ভয়ঙ্কর দুর্ভোগের রাত
কারওয়ান বাজারে আমার অফিস থেকে তাকালেই নজরুল ইসলাম এভিনিউর ভিআইপি রোডের অনেকটা দেখা যায়। একসময় দৃষ্টিসীমা বাংলামোটর পেরিয়ে যেতো। মেট্রোরেলের স্টেশনের কারণে এখন খুব বেশি দেখা যায় না। তবে যানজটের লাইভ চিত্র দেখা যায়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কাজ শেষ হলেও রাস্তার দিকে তাকিয়ে বের হওয়ার সাহস পাচ্ছিলাম না। রাস্তা একদম অনড়।
দেখতে দেখতে রাত ৮টার দিকে সাহস করে বেরিয়ে পড়লাম। ভাগ্যিস বেরিয়ে পড়েছিলাম। রাস্তায় নামার কিছুক্ষণের মধ্যেই নামলো ঝুম বৃষ্টি। শরতের বৃষ্টি বেশ উপভোগই করছিলাম। একা একা গাড়ি চালাতে আর গান শুনতে শুনতে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বাসায় পৌঁছে গেলাম। তখনও আমি বা আমরা কেউই টের পাইনি, নগরবাসীর জন্য কি ভয়ঙ্কর দুর্ভোগের এক রাত অপেক্ষা করছে।
বৃষ্টি ঝরছে তো ঝরছেই, থামার কোনো লক্ষণ নেই। আস্তে আস্তে ঢাকা ডুবতে থাকে, আর ফেসবুকে ভাসতে থাকে আটকেপড়া মানুষের হাহাকার। যারা সেদিন মধ্যরাতে রাস্তায় আটকে পড়েননি, তাদের আসলে বলে বা লিখে সেদিনের দুর্ভোগের আসল চিত্রটা বোঝানো যাবে না। কোন কোন এলাকা ডুবেছে, সেটা আলাদা করে লেখা মুশকিল। আসলে পুরো ঢাকাই কমবেশি ডুবে গিয়েছিল। মধ্যরাতে স্থবির ঢাকায় আটকে পড়েছিলেন হাজারো মানুষ।
গাড়ি চলে না, রিকশা চলে না, হেঁটে ফেরারও উপায় নেই। ইঞ্জিনে পানি ঢুকে রাস্তায় রাস্তায় অচল হয়ে আছে অনেক যানবাহন। ফলে দ্রুতই পুরো ঢাকা কলাপস করে। বাসায় ফিরতে কারও ৫ ঘণ্টা, কারও ৬ ঘণ্টাও লেগেছে। সন্ধ্যায়ই বৃষ্টিতে ভেসে গিয়েছিল বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড প্রথম ম্যাচ। কিন্তু যারা খেলা দেখতে মিরপুর গিয়েছিলেন তাদের বাসায় ফিরতে পোহাতে হয়েছে অন্তহীন দুর্ভোগ।
এটিএন নিউজের স্পোর্টস রিপোর্টার জিনিয়া চেসিম আটকা পড়েছিলেন মিরপুরে, তার সাথে ছিলেন ক্যামেরাপারসন তারিফ। তাদের আনতে অফিস থেকে গাড়ি রওয়ানা হলেও পৌঁছতে পারছিল না। ফোনে কথা বলে তাকে অভয় দেওয়ার চেষ্টা করি, নিরাপদে থাকতে বলি। কিন্তু বাসায় বসে তার অসহায়ত্ব অনুভব করা পুরোপুরি সম্ভব ছিল না। শেষ পর্যন্ত রাত সাড়ে ১১টায় তিনি গাড়িতে উঠতে পেরেছিলেন। তাতে কিছুটা স্বস্তি মেলে।
এমন কত দুর্ভোগের কাহিনি সব হয়তো আমরা জানতেও পারিনি। কোনো মিডিয়ার পক্ষেই দুর্ভোগের পুরো চিত্র তুলে আনা সম্ভব হয়নি। কারণ জলাবদ্ধতার কারণে গণমাধ্যমকর্মীরাও সব জায়গায় পৌঁছতে পারেননি। দুর্ভোগের তবু শেষ আছে, রাতের তবু ভোর হয়। কিন্তু মিরপুরে আটকেপড়া পানিতে বিদ্যুতায়িত হয়ে একই পরিবারের তিনজনসহ চারজনের মৃত্যুর কোনো জবাব নেই। এই দুটি পরিবার এই শোক ভুলবে কীভাবে?
বাংলাদেশের বিশেষ করে ঢাকার কিছু সমস্যা আমি ভেবেছিলাম কখনোই সমাধান হবে না। একসময় মনে হতো লোডশেডিং থেকে আমাদের কখনো মুক্তি মিলবে না। বর্তমান সরকারের আন্তরিকতায় লোডশেডিং এখন অতীত কাল। আমাদের প্রতিদিনের আরেকটি সমস্যা হলো যানজট। মেট্রোরেল, এলিভেটেডে এক্সপ্রেসওয়ের সবগুলো রুট পুরোপুরি চালু হলে এবং সাধারণ মানুষ নিয়ম মেনে চললে; যানজটও হয়তো একসময় সহনীয় হয়ে আসবে। কিন্তু আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, ঢাকার জলাবদ্ধতার কোনো সমাধান হবে না।
কত দুর্ভোগের কাহিনি সব হয়তো আমরা জানতেও পারিনি। কোনো মিডিয়ার পক্ষেই দুর্ভোগের পুরো চিত্র তুলে আনা সম্ভব হয়নি। কারণ জলাবদ্ধতার কারণে গণমাধ্যমকর্মীরাও সব জায়গায় পৌঁছতে পারেননি। দুর্ভোগের তবু শেষ আছে, রাতের তবু ভোর হয়। কিন্তু মিরপুরে আটকেপড়া পানিতে বিদ্যুতায়িত হয়ে একই পরিবারের তিনজনসহ চারজনের মৃত্যুর কোনো জবাব নেই। এই দুটি পরিবার এই শোক ভুলবে কীভাবে?
এখানে সরকারকে খুব একটা দোষ দেওয়া যাবে না। সরকার চেষ্টা করেনি বা কম করেছে, এমনটা বলা যাবে না। গত এক যুগে জলাবদ্ধতা নিরসনে তিন হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। বলা ভালো টাকাটা জলে গেছে। আসলে সাধারণ চেষ্টায় জলাবদ্ধতা দূর হবে না। স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতা নিরসনে নিরসনে সাধারণ চেষ্টায় হবে না। আউট অব দ্যা বক্স চিন্তা করতে হবে। কঠোর হতে হবে। কোনো রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে অদূর ভবিষ্যতে সেটা করা সম্ভব বলে মনে হয় না।
এবার বর্ষাটা সরকার ভালোভাবেই সামাল দিতে পেরেছিল। কিন্তু শরতে এসে একবেলার অতি ভারী বর্ষণ সরকারের সব চেষ্টাকে ডুবিয়ে দিয়েছে। গত কয়েকবছর ধরেই বর্ষাকালে ঢাকার সবচেয়ে ভোগান্তির নাম জলাবদ্ধতা। বৃষ্টি এখন আর ঢাকার মানুষের ভেজার রোমান্টিকতা নয়, ডুবে যাওয়ার আতঙ্কের নাম। এক ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই ঢাকা অচল, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডুবে থাকে ঢাকার রাস্তা। কয়েক বছর ধরে চললেও ২০১৭ সালে জলাবদ্ধতার সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছিল।
যতটুকু বৃষ্টি হয়, ঠিক ততটুকুই যেন আটকে থাকে। বৃষ্টি একটু বেশি হলেই ঢাকা জল থই থই। অনেকেই মজা করে ঢাকাকে নদীর সাথে তুলনা করেছেন। বড় নদী ঢাকার আবার অনেকগুলো শাখা নদী আছে- ধানমন্ডি ২৭ নাম্বার নদী, রোকেয়া সরণি নদী, শান্তিনগর নদী, কারওয়ান বাজার নদী, গ্রিন রোড নদী, নিউমার্কেট হাওর ইত্যাদি ইত্যাদি।
সেবার টানা বর্ষণে জলাবদ্ধতার এক পর্যায়ে তখনকার স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, ‘আগামী বছর জলাবদ্ধতা থাকবে না’। স্থানীয় সরকার মন্ত্রী হিসেবে মানুষকে জলাবদ্ধতামুক্ত রাখা তার দায়িত্ব। সেই দায়িত্বের অংশ হিসেবেই হয়তো তিনি আশাবাদী মানুষ হিসেবে জনগণকে আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি তার মতো অত আশাবাদী হতে পারিনি। কারণ আমি জানি, মন্ত্রী যতই আন্তরিক হন, ঢাকাকে জলাবদ্ধতামুক্ত রাখা সম্ভব নয়।
একমাত্র প্রকৃতিই পারে, ঢাকাকে বাঁচাতে। যদি টানা বৃষ্টি না হয়, থেমে থেমে অল্প বৃষ্টি হয়; তাহলেই কেবল মন্ত্রীর আশ্বাস পূরণ হওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু প্রকৃতি তো আর মন্ত্রীর আশাবাদের সঙ্গে তাল রেখে চলবে না। তাই ২০১৭ সালের পর আরো ছয় বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু মন্ত্রীর আশ্বাস বাস্তবায়িত হয়নি। এর মধ্যে মন্ত্রী বদল হয়েছে। কিন্তু জলাবদ্ধতা দূর হয়নি। প্রমাণিত হয়েছে মন্ত্রিত্ব ক্ষণস্থায়ী, জলাবদ্ধতা চিরস্থায়ী।
বর্ষা-বৃষ্টি-পানি হলো অপার আনন্দের উৎস। লিখে শেষ করা যাবে না। সত্যি সত্যি বৃষ্টি আমার খুবই প্রিয়। ঝুম বৃষ্টি হলে আমার কাছে সব অচেনা লাগে। ঝুম বৃষ্টিতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে আমার দারুণ লাগে। বৃহস্পতিবার রাতেও শুরুতে বৃষ্টি ভালোই লাগছিল। কিন্তু এখন বৃষ্টি নিয়ে আর রোমান্টিকতা সাজে না। বৃষ্টি নিয়ে তাই কোনো স্ট্যাটাস দেওয়ারও সাহস পাই না। বৃষ্টি মানেই ভোগান্তি। অতি বৃষ্টি মানে অতি ভোগান্তি।
সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর আশ্বাসই শেষ নয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসও জলাবদ্ধতা দূর করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু সে আশ্বাসও বাস্তবায়িত হয়নি। আসলে হওয়া সম্ভব নয়। আগে যেমনটি বলেছি, সাধারণ চেষ্টায় ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করা সম্ভব নয়। তবে জলাবদ্ধতা দূর করা একেবারে অসম্ভবও নয়।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং আইনের কঠোর প্রয়োগই কেবল ঢাকাকে জলাবদ্ধতামুক্ত রাখতে পারে। কিন্তু বছরের কয়েকদিনের জলাবদ্ধতার ভোগান্তি দূর করতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে, যত কঠোর ও অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে; তা কোনো জনপ্রিয়তাকামী রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে নেওয়া কঠিন। ঢাকায় একসময় জালের মতো বিছানো খাল ছিল।
যদি ঢাকার সবগুলো খাল উদ্ধার করে একদম আগের মতো করা যেতো, আমি নিশ্চিত জলাবদ্ধতা থাকতো না। কিন্তু ঢাকার খালগুলো বেশিরভাগই দখল হয়ে গেছে। বিভিন্ন সময়ে সরকারের অদূরদর্শিতায় বক্স কালভার্ট হয়ে গেছে। একসময় কারওয়ান বাজার পর্যন্ত নৌকা চলতো, এ কথা এখন রূপকথা মনে হয়। বেশি পুরোনো রূপকথা নয় কিন্তু। খাল সব মেরে, ভরাট করে, দখল করে, বক্স কালভার্ট করে; পানি সরার সব জায়গা বন্ধ করে দিয়ে এখন জলাবদ্ধতা নিয়ে কান্নাকাটি করে তো লাভ নেই।
গাছের গোড়া কেটে আগায় যতই পানি ঢালুন, কাজ হবে না। একসময় শ্যামলী রিং রোডে দাঁড়ালে পশ্চিমে পুরো সাগর মনে হতো। এখনও সাগর, মানুষের আর কংক্রিটের। তো রাজধানীর সব জলাধার, নিম্নাঞ্চল ভরাট করে উঁচু উঁচু বিল্ডিং বানাবেন। আবার আশা করবেন, বৃষ্টির পানি আপনার ভয়ে সুরসুর করে চলে যাবে; অতটা আশা আলাউদ্দিনের প্রদীপের দৈত্যও করে না।
চারপাশের নদীগুলোতে দখল আর দূষণে প্রায় মেরে ফেলে, জালের মতো বিছিয়ে থাকা খালগুলো ভরাট করে, বক্স কালভার্ট বানিয়ে, নিম্নাঞ্চল ভরাট করে প্লট-ফ্ল্যাট বানিয়ে ঢাকাকে অনেক আগেই আমরা বালতি বানিয়ে ফেলেছি। তাই যতটুকু বৃষ্টি হয়, ততটুকু পানিই আটকে থাকে। নিচে যাওয়ারও উপায় নেই। পদে পদে কংক্রিটের বাধা। এখন জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তির একটাই তাৎক্ষণিক উপায়, হাতে-কলমে মানে পাম্প করে পানি বাইরে ফেলা অথবা হেলিকপ্টার দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া। কোনোটাই সম্ভব নয়। তাই বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতার ভোগান্তি অনিবার্য।
সরকারের একার চেষ্টায় জলাবদ্ধতা নিরসন সম্ভব নয়। নাগরিক হিসেবে আমাদেরও কিছু দায়িত্ব আছে। বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার অধিকাংশ এলাকা ডুবে যাওয়ার পর ভেসে উঠেছে প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেট, ডাবের খোসা, এমনকি ব্যবহৃত কনডমও। এগুলো তো সরকার ফেলেনি, আমরা ফেলেছি।
সরকার পানি নিষ্কাশনের জন্য মাটিরে নিচে বড় বড় পাইপ বসাতে পারবে। কিন্তু সেই পাইপ পর্যন্ত পানি পৌঁছানোর রাস্তাটা ক্লিয়ার রাখা আমাদের সবার দায়িত্ব। পানি সরার জায়গা আটকে রেখে সরকারকে গালি দিলে লাভ কি। এভাবে চললে বৃহস্পতিবার রাতের মতো একসময় ভয়ঙ্কর রাত প্রতিবছরই আসবে। আরও ঘন ঘন আসবে।
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম