পেনশনে সবার অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা সুকঠিন
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বলবৎ করার একটি অন্যতম বড় উপায় হলো বয়স্কদের জন্য পেনশন ব্যবস্থা চালু করা। সাধারণত সমাজ স্বীকৃত উপায়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়ে থাকে। এটা মূলত মানুষের বৃদ্ধ বয়সে দুর্বল সময়ে মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে যেন কোনোভাবে প্রতিবন্ধকতা না আসে সেজন্য গৃহীত এক ধরনের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা।
এজন্য একেক দেশে একেক পদ্ধতিতে বিভিন্ন স্কিম হাতে নেয়া হয়। এটা পেতে হলে একজন মানুষকে নির্ধারিত বয়সে আবেদন করতে হয় এবং নিয়মিত চাঁদা বা প্রিমিয়াম প্রদান করতে হয়। বৃদ্ধ বা ম্যাচুরিটি হবার নির্দিষ্ট বয়সে আবেদনকারী মাসিক ভিত্তিতে অর্থগ্রহণ করেন। তিনি মারা গেলে তার নমিনি বা উত্তরাধিকারীগণ সেই অর্থ নিয়মানুযায়ী পেয়ে থাকেন।
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে বৃদ্ধকালীণ নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে সকল মানুষের কল্যাণের নিমিত্তে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। গত আগস্ট ১৭, ২০২৩ তারিখে এর উদ্বোধন করা হয়েছে। এর একমাস পর (সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৩) পর্যন্ত মোট ১২,৯৭০ জন বিভিন্ন স্টিম একাউন্ট খুলেছেন। তন্মধ্যে প্রগতিতে (বেসরকারি চাকুরীজীবী) একাউন্ট খুলেছেন ৬,১৭৬ জন।
এ সম্পর্কে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ বলতে গেলে এখনও কিছুই জানেন, বোঝেন না। যারা এই সর্বজনীন পেনশন সম্পর্কে কিছুটা জেনেছেন তাদের নিকট এটা এখনও কৌতূহলের বিষয় এবং সমাজের বিজ্ঞজনদের নিকট এটা একটি বড় পর্যবেক্ষণের বিষয়।
তবু সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা উদ্বোধনের পরদিন থেকে এর পক্ষে—বিপক্ষে নানা মতামত শুনে কান ঝালাপালা হবার যোগাড়। যার বেশিরভাগ কথা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। যেমন উদ্বোধনের দিনই কর্তৃপক্ষের বক্তৃতা সংবাদ হয়ে এসেছে, ‘আমরা ক্ষমতায় এলে ভাল হবে। অন্যথায় এই প্রকল্প আলোর মুখ দেখবে না।’
এছাড়া একজন মন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে নাগরিক সমাজ কেন এখনও অভিনন্দন জানায়নি সেজন্য অভিযোগ করেছেন। এই প্রকল্পের শুরুতেই কর্তৃপক্ষের মুখে এমন উক্তি এর ভবিষ্যৎ কর্মসূচি সম্পর্কে দেশের অপরাপর মানুষের আস্থা হারানোর কাজ করেছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক কল্যাণের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এখনও খুব কম মানুষই এই পেনশন নিয়ে কথা বলেছেন। তবে এসব বিষয়ে বিজ্ঞজনেরা এ পর্যন্ত যেসব মূল্যবান মন্তব্য করেছেন তা খুবই প্রণিধানযোগ্য।
প্রথমেই বলা যায়, যে কোনো দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা একটি কঠিন কাজ। কারণ, এটা একটা মহাযজ্ঞ এবং সদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনার ফসল হওয়া উচিত। তাড়াহুড়ো করে দায়সারা গোছের কোনোকিছু করতে গেলে এখানে মহাজটিলতা তৈরি হয়ে যাবে। অনেক দেশে যেটা ইতোমধ্যে জটিলতা তৈরি করে ফেলেছে। মালয়েশিয়ায় এর অর্থ নিয়ে কেলেঙ্কারির কথা শোনা গেছে। ভারতে এই পেনশন ম্যাচিয়্যুরড হবার পর টাকা উঠাতে গিয়ে আধার কার্ডের তথ্য ভুলের জন্য অনেক বিপত্তি দেখা গেছে।
ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এক পর্যবেক্ষণ ছিল, ‘সরকারি ভর্তুকির বড় অংশ দরিদ্র জনগণের নিকট পৌঁছাত না। যাদের প্রয়োজন নেই তারাই ভর্তুকি সুবিধা লুফে নিচ্ছিল। ফলে বিপুল সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছিল। এই অবস্থা পর্যবেক্ষণের ফলে ভারতে ২০০৯ সালে আধার কার্ড চালু করা হয়। কিন্তু অসতর্কতায় সেইসব আধার কার্ডধারী প্রবীণরা এখন সর্বজনীন পেনশন তুলতে গিয়ে বয়স সমস্যায় পড়েছেন। যার বয়স ৮০ কিন্তু তার ৩৭ ও ছেলের ৪০ দেখাচ্ছে । তিনি বলছেন, আরে আমার ছেলের বয়স আমার চেয়ে বেশি হয় কীভাবে?’
আমাদের দেশে গ্রামীণ সিংহভাগ মানুষের জন্মসনদ সঠিক নয়। এখনও স্কুলের শিক্ষকের দেয়া এসএসসির জন্মসনদটিই অনেকের জন্মতারিখ। এখনও অনেকের এনআইডি থেকেও নেই। যারা দালালের মাধ্যমে বয়স্ক ভাতা তোলা বা ভিজিএফ কার্ডের ব্যবহার সম্পন্ন করে থাকে। তাদের স্মার্ট ফোন নেই এবং নিজেরা অনলাইনে পেনশনের আবেদন ফরম পূরণ করতে অপারগ।
এখানেও দালালের মাধ্যমে পেনশনের মাসিক কিস্তি বা চাঁদা অনলাইনে জমা দিতে হবে। এই পেনশনে নগদ টাকা জমা দেবার নিয়ম নেই। যদিও স্থায়ী উপার্জনহীন কোনো আবেদনকারী নিয়মিত চাঁদা পরিশোধ করে তার নিজস্ব পেনশন স্কিম চালু রাখতে পারবেন কি—না সন্দেহ থেকে যায়।
আর আমাদের দেশে সর্বসাধারণকে অবগত না করেই সর্বজনীন পেনশন চালু করা হয়েছে— যা সবচেয়ে বড় দূরত্ব। কারণ এই পেনশন ব্যবস্থা সর্বসাধারণের মাসিক চাঁদা বা কিস্তি প্রদানের উপর নির্ভরশীল। এজন্য পুরো টার্গেট সমষ্টিকে সচেতন করা ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা সর্বাগ্রে জরুরি।
সমষ্টি বা দেশের সকল জনগণ ঠিকভাবে সাড়া না দিলে এই কর্মসূচি মুখ থুবড়ে পড়ে যাবে। জানা গেছে, উদ্বোধনের পর পনেরদিন পর্যন্ত রেজিষ্ট্রেশনের সাড়া খুবই নগণ্য এবং যারা আবেদন করেছেন তারা একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সদস্য। কিন্তু একটি দেশের সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা শুধু একটি দলের মাধ্যমে সফল হতে পারে না। এই ধরনের পর্যবেক্ষণ হলে সেটাও এ কর্মসূচির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ এবং দেশের জন্য অকল্যাণকর।
ইতোমধ্যে একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ বলেছেন, ‘এটা খুব বড় উদ্যোগ তবে এখনও এর কোন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো চোখে পড়েনি।’ফিক্সড রিটার্নের বিষয়ে বলা হয়েছ— ‘এত টাকা জমা দিলে এত টাকা দিয়ে দিব, এমন ঘোষণা দিলেই হবে না। টাকা আসবে কোত্থেকে? এটা বাস্তব সম্মত কিনা?’
আরেকজন বলেছেন, ‘এজন্য কোনো নীতিমালা তৈরি হয়নি, জনগণ অবগত নয় জনআস্থাও সৃষ্টি হয়নি। এতবড় প্রকল্পের আইডিয়াটাই দুঃসাহসের ব্যাপার।’আঠারো বছরের বেশি সবাই এর আওতাভুক্ত হবে। দেশের শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ৪০ ভাগের বেশি। যাদের স্থায়ী আয় নেই তারা সদস্য হতে চাইবে না। আর বেকার কেউ সদস্য হলেও সে কিস্তি বা মাসিক চাঁদা পরিশোধ করবে কীভাবে?
নিম্নআয়ের সঞ্চয়হীন, বেকার, উপার্জনহীন মানুষের জন্য সমতা স্কিম করা হলেও এর বাস্তবতা সুদূর পরাহত। কারণ, ব্যাংক কার্ড, ডেবিট কার্ড ও মোবাইল ব্যাংকিং—এর ফিনান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে মাসিক কিস্তি বা চাঁদা পরিশোধের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এসব সুবিধাভোগী মানুষ সর্বজনীন পেনশনের সদস্যভুক্ত হলেও আধুনিক ডিজিটাল সুবিধার আওতার বাইরে।
ফলে প্রবাস, প্রগতি কিছুটা কাজ করলেও সমতা ও সুরক্ষার নামে যাদের কল্যাণের তাগিদে সর্বজনীন কথাটা ব্যবহার করা হয়েছে সেসব জনগোষ্ঠী এই সর্বজনীন পেনশন সুবিধার বাইরে থেকে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তেলের সাথে জল মেশানো যেমন কঠিন— তেমনি পেনশনের একই নিয়ম কোনো ক্যাটাগরির জন্য তেল হিসেবে ভেসে থাকা আবার কারো জন্য পানি হিসেবে নিচে ডুবে থাকার মতো মনে হচ্ছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে এসেছে তা হলো— আমাদের দেশে শতকরা ৯০ জন মুসলিম। বিশেষ করে ধর্মপ্রাণ মানুষের বয়স বেশি হলে তারা পরকালের কথা চিন্তা করে তাদের নিজেদের আয়, সরকারি চাকুরির পেনশনের অর্থ বিনাসুদে গচ্ছিত রাখতে ভালোবাসেন। তাইতো দেশের অনেক সাধারণ প্রচলিত ধারার ব্যাংকেও বিশেষ ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকিং নিয়ম চালু হয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে সর্বজনীন পেনশনের জমাকৃত অর্থে সুদ না বলে ইসলামী নিয়মে লাভ হিসেবে একটি অপশন থাকলে এই প্রকল্পে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যেতে পারে।
বিষয়টা হলো বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মসূচিতে ধারকরা বৈদেশিক নীতির সংযোজন ও প্রচলনের প্রবণতায় প্রায়শই ধাক্কা খেতে হচ্ছে। তাই আমাদেরকে আমাদের নিজস্ব চিন্তা, অবস্থান ও মূল্যবোধের নিরীখে যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত। সর্বজনীন পেনশনের জমাকৃত অর্থের ব্যাপারে এই বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া উচিত।
স্কিমধারী ব্যক্তির অবর্তমানে তার মনোনীত নমিনি সেই পেনশনের টাকা তুলতে পারবেন কিন্তু নমিনিও যদি মারা যান তাহলে সেক্ষেত্রে সেই অর্থের ব্যবহার কীভাবে কি হবে তা বলা হয়নি। কারণ, সর্বজনীন পেনশনে উত্তরাধিকারীর কথা বলা হয়নি।
সর্বজনীন পেনশন স্কিম ধারণা যুগান্তকারী। আমাদের বাস্তবতা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক ভিন্ন। তাই এখনও সমতা ও সুরক্ষা স্কিমে তেমন আবেদনকারী নেই। নানা কারণে এখানে সবার অন্তর্ভুক্তি বিষয়টি সুকঠিন।
এদেশের বিশাল আয়বৈষম্য নিপীড়িত জনসংখ্যার নিরীখে ‘সমতা’বা ‘সুরক্ষা’স্কিম কিভাবে গতিপ্রাপ্ত হবে তা নিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে আরো পর্যবেক্ষণ করার প্রয়োজন ছিল। সর্বজনীন ধারণা যেন সবার কল্যাণে আসে সেটাই মুখ্য হওয়া দরকার। যেহেতু কেবল শুরু হয়েছে সেহেতু এটি নিয়ে এখনও গভীরে ভাবার অবকাশ আছে।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
[email protected]
এইচআর/এএসএম