ঢাকার রাস্তায় আমাদের পানিতে ডুবে মরতে হবে?
গত বৃস্পতিবারের দুরবস্থা অনেকদিন মনে থাকবে ঢাকাবাসীর। এদিন নগরবাসী আবার জলাবদ্ধতার নারকীয় অভিজ্ঞতা লাভ করলো। সেই রাতে বেশির ভাগ এলাকার সড়ক ডুবে গিয়েছিল, চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে মানুষকে। ১ ঘণ্টার রাস্তা পাড়ি দিতে লেগে যায় কয়েক ঘণ্টা। অফিস ছুটির পর রওয়ানা হয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছে মধ্য রাতে। পথের দুঃখ আর দুর্ভোগে, ক্ষোভ ঝরেছে মানুষের মনে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই সে রাতের দুঃসহ স্মৃতি তুলে ধরেছেন। কিন্তু পথচারীর মৃত্যু, দুঃসহনীয় দুঃখের বিভীষিকাময় সেই রাতের ঘটনা কর্তৃপক্ষ কোনো আমলে নিয়েছে বলে মনে হয় না। নিতে হয়নি কাউকে কোনো দায়ও।
সন্ধ্যার পর থেকে টানা কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার রাস্তা তলিয়ে যায়। কোথাও কোথাও বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। এতে সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়ে ঘরমুখী লোকজন। এ কথা জানাই, বর্ষায় কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় রাজধানী ঢাকা। প্রতি বছর বর্ষায় রাজধানী ঢাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এজন্য সমালোচনার মুখে পড়তে হয় ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি করপোরেশনকে। কিন্তু সমালোচনা যে তাদের গা সয়ে গেছে। গত বৃহস্পতিবার ভারী বৃষ্টিতে রাজধানীর অলিগলি পানিতে থইথই করছিল। নীলক্ষেত, কাঁটাবন, হাতিরপুল, ধানমন্ডির সাতমসজিদ সড়কে এলাকার কোথাও কোথাও কোমর পানি জমে যায়। প্রবল বৃষ্টিতে জমা পানিতে রাজধানীর মিরপুরে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে একই পরিবারের তিনজনসহ চারজনের মৃত্যু হয়েছে। রাত পেরিয়ে সকাল হলেও অনেক এলাকা থেকে পানি নামেনি।
নিউমার্কেট এলাকার পানি পরদিন সারাদিনই জমে ছিল। কেউ ওপথে যেতে পারেনি। পরদিন শুক্রবার তাদের বাণিজ্যের জন্য সাপ্তাহিক বড় দিন ছিল। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া অলিগলিতে কোমর সমান পানি জমে ছিল সারারাত। ফলে দোকানঘরে পানি ঢুকে মালামাল ভিজে সর্বনাশ হয়েছে ছোট ব্যবসায়ীদের। সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে বৃহস্পতিবার রাতে, রাস্তায় জমে থাকা পানিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে প্রাণ গেছে একই পরিবারের তিনজনসহ চারজনের। অসহায়ভাবে মারা গেছেন মিজান (৩০), তার স্ত্রী মুক্তা বেগম (২৫), মেয়ে লিমা (৭) এবং রিকশাচালক অনিক। মর্মান্তিক এ ঘটনায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে। অনেকেই লিখেছেন, এ অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না সিটি করপোরেশন, আবার কেউ সরাসরি দায় করেছেন বিদ্যুৎ বিভাগকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই মৃত্যুর দায় কার? এই প্রশ্ন এখন সমাজের বিবেকবান সব মানুষের।
মিরপুরের ঝিলপাড় বস্তিকে কেন্দ্র করে বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগের রমরমা ব্যবসা চলে আসছে বহুদিন ধরে। বৃহস্পতিবারের মর্মান্তিক এ ঘটনাটিও ওই অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের কারণে ঘটেছে। স্থানীয়রা বলছেন, ঘটনাটি ঘটে ঝিলপাড় বস্তির বিপরীত পাশের রাস্তায়। এ বিপরীত পাশের রাস্তার বিদ্যুতের খুঁটি থেকে অনেক অবৈধ সংযোগ বস্তিতে গেছে।
বৃহস্পতিবার রাতের টানা বৃষ্টি ও বাতাসের কারণে একটি অবৈধ সংযোগের লাইন রাস্তায় পড়ে যায়। রাস্তায় যখন জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় তখন আর ওই তারটি দেখা যায়নি। সেই লাইনেই বিদ্যুতায়িত হয়ে মৃত্যু হয় চারজনের। তাহলে অবৈধ এ বিদ্যুৎ সংযোগের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কি প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেবে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকা শহরের বর্তমান অবকাঠামোতে প্রতিদিন মাত্র ৪০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টি নিষ্কাশন করা যায়। সেই কারণেই আমরা দেখলাম যে, বৃষ্টি হলে সড়কের পানি ১৫ বা ২০ মিনিটের মধ্যেই সরে যায়। অথচ সেই পানি ২০ ঘণ্টায়ও সড়ক থেকে সরেনি। একটা দেশের রাজধানীতে এ কেমন পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা?
ঢাকায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ১১৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টির পর জলাবদ্ধতার ঘটনা রাজধানীতে এটাই প্রথম নয়। এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। বাস্তবতা হলো, শেষ পর্যন্ত জলাবদ্ধতার দায় ওয়াসা বা সিটি করপোরেশন কোনো সংস্থাই নেয় না। সব দায় যেন প্রাকৃতিক দুর্যোগের আর সব ভোগান্তি যেন নগরবাসীর নিয়তির।
১ ঘণ্টার রাস্তা পাড়ি দিতে লেগে যায় কয়েক ঘণ্টা। অফিস ছুটির পর রওয়ানা হয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছে মধ্য রাতে। পথের দুঃখ আর দুর্ভোগে, ক্ষোভ ঝরেছে মানুষের মনে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই সে রাতের দুঃসহ স্মৃতি তুলে ধরেছেন। কিন্তু পথচারীর মৃত্যু, দুঃসহনীয় দুঃখের বিভীষাকাময় সেই রাতের ঘটনা কর্তৃপক্ষ কোনো আমলে নিয়েছে বলে মনে হয় না। নিতে হয়নি কাউকে কোনো দায়ও।
প্রতি বছর সিটি করপোরেশন, ওয়াসাসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান উন্নয়নের নামে রাস্তাঘাট খোঁড়াখুঁড়ি করে। কর্তারা বলেন, আগামী বছর থেকে জলাবদ্ধতা আর হবে না। প্রতিশ্রুতিই সার। জলাবদ্ধতা রাজধানীবাসীর নিয়তি। নগরবাসীকে দুর্ভোগ পোহাতেই হয়। দেখার কেউ নেই। প্রতিকারের স্থায়ী উদ্যোগ নেই। অবস্থা এমন হয়েছে যে, বেশি বৃষ্টি হলে হয়তো ঢাকার রাস্তার পানিতে ডুবেই মরতে হবে।
ঢাকা মহানগরীর জলাবদ্ধতার জন্য প্রধানত দায়ী করা হয় অপর্যাপ্ত নিষ্কাশনব্যবস্থা। সংস্কারের অভাবে ড্রেনগুলো দিয়ে পানি নামতে পারে না। খালগুলো ভরাট ও দখল হয়ে গেছে। আগের মতো জলাভূমি নেই। কিছু এলাকায় খাল ভরাট করে বক্স কালভার্ট বানানো হয়েছে। এখন সেগুলো ময়লায় ঠাসা। বক্স কালভার্ট দিয়েও পানি নামতে পারছে না। এমন আরও অনেক কারণে জলাবদ্ধতা যেন নিয়তি হয়ে উঠেছে।
এটি সবারই জানা যে রাজধানীর ৪৬টির মধ্যে মাত্র ২৬টি খাল কোনো রকমে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর অবস্থাও খুব ভালো নয়। দখল, দূষণ ও ভরাট হয়ে সেগুলোও এখন মৃতপ্রায়। ফলে প্রতি বছর বর্ষায় নগরীর জলাবদ্ধতা প্রায় স্থায়ী রূপ নেয়। সামান্য বৃষ্টিতেও রাজধানী প্রায় অচল হয়ে পড়ে।
নগরীর জলাবদ্ধতা দীর্ঘদিনের অবহেলা ও অপরিকল্পনার ফসল, এতে কোনো সন্দেহ নেই। একদিনে এ সমস্যার সমাধান হবে না। এজন্য আশু ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। উন্নয়নকাজগুলোর সমন্বয় করতে হবে এবং জবাবদিহি বাড়াতে হবে। জনসচেতনতাও বাড়াতে হবে। ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেটসহ পলিথিনের বর্জ্যে ম্যানহোল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাধাগ্রস্ত হয় পানি নিষ্কাশন।
সড়ক নষ্ট করে অনির্দিষ্টকাল ধরে কোনো উন্নয়নকাজ চলতে পারে না। কোনো সভ্য দেশে এমনটি হয় না। খালগুলো দ্রুত দখলমুক্ত ও নাব্য করে তুলতে হবে। ড্রেনগুলো নিয়মিত সংস্কার ও পরিষ্কার করতে হবে। ঢাকার চারপাশের নদীগুলো খননের মাধ্যমে নাব্য রাখতে হবে। আশা করি, সরকার দ্রুত প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ নেবে।
লেখক: সাংবাদিক।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম