পুলিশ-আমলা সামলান

প্রভাষ আমিন
প্রভাষ আমিন প্রভাষ আমিন , হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ
প্রকাশিত: ০৯:২৪ এএম, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩

নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের জবাবে তখনকার প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘দেশে পাগল আর শিশু ছাড়া কোনো নিরপেক্ষ ব্যক্তি নেই।’ তাঁর এই কথাটি নিয়ে তখন তুমুল সমালোচনা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে কথাটি কিন্তু মিথ্যা নয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর সব মানুষেরই ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ আছে। আর ‘নিরপেক্ষতা’ একটি খুবই আপত্তিকর শব্দ। একজন বিবেকবান মানুষ কখনো নিরপেক্ষ হতে পারেন না। একজন বিবেকবান মানুষ ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বুঝতে পারবে। তিনি অবশ্যই সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেবেন।

ব্যক্তি অবস্থান বা পদবি যাই হোক, প্রত্যেকটি মানুষই কোনো না কোনো দলকে সমর্থন করবেন। ভোট কেন্দ্রের গোপন কক্ষে সবারই অধিকার আছে, তার পছন্দের দল বা প্রার্থীকে ভোট দেয়ার। কিন্তু সবাইকেই তার পছন্দ প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। যারা সরাসরি দল করেন, তারা তো প্রকাশ্যে নিজেদের অবস্থান জানাতেই পারেন। কিন্তু না জানালেও ক্ষতি নেই। না জানানোর অধিকারও সবার আছে। এ কারণেই গোপন ব্যালটে ভোটের ব্যবস্থা।

পছন্দ করার অধিকার যেমন আপনার আছে, তেমনি তা গোপন রাখার অধিকারও আছে। তবে আপনার অবস্থান, পেশা, পদবীর ওপরও নির্ভর করে আপনি আপনার পছন্দ-অপছন্দ প্রকাশ্যে জানাতে পারবেন কিনা। যেমন প্রধান নির্বাচন কমিশনারও তো নিশ্চয়ই কাউকে না কাউকে ভোট দেবেন। কিন্তু তাতে তার অবস্থান ক্ষুণ্ণ হবে। তিনি তার সাংবিধানিক শপথের কারণেই অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী হয়ে কারো প্রতি আচরণ করতে পারবেন না। যেমন সাংবাদিকদের কোনো শপথ নিতে হয় না। কিন্তু প্রতিটি সাংবাদিকেরই বিবেকের কাছে দায়বদ্ধতা আছে।

তাই একজন পেশাদার সাংবাদিক কোনোভাবেই কোনো দলের প্রতি তার আনুগত্য প্রকাশ্যে ঘোষণা করবেন না। তেমনি সরকারি কর্মচারিদেরও চাকরিবিধি মেনে চলতে হয়। তারা সরকারের হয়ে কাজ করবেন। গোপনে যে দলকেই সমর্থন করুন, প্রকাশ্যে কোনো দলের পক্ষে কাজ করার বা ভোট চাওয়ার অধিকার বা সুযোগ কোনো সরকারি কর্মচারির নেই।

এমনিতে বাংলাদেশে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে দলীয় আনুগত্য প্রবল। পুলিশ-প্রশাসন সর্বত্র দলীয়করণ হয়ে গেছে অনেক আগেই। সরকারি চাকরি পেতে হলে তাকে অনানুষ্ঠানিকভাবে দলীয় আনুগত্যের পরীক্ষা দিতে হয়। আওয়ামী লীগ যেহেতু টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় আছে, তাই প্রশাসনে তাদের প্রতি অনুগতদের সংখ্যা বেশি এটা অস্বাভাবিক নয়।

বিএনপি আমলেও প্রশাসনে দলীয়করণ হয়েছে। তবে এই ১৪ বছরে বিএনপি আমলে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিরা কোনঠাসা আছেন। তাদের অনেকেই চাকরি শেষ করেছেন, চাকরি হারিয়েছেন বা ওএসডি হয়ে আছেন বা তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দাযিত্ব পালন করছেন। যে যেখানেই দায়িত্ব পালন করুক, সবাই রাষ্ট্রের কর্মচারি, কোনো দলের নয়। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ যাই থাকুক, সরকারি কর্মচারি হিসেবে কারো সেটা প্রকাশ্যে ঘোষণা করার সুযোগ নেই। কিন্তু এই সহজ কথাটাই ভুলে গেছেন যেন আমাদের দেশের কোনো কোনো আমলা বা পুলিশ।

বিদেশীরা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের ওপর নানারকম চাপ সৃষ্টি করছে। সরকারও বারবার একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাতের অঙ্গীকার ব্যক্ত করছে। জনগণের চাওয়াও তাই। সবার আকাঙ্খা এক বিন্দুতে মিললে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু পুলিশ ও প্রশাসনের অতি উৎসাহী কর্তারা সবার এই চাওয়ায় বাধা সৃষ্টি করছে। এখনই এই আমলা ও পুলিশদের সামলাতে হবে।

আলোচনাটি এলো গত সম্প্রতি কয়েকজন পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তার নানা বক্তব্যে। সর্বশেষটি আগে উল্লেখ করা যেতে পারে। গত ১১ সেপ্টেম্বর এক অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জামালপুরের জেলা প্রশাসক মো. ইমরান আহমেদ বলেন, ‘আমাদের অনেক কষ্টে অর্জিত এই স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার সুফল যোগাযোগ ও উন্নয়ন। এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। যে সরকার এই উন্নয়ন করেছে এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য সেই সরকারকে পুনরায় নির্বাচিত করে, আবারও ক্ষমতায় আনতে হবে। এটা হবে আমাদের প্রত্যেকের অঙ্গীকার। আমি এটা মনে করি আপনারা নিজের চোখে দেখে সরকারের প্রতি অকৃতজ্ঞ হবেন না।’

তার এই বক্তব্যের ভিডিও ভাইরাল হলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। সমালোচনার মুখে দুদিন পরই তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু একজন সরকারি কর্মচারি হিসেবে তিনি যা বলেছেন, তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রত্যাহার আসলে কোনো শাস্তি নয়। নির্বাচনের সময় জেলা প্রশাসকরাই রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। ইমরান আহমেদের মত দলীয় ব্যক্তি রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করলে নির্বাচন নিরপেক্ষ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

তিনি রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করার সময়ও তো আওয়ামী লীগকেই ক্ষমতায় আনতে চাইবেন। জামালপুরের জেলা প্রশাসকের মত এমন আরো অনেক কর্মকর্তা আছেন, যারা চান আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতআয আসুক। চাইতেই পারেন। কিন্তু দায়িত্বের চেয়ারে বসে কোনো দলের পক্ষে ভোট চাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে ইমরান আহমেদই প্রথম নন। এর আগে গত ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ পৌরসভা আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে পুনরায় নির্বাচিত করতে প্রকাশ্যে ভোট চান দেওয়ানগঞ্জ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শ্যামল চন্দ্র ধর। পরে ওসির ওই বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে আলোচনা সমালোচনার সৃষ্টি হয়।

এ প্রেক্ষিতে গত ২৫ আগস্ট ওসি শ্যামল চন্দ্র ধরকে জামালপুর পুলিশ লাইনসে ক্লোজ করা হয়। গত ১৫ আগস্ট দুপুরে নাঙ্গলকোট উপজেলার মিলনায়তনে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে নাঙ্গলকোট থানার ওসি ফারুক আহমেদ বলেন, ‘নাঙ্গলকোটের মানুষ গণহারে উনাকে (অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল) আবার নির্বাচিত করবেন। এটা আমার দিক থেকে আপনাদের কাছে মিনতি। আসলে মাননীয় অর্থমন্ত্রী নাঙ্গলকোটের এত উন্নয়ন করেছেন। নাঙ্গলকোটের অনেক এলাকায় রাস্তাঘাট ছিল না, বিদ্যুৎ ছিল না। উনি যখন আসলেন, তখন আপনাদের মন জয় করলেন এবং আপনাদেরকে উন্নয়নের শিখরে পৌঁছে দিলেন।' অবশ্য ফারুক আহমেদকেও পরে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

উদাহরণ খুঁজলে হয়তো আরো পাওয়া যাবে। কিন্তু পুলিশ এবং আমলাদের এই উৎসাহ সরকার ও দলের জন্য ক্ষতিকর। যারা এভাবে প্রকাশ্যে সরকারি দলের জন্য ভোট চাইছে, তারা কিন্তু আদতে সরকার ও সরকারি দলের জন্য বিপদ ডেকে আনছে। বিরোধী দল বারবার বলছে, বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাদের এই বক্তব্য বিএনপির দাবির পক্ষে আরো যুক্তি আনবে। আর এখন বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর নজর রাখছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক নানা মহল।

আমলা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের এ ধরনের বক্তব্য একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথে বাধা। বিষয়টা অন্যভাবেও ভাবার অবকাশ রয়েছে। যারা বক্তব্য দিয়েছে, তারাও নিশ্চয়ই জানেন, এই সরকার বা সরকারি দলের জন্য ভালো হবে না। তারা আসলে সরকারকে বিতর্কিত করতেই ইচ্ছা করেই এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছে। এটা স্যাবোটাজও হতে পারে। তারা জেনে বুঝেই সরকারকে বিপাকে ফেলতে এ ধরনের কথা বলতে পারে। মার্কিন ভিসা নীতি পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি করেছে। অনেকেই মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করতে চাইছেন না। তাই আগেভাগেই বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে মাঠ থেকে প্রত্যাহার হয়ে যাওয়াটাও তাদের এক ধরনের কৌশল হতে পারে।

বিদেশীরা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের ওপর নানারকম চাপ সৃষ্টি করছে। সরকারও বারবার একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাতের অঙ্গীকার ব্যক্ত করছে। জনগণের চাওয়াও তাই। সবার আকাঙ্খা এক বিন্দুতে মিললে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু পুলিশ ও প্রশাসনের অতি উৎসাহী কর্তারা সবার এই চাওয়ায় বাধা সৃষ্টি করছে।

এখনই এই আমলা ও পুলিশদের সামলাতে হবে। নিছক প্রত্যাহার তাদের অপরাধের শাস্তি নয়। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়ে সরকারকেই প্রমাণ করতে তারাও সত্যি সত্যি একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়।

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।