মহানবির (সা.) অতুলনীয় পারিবারিক জীবন

মাহমুদ আহমদ
মাহমুদ আহমদ মাহমুদ আহমদ , ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৯:৪৭ এএম, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩

আজ পবিত্র রবিউল আউয়াল মাসের ৬ তারিখ। এ পবিত্র মাসে বিশ্বনবি ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি হজরত মুহাম্মদ (সা.)কে আল্লাহপাক পৃথিবীবাসীর জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছেন। আজকে হজরত রাসুল করিম (সা.)-এর পারিবারিক জীবনের কয়েকটি বিষয় তুলে ধরব। মহানবি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পারিবারিক জীবন কতইনা উত্তম ছিল। হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি মহানবি (সা.) বলেছেন, নিজ স্ত্রী ও পরিবারের সাথে যে সর্বোত্তম আচরণ করে সে-ই তোমাদের মাঝে সর্বোত্তম।

আর আমরা সবাই জানি, তিনি (সা.) সব সময় তার পরিবারসহ সকলের সাথে উত্তম আচরণ করতেন। তিনি (সা.) এ কথাও বলেছেন, স্ত্রী ও পরিবারের সাথে কেমন আচরণ করতে হবে তা আমার কাছ থেকে শেখো। এ বিষয়ে আমি তোমাদের আদর্শ।

প্রত্যেক ব্যক্তিই ভাবতে পারে, সে তার পরিবারের সাথে সদাচরণ করে, কিন্তু বাস্তবে হয়তো তার আচরণে ত্রুটি থাকতে পারে। এজন্য সম্ভাব্য এ ভ্রান্তি দূর করার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) পরিস্কার ঘোষণা দিয়েছেন, এ বিষয়ে আমি সর্বোত্তম। অর্থাৎ স্ত্রী ও পরিবারের সাথে কেমন ব্যবহার করতে হবে তা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বাস্তব নমুনা থেকে আমরা শিখব।

রাসুলুল্লাহ (সা.) এর পারিবারিক জীবন সম্বন্ধে হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবি (সা.) খুব সাদা-সিধা জীবন-যাপন করতেন। গৃহস্থালীর কোনো কাজ করতে তিনি লজ্জাবোধ করতেন না। মহানবীর (সা.) উটকে তিনি নিজেই তৃণ জাতীয় উদ্ভিদ প্রভৃতি খাওয়াতেন। ঘরের কাজকর্ম করতেন। নিজের জুতা মেরামত করতেন। কাপড় সেলাই করতেন। বকরির দুধ দোহাতেন। ভৃত্যদের নিজের সাথে বসিয়ে খাবার খাওয়াতেন। আটা পিষতে পিষতে তারা ক্লান্ত হয়ে গেলে তাদের সাহায্য করতেন। বাজার থেকে ঘরের জিনিসপত্র ক্রয় করে আনতে লজ্জা বোধ করতেন না। ধনী গরীব সবার সাথে মোসাফাহা (আলিঙ্গন) করতেন। সর্বদা প্রথমে সালাম দিতেন। কেউ খেজুরের দাওয়াত দিলেও সাদরে গ্রহণ করতেন, তুচ্ছ জ্ঞান করতেন না।

তিনি (সা.) অত্যন্ত নম্র স্বভাবের, সহানুভূতিশীল ও দয়ার্দ্র চিত্তের অধিকারী ছিলেন। তিনি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করতেন। সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলতেন, তার চেহারায় সর্বদা মৃদু হাসি লেগেই থাকত। তিনি কখনো অট্টহাসি হাসতেন না। খোদা ভয়ে চিন্তিত থাকতেন, কিন্তু তাঁর মধ্যে রুক্ষতা ও বদমেজাজীর চিহ্নও ছিল না। বিনয়ী স্বভাবের ছিলেন, কিন্তু তাঁর (সা.) মধ্যে ভীরুতা, কাপুরুষতা ছিল না। খুব দানশীল ছিলেন, কিন্তু অপচয় করতেন না। নরম মনের, দয়ালু প্রকৃতির ছিলেন। সব মুসলমানের সাথে দয়ার্দ্র আচরণ করতেন। এত বেশি পেট ভরে খেতেন না যে ঢেকুর উঠতে থাকে। লোভ লালসার দিকে কখনো আকৃষ্ট হতেন না, বরং ধৈর্যশীল, কৃতজ্ঞ ও স্বল্পে তুষ্ট ছিলেন। (আসাদুল গাবা, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৯)

বাস গৃহের ব্যাপারে তিনি (সা.) সাদাসিধা থাকা পছন্দ করতেন। সাধারণতঃ তার ঘরগুলো হত এক কামরার এবং তার সামনে ছোট আঙ্গিনা। সেই কামরার মাঝখান দিয়ে টানানো থাকতো একটা রশি। সেই রশির ওপর কাপড় ঝুলিয়ে দিয়ে তিনি (সা.) আলাদা এক পাশে সাক্ষাৎ প্রার্থীদের সাথে কথাবার্তা বলতেন। তিনি চৌকি বা খাট ব্যবহার করতেন না।

বরং, মাটির ওপরই বিছানা পেতে শুতেন। তিনি জীবন-যাপনের ক্ষেত্রে এত বেশী সাদা-সিধে ছিলেন যে, হযরত আয়শা (রা.) তার ওফাতের পর বলেছিলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবিতকালে আমাদেরকে কয়েকবার শুধু পানি আর খেজুর খেয়েই দিন কাটাতে হয়েছিল। এমনকি, যেদিন তাঁর মৃত্যু হয় সেদিনও আমাদের ঘরে পানি ও খেজুর ছাড়া আর কিছুই ছিল না। (বুখারি)

মহানবীর (সা.)-এর বিছানা-পত্রও ছিল নিতান্ত অনাড়ম্বর। সাধারণতঃ একটি চামড়া কিংবা উটের পশম দিয়ে তৈরী একটি কাপড়। হযরত আয়শা (রা.) বলেছেন, আমাদের বিছানা এত ছোট ছিল যে, যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) রাতে ইবাদত করার জন্য উঠতেন তখন আমি এক পাশে সরে গিয়ে জড়ো হয়ে থাকতাম। কারণ, বিছানা ছিল ছোট। যখন ইবাদতের সময় তিনি দাঁড়াতেন তখন আমি হাঁটু সোজা করতে পারতাম, আর যখন তিনি সিজদা করতেন তখন আমি হাঁটু জড়ো করে নিতাম। (বুখারি)

পানাহারের ব্যাপারেও তিনি (সা.) সর্বদা অত্যন্ত সরল ছিলেন। খাবারের মধ্যে লবন বেশি হল বা কম হল কিংবা রান্না খারাপ হল- এসব ব্যাপারে তিনি কখনই কিছু বলতেন না, বা অসন্তোষ প্রকাশ করতেন না। এ ধরনের খাবার যতটা সম্ভব খেয়ে নিয়ে তিনি রাঁধুনির মনোকষ্ট দূর করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু তা যদি একেবারেই খাওয়ার অযোগ্য হয়, তাহলে তিনি হাত সরিয়ে রাখতেন এবং কখনোই বলতেন না যে, এই খাবার খেতে আমার অসুবিধা হচ্ছে। (বুখারি)

হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনও এক নাগাড়ে তিন দিন পেট ভরে খাবার খান নি এবং এই অবস্থা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাত পর্যন্ত চলেছিল। (বুখারি) স্ত্রী ও ভৃত্যদের সাথে এই শ্রেষ্ঠনবির আচরণ কেমন ছিল এ সম্বন্ধে হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বর্ণনা করেন, হজরত রাসুল করিম (সা.) কখনো কাউকে মারেন নি। কোনো স্ত্রীকেও নয়, কোনো ভৃত্যকেও নয়। কিন্তু আল্লাহ্ পথে তিনি বীরত্বের সাথে লড়াই করেছেন। তাকে কখনো কেউ কষ্ট দিলে তিনি এর প্রতিশোধ নেননি। কিন্তু যখনই আল্লাহতায়ালার মর্যাদা ও সম্মানের ওপর কোনো আঘাত আসত, তখন তিনি আল্লাহতায়ালার খাতিরে প্রতিশোধ নিতেন। (বুখারি) স্বীয় স্ত্রীদের প্রতিও তিনি (সা.) অত্যন্ত নম্র ও ন্যায় ভিত্তিক আচরণ করতেন।

হজরত নবি করিম (সা.) সব সময় তার সাহাবাদেরকে (রা.) বলতেন, ‘যে ব্যক্তি বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে পেয়েছে, কিন্তু জান্নাতের অধিকারী হতে পারেনি, সে বড়ই হতভাগ্য।’ অর্থাৎ বৃদ্ধ পিতা মাতার সেবা মানুষকে আল্লাহতায়ালার কৃপার এত বড় উত্তরাধিকারী করে যে, যে ব্যক্তি তার পিতা মাতার সেবা করবার সৌভাগ্য লাভ করে, সে অবশ্যই পুণ্য অর্জনকারী হয় এবং আল্লাহতায়ালার কৃপার অধিকারী হয়ে যায়। (মুসলিম)

আজ আমরা যদি এই মহান ও শ্রেষ্ঠ রাসুলের জীবনাদর্শ অনুসরণ করে চলি তাহলে আমাদের প্রতিটি পরিবারে বিরাজ করবে প্রশান্তির সুবাতাস। তাই আসুন, শ্রেষ্ঠনবির (সা.) আদর্শ অনুসরণ করি এবং জীবনকে শান্তিময় করি।

লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।

এইচআর/এমএস

হজরত নবি করিম (সা.) সব সময় তার সাহাবাদেরকে (রা.) বলতেন, ‘যে ব্যক্তি বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে পেয়েছে, কিন্তু জান্নাতের অধিকারী হতে পারেনি, সে বড়ই হতভাগ্য।’ অর্থাৎ বৃদ্ধ পিতা মাতার সেবা মানুষকে আল্লাহতায়ালার কৃপার এত বড় উত্তরাধিকারী করে যে, যে ব্যক্তি তার পিতা মাতার সেবা করবার সৌভাগ্য লাভ করে, সে অবশ্যই পুণ্য অর্জনকারী হয় এবং আল্লাহতায়ালার কৃপার অধিকারী হয়ে যায়। (মুসলিম)

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।