প্রয়োজন মনুষ্যত্ববোধের সংরক্ষণ
গণমাধ্যমে প্রচারিত একটি সংবাদ হঠাৎ চোখে পড়লো। সংবাদটির সারাংশ এমন— ‘কু-প্রস্তাব দেওয়ায় চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে শনিবার (২৬ আগস্ট, ২০২৩) সকালে বাবাকে গলা কেটে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে মেয়ের বিরুদ্ধে।’ জানি—অপরাধ মানুষের এক প্রাগৈতিহাসিক প্রবণতা। অথচ একথাও সত্য যে, সময়ের পরিক্রমায় মানুষের সভ্যতার বিবর্তন হয়। বলা হয়, প্রতিদিন আমরা আরও সমৃদ্ধ সভ্যতার দিকে যাচ্ছি, আমরা আধুনিক হচ্ছি। কিন্তু আমরা কোন পথে হাঁটছি? মৌলিক নাকি যান্ত্রিক সভ্যতার?
মেটামর্ডান যুগে আমাদের অপরাধ প্রবণতাগুলোও চরিত্র বদলেছে। ঘটনাগুলো আর দশটি সামাজিক অপরাধের মতো নয়। বাবা-মা-সন্তান, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সর্ম্পকগুলো স্বর্গীয় মর্যাদার। কিন্তু যখন একজন শিক্ষকের কাছে শিক্ষার্থীর সম্ভ্রম ও জীবন অনিরাপদ হয়ে যায়, যখন বাবা-মায়ের হাতে প্রাণ যায় সন্তানের কিংবা সন্তানের হাতে বাবা-মায়ের তখন ভেঙে পড়ে নৈতিকতা, মানব-অস্তিত্ব ও বিশ্বাসের দেওয়াল। ঘৃণা ও অবিশ্বাসের চোরাবালিতে ডুবে যায় সব সম্পর্কের ভিত্তিপ্রস্তর।
তাছাড়া নানা রকম সামাজিক অসঙ্গতি ও অপরাধ নতুন নতুন অবয়বে আবির্ভূত হচ্ছে, যা আমাদের মানবিক বৈশিষ্ট্যের প্রশ্নে অস্তিত্ব-ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে। সমাজবিজ্ঞান, অপরাধবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের একাডেমিক ডিসকোর্সে এসব অপরাধ-প্রবৃত্তির নিশ্চয় নানা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আছে। তবে সবকিছুর মূল হচ্ছে, মনের দূষণ তথা মনুষ্যত্ববোধের অবক্ষয়। কোনো কিছু যখন বিলুপ্তির দিকে যায় তখন সেটিকে সংরক্ষণের প্রয়োজন পড়ে। মনুষ্যত্ববোধের ক্ষেত্রেও তেমন উদ্যোগ গ্রহণ করার সময় হয়তো অত্যাসন্ন।
যত দিন যাচ্ছে পরিবেশ দূষণের মতো করে মানুষের মনও দূষিত হচ্ছে। দূষণের মাত্রাটি ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী। আর মনের এই দূষণ থেকে সব সামাজিক অনাসৃষ্টির উদ্ভব। পত্রিকার পাতা বা টেলিভিশনের পর্দায় তাকালেই সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের এমন সব খবর চোখে পড়ে যা বিবেক, বোধ, সত্তাসহ সবকিছুকে প্রকম্পিত করে। একটা ময়লার ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শ্বাস নেওয়ার প্রয়োজন হলেও নাক যেমন দুর্গন্ধযুক্ত শ্বাস নিতে চায় না, ঠিক তেমনিভাবে এমন খবরের দিকে নজর গেলেও মস্তিষ্ক তা পড়তে চায় না। মনে হয় যেন, এমন নিকৃষ্টতম অপরাধের কথা পড়লেই মনটা অশুচি হয়ে পড়বে। তবুও পড়তে হয় সমাজ ও মানুষের মনস্তত্ত্ব ও বিবর্তনধারা বোঝার জন্য।
আমাদের সমাজের অধিকাংশ মা-ই প্রয়োজন হলে সন্তানের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে পারে নির্দ্বিধায় ও নিঃসংকোচে। তেমন হাজারো উদাহরণ আছে। বাবারাও নিজের রক্ত-ঘাম এক করে উপার্জন করে সন্তানের নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য। তাহলে এমন সমাজে কিছু সন্তান-হন্তারক মা-বাবা কীভাবে সৃষ্টি হলো, যারা নিজেদের বিকৃত সুখের জন্য আত্মজা সন্তানকে বলি দেয়?
অপরাধ করার আগে তাদের বিবেক ও মাতৃ-পিতৃসত্তায় কী একটুও বাধে না? আসলে হয়তো নানা কারণে তাদের মনটা দূষিত হয়ে যায়। দূষিত মন তাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলে মনুষ্যত্ব ও বিবেকবোধ থেকে। ফলে তাদের মাতৃ-পিতৃরূপ পরাজিত হয় পাশবিকরূপের কাছে। মুদ্রার অপর পিঠ দেখলে পরিসংখ্যান বলছে, পারিবারিক সহিংসতা ও বঞ্চনার ক্ষেত্রে বেশি ভুক্তভোগী বাবা-মায়েরা। এমন নিদারুণ ঘটনা প্রতিদিন শতশত ঘটছে আমাদের সমাজে। সেক্ষেত্রে নেতিবাচক ভূমিকায় থাকে সন্তানরা। যারা জীবনের সবটুকু মায়া, মততা, সময়, শ্রম ও সম্বল দিয়ে আমাদের গড়ে তুললো, তাদের সাথে এমন বিপ্রতীপ আচরণ কি মানুষ হিসেবে আমাদের শোভা পায়?
এমন অনেক অকল্পনাতীত ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনারও জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। অপরাধীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক সাজাও প্রদান করা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নিছক আলোচনা বা আলোড়ন সৃষ্টি অথবা শাস্তির বিধান ও বাস্তবায়নের মধ্যেই কি এই অতল মনুষ্যত্ব-সংকটের সমাধান আছে?
তাছাড়া এমন নিকৃষ্টতম মানবিক বিপর্যয় দেখে আমরা বিস্মিত হচ্ছি, উষ্মা প্রকাশ করছি, এমনকি মাঝে মাঝে মুষড়ে পড়ছি সত্য; কিন্তু এমন অবক্ষয় প্রতিরোধ বা প্রতিকারে আমরা কোনো মৌলিক উদ্যোগ গ্রহণ করছি কি? শেকড়ে পচন ধরলে শাখা-প্রশাখায় ওষুধ দিয়ে সংকট শতভাগ দূর করা কি সম্ভব? আসলে আমরা প্রাত্যহিক জীবনোপকরণে এমন সব বিষয়কে অগ্রাধিকার ও স্থান দিয়েছি এবং দিচ্ছি যেসব আমাদের অস্তিত্বসর্বস্ব করেছে সত্য, তবে পাশাপাশি মনুষ্যত্বহীনও করে তুলেছে।
সবকিছুর জন্য আকাশ তথা পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে দায়ী করা এবং সমাধান খুঁজতে গিয়ে নৈরাশ্যবাদীদের সারিতে দাঁড়িয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা আমাদের সমাজে দেখা যায়। এ যেন জ্বর হলে নাপা খেতে বলার মতো চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্র। অথচ চিকিৎসাবিজ্ঞান বলে, জ্বর হচ্ছে শরীরের ভেতরে বাসা বাঁধতে শুরু করা অন্য কোনো রোগের উপসর্গ।
প্রকৃত চিকিৎসকের কর্তব্য হচ্ছে সেই গুপ্ত রোগের অনুসন্ধান করা। ঠিক এমনভাবে আমাদেরও সামাজিক ও মানবিক বিপর্যয়ের বহু কারণ ও উৎসের সন্ধান করতে হবে। জানতে হবে—কেন বিজ্ঞান পড়াতে গিয়ে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত হবেন একজন শিক্ষক? কেন একজন দশম শ্রেণির ছাত্র তার শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করবে? প্রসঙ্গসূত্রে, দুর্বিষহ কিশোরগ্যাং কালচার, ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমের অপব্যবহার ও নেতিবাচক ফলকেও আমাদের সামাজিক অধঃপতনের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। মাঝে মাঝে পায়ের তলায় মাটির অস্তিত্ব খুঁজে পাই না, যখন দেখি তথাকথিত শিক্ষিত ও বিত্তবান মানুষেরা তাদের গৃহকর্মীদের পুড়িয়ে পুড়িয়ে অথবা ধারালো অস্ত্রের আঁচড়ে প্রতিনিয়ত নির্যাতন কিংবা হত্যা করছে!
আবার, ‘পদ্মা সেতু করতে শিশুর মাথা লাগবে’ এমন গুজবে কান দিয়ে ঢাকায় এক নিরীহ নারীকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা-উল্লাস করছে একদল মানুষরূপী হায়েনা! আমাদের সামাজিক নৈতিকতা ধসের একটি নিকট দূরের উদাহরণ হচ্ছে, সাফ ফুটবল জয়ী বাংলার অদম্য বীরকন্যাদের ব্যাগ থেকে অর্থ ও অন্যান্য জিনিস চুরির ঘটনা।
ব্যবসার ক্ষেত্রে আমাদের সমাজে একশ্রেণির মানুষের সংখ্যা দিন দিন খুব বেড়ে যাচ্ছে। তাদের বিশেষত্ব হচ্ছে—তারা অতি মুনাফাখেকো। সুযোগ পেলেই তারা কারসাজিসহ নানা আয়োজনে মানুষের রক্ত চুষে মুনাফা করছে। পণ্যে ভেজাল ও মাপে কম দেওয়া তো তাদের অস্তিমজ্জাগত স্বভাব। কিছুদিন আগে দেখলাম, এমনই একজন চরম অসাধু ব্যবসায়ী সয়াবিন, জেলি, গ্লুকোজ আর পানি মিশিয়ে তৈরি করছে খাঁটি দুধ! এসব নেতিপন্থা ও অপবুদ্ধিপ্রসূত আচরণ মূলত মনদূষণপ্রসূত যা আজ সমাজ ও মানবতাকে চরম সংকটাপন্ন করে তুলেছে। আজ সমাজকে নিয়ে গভীরভাবে ভাবার বড্ড দেরি হয়ে গেছে।
তবুও সবকিছু ভেঙে পড়ার আগে নিরূপণ করতে হবে সামাজিক ও পারিবারিক অবনমনের কারণগুলো। আমাদের বোধের দুয়ার খুলতে হবে। জাগ্রত হতে হবে চৈতন্যজড়তা ভেঙে। পরিবার ও সমাজের গভীরে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে সেগুলোকে উপশম ও সংস্কার করতে হবে। সেজন্য কিছু অনুশাসন, জবাবদিহি ও নজরদারি বড় প্রয়োজন। আমাদের বা পূর্বজনদের সময়ের কথা যদি বলি তাহলে বলতে হয়, আমাদের বেড়ে ওঠার পেছনে শুধু পারিবারিক অনুশাসন ক্রিয়াশীল ছিল না, সক্রিয় ছিল সামাজিক অনুশাসনও।
আমাদের মধ্যে সবসময় সামাজিক সম্মানবোধ ও লোকলজ্জাবোধ কাজ করতো। সব কাজে পারিবারিক ও সামাজিক জবাবদিহি ছিল। সেই সময়ে, কোনো ছেলে বা মেয়ে যদি ছোট কোনো অপরাধও করতো যা পরিবারের নজর এড়িয়ে গেছে কিন্তু এলাকার কোনো মুরব্বির চোখে পড়েছে, তিনি নিজ দায়িত্ববোধ থেকে ছেলে বা মেয়েটিকে শাসন করতেন বা সঠিক পরামর্শ দিতেন অথবা তাদের অভিভাবককে জানাতেন।
তাছাড়া, সে সময়ে ব্যক্তি ও সমাজের ক্রিয়াকলাপের ওপর সামষ্টিক নজরদারি ও মিথস্ক্রিয়া ছিল। আর এখন আমরা সমাজের খবর রাখবো কী, আমাদের পাশের বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মানুষেরই কোনো খবর রাখি না বা তাদের প্রতি ন্যূনতম দায়িত্ববোধও অনুভব করি না। আমরা ডুবে আছি যান্ত্রিক জীবনে, প্রযুক্তির মোহে ও ব্যক্তিকেন্দ্রিকতায়। প্রাণ, প্রকৃতি, নিজস্ব সংস্কৃতি এবং সর্বোপরি মানুষ ও মানবিকতা থেকে বিযুক্ত হওয়ার এসব অনুঘটক আমাদের মনকে দূষিত করে ফেলছে। কুরে কুরে খাচ্ছে মনুষ্যত্ব। ফলে ব্যক্তি-মনুষ্যত্বের সংকট সমাজের সামগ্রিক মানবিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই, মনের দূষণ রোধ করতে হবে যে কোনো মূল্যে এবং ব্যক্তি ও সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।
সে লক্ষ্যে প্রথমত, সমাজের প্রতিটি স্তরে একটা সিভিক বডি থাকা প্রয়োজন, যা মানুষের বিবেক ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে ভূমিকা রাখবে, সামাজিক জবাবদিহির ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে। দ্বিতীয়ত, পরিবারের কাঠামোটাকে হতে হবে ঐক্যবদ্ধ এবং উদার, যেখানে পরিবারের যেকোনো সদস্য তার জীবন ও মনের ভেতরে বয়ে চলা সব বিষয় পরিবারের সামনে উপস্থাপন করতে পারবে নির্দ্বিধায়। কেননা, আলোচনা হলে সমাধানের পথ বের হয়ে যায়, এটাই চিরন্তন।
তৃতীয়ত, সন্তানদের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের দিনগুলো রাঙিয়ে তুলতে হবে নানা রঙে। সে জন্য নিশ্চিত করতে হবে, শিক্ষায় আনন্দপঠন, নিয়মিত খেলাধুলার জন্য মাঠ, পরিবেশ ও অনুষঙ্গ, বিনোদনের জন্য সুস্থ সংস্কৃতি ও ভ্রমণ। তাদের ভার্চুয়াল জগৎ থেকে বের করে পরিচিত করাতে হবে প্রাণ, প্রকৃতি ও বাস্তব জীবনের সঙ্গে। তাছাড়া স্কুল-কলেজে শিক্ষকদের উচিত বৈষয়িক পাঠদান শেষে ২-৫ মিনিট ব্যপ্তির হলেও একটা মানবতাবোধ তথা জীবনবোধের গল্প শোনানো।
অবশ্য এ চর্চা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও হওয়া দরকার যেখানে শিক্ষকরা ভারি ভারি তত্ত্ব পড়ানোর পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মাঝে বাঙালি জাতিসত্তা ও সংস্কৃতির সঙ্গে প্রাসঙ্গিক একটি জীবন দর্শন প্রতিষ্ঠা করার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। তারা শিক্ষার্থীদের অন্তরে লুকিয়ে থাকা মনুষ্যত্বের স্ফুরণ ঘটাতে অনুঘটকের কাজ করবেন, আলোকিত মানুষ বিনির্মাণ করবেন। চতুর্থত, একটি পরিমার্জিত জীবনবোধ আমাদের ধারণ করতে হবে যেখানে সর্বমঙ্গল ও সর্বপ্রেমের অভিপ্রায় মূর্ত হয়ে উঠবে। সর্বোপরি, আমাদের মানুষ হয়ে উঠতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট, বিশ্লেষক।
এইচআর/ফারুক/এমএস