তাদের লাইনের বুদ্ধিজীবীরা এর মধ্যেই সরকার পতনের দিনক্ষণ গণনা করতে শুরু করেছেন।
গত বুধবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, কয়েকদিনের মধ্যেই সব স্পষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু কি স্পষ্ট হবে সেটা স্পষ্ট হয়নি তার কথায়। বোঝা যাচ্ছে মার্কিন ভিসা নীতি প্রয়োগকে কাজে লাগাতে চায় বিএনপি। কিন্তু আওয়ামী লীগ কেমন ভাবে দেখছে পুরো পরিস্থিতিকে সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বুধবার দিনই আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বিধিনিষেধে ভয় না পেয়ে দলের নেতা-কর্মীদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। গুরুত্ব না দিয়ে ভয় না পাওয়ার কথা কেন বললেন, সেটা তিনিই বলতে পারবেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসা নিষেধাজ্ঞা যে সরকারি দলের ভিতর অস্বস্তি তৈরি করেছে সেটা বোঝা যাচ্ছে দলীয় নেতাদের প্রতিদিনের প্রতিক্রিয়ায়।
আওয়ামী লীগের সামনে এজেন্ডা তিনটি- যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি থেকে দলীয় কর্মীদের দৃষ্টি ফেরানো, বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলা করা ও আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া। সেটি নিশ্চয়ই দল করছে।
কিন্তু দলের সভাপতি এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করা অবস্থায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভিসা নীতি প্রয়োগের ঘোষণা নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। আমাদের ওয়াশিংটন মিশন, নিউইয়র্ক মিশন বা পররাষ্ট মন্ত্রণালয় কূটনৈতিক সূত্রে কোনো খবর জানল না যে এরকম একটি বিব্রতকর ঘোষণা আসছে?
সেই মে মাসে ভিসা নীতি ঘোষণার পর থেকেই প্রধানমন্ত্রী নিজে এবং অনেক মন্ত্রী, দলের সিনিয়র নেতা শক্ত ভাষায় আমেরিকার সমালোচনা করে আসছেন। এই নীতি কার্যকর করার ঘোষণা আসার পর এই সমালোচনা আরও বাড়ছে। কেউ কেউ হালকা চালে একে গুরুত্বহীন হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
সর্বশেষ জনাব ফারুক খান সেদিকেই ইঙ্গিত করেছেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার সমর্থকেরা কি এর তাৎপর্য খারিজ করে দিয়ে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিল? অনেকেই বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র অন্য যেকোনো সময়ের চাইতে এখন অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে বিবেচনা করছে, বিশেষ করে আগামী নির্বাচনকে দেখছে।
এই ভিসা নীতি প্রয়োগ করা হবে কি করে? কোন সব প্রমাণের ভিত্তিতে সেটা করা হবে? পর্যাপ্ত তথ্য প্রমান ছাড়া করা হলে এর অপপ্রয়োগ হতে বাধ্য। নির্বাচনী রাজনৈতিক সহিংসতা এবং ভয়ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা তদন্ত ও মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত যদি বিরোধী দলের প্রচারণাকেই মেনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তবে সেটি হবে দুঃখজনক।
মার্কিন সরকার কাকে ভিসা দিবে, কারটা বাতিল করেছে সেটা গোপন রাখে। কিন্তু বাংলাদেশের বিরোধী দল এবং তার সমর্থকরা এর মধ্যেই বহু নাম তালিকা আকারে প্রকাশ করছে। সেখানে সাংবাদিকদের নামও আসছে। এই আগুনে আরও ঘি ঢেলেছেন ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। তিনি একটি টেলিভিশনে গিয়ে বলেছেন ভিসা নীতি গণমাধ্যমের জন্যও প্রয়োজ্য হবে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের মূল ঘোষণায় গণমাধ্যম প্রসঙ্গই নেই। এমনকি পিটার হাসের ঘোষণার পর যে ব্রিফিং হয়েছে ওয়াশিংটনে সেখানেও এ প্রশ্ন উঠলে গণমাধ্যম প্রসঙ্গে কিছু বলেননি মুখপাত্র।
এতে বোঝা যায় ঢাকা দূতাবাসকে নানা প্রকার তথ্য আর উস্কানির মধ্যে রেখেছে স্থানীয় একটি মহল। সম্পাদক ও গণমাধ্যমকর্মীরা প্রতিবাদ ও উদ্বেগ জানিয়েছে এই বক্তব্যের। তারা মনেই করছে যে, এর মাধ্যমে সাংবাদিকদের ভয় পাইয়ে দেওয়ার একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে। অথচ গণতন্ত্র ও সুশাসনের আসল ভিত্তি মত প্রকাশ ও সাংবাদিকতার স্বাধীনতা। ভিসা নীতি কতটা সফল হবে, তার সত্যিকারের পরীক্ষার ক্ষেত্র হলো, এটা আরও রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং আরও ভালো নির্বাচনী পরিবেশ তৈরিতে অবদান রাখছে কি না। সেই চ্যালেঞ্জটা থেকেই যাচ্ছে বরাবর।
তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, কম্বোডিয়া, নাইজেরিয়া, কিউবাকেও যুক্তরাষ্ট্র ভিসা বিধিনিষেধ দিয়েছিল, তাদের কিছুই হয়নি। তাই এটা নিয়ে মাতামাতির কিছু নেই। কিন্তু বাংলাদেশের নাম কেন নাইজেরিয়া, কম্বোডিয়ার পাশে উচ্চারিত হবে সেটিও ভাবা দরকার। আমরা একটি ভাল নির্বাচন চাই এবং সেখানে সবার অংশগ্রহণ চাই। সে লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলো যদি সংঘাতের পথ ছেড়ে আলোচনায় বসে সেটাই অধিক কার্যকর হবে।
ভিসা নীতি কার্যকর করার পর এখন একটা অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে যে, আওয়ামী লীগ ভাবছে আর হারাবার কিছু নেই। সেখান থেকে অনেক দল অনেকটাই মারমুখী এখন। ফলে শুধু ভিসা নীতি দিয়ে বিএনপি সাফল্য পাবে এমনটা ভাবা যাচ্ছে না। নভেম্বরে তফসিল ঘোষণা হয়ে গেলে দেশের পরিস্থিতি হবে নির্বাচনমুখী। তখন ভিসা নীতি বা আন্দোলন কোনোটাই দলের কাছে বড় বিষয় হবে বলে মনে হচ্ছে না। তাহলে আগামী কয়েকদিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে আমাদের সবাইকে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।
এইচআর/এএসএম