মহামারি আকারে ডেঙ্গু
মানুষের জীবনকে মূল্য দিলে মশা মারতে হবে
জুলাই মাস থেকে ডেঙ্গু দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে রাজধানীর বাইরের জেলাগুলোতে। আর এই সময় এসে দেখা যাচ্ছে ঢাকায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। গত ১ সেপ্টেম্বর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এক দিনে ২১ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছিল খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এরপর থেকে ২১ জন না হলেও গড়ে দশের ওপর থাকছে মৃত্যুসংখ্যা। দ্রুতই মোট মৃত্যুর সংখ্যাটি হাজার হয়ে যাবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের চেয়ে বেশি মৃত্যুহার আর কোনো দেশে দেখা যাচ্ছে না। সেই বিবেচনায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি মহামারি আকার নিয়েছে বলা যায়।
কিন্তু সরকার মহামারি বলছে না। তবে আমরা তো জানি যখন কোনো অনিয়ন্ত্রিত রোগ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে, তখন সেটাকে মহামারি বলা হয়। যাই হোক সন্দেহ নেই যে, জনস্বাস্থ্য সঙ্কট পর্যায়ে পৌঁছেছে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি। এখন আর এটি কেবল প্রাদুর্ভাব নয়। প্রতিদিন শত শত মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। ঘটছে প্রাণহানির ঘটনা। কিন্তু এমন অবস্থায়ও কেন বিষয়টি নিয়ে তেমন তৎপরতা নেই, সেটা বোঝা যাচ্ছে না।
ডেঙ্গু একটি বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করেছে। তবে এর উৎস মশা। এবং এই মশা নিধনে ব্যর্থ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় একটি বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করেছে দেশে। বর্ষা আসলেই মশাবাহিত রোগ নিয়ে কথাবার্তা বলে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের। গত কয়েক বছর ধরেই মশার কামড়ে সৃষ্ট ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বাড়ছে, এবার সব রেকর্ড ছাড়িয়ে বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। শুধু ঢাকায় নয়, সারাদেশে। আক্রান্তের পাশাপাশি মৃতের সংখ্যাও রেকর্ড ছাড়িয়েছে।
উষ্ণ-আর্দ্র আবহাওয়া, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা ও মানুষের অসচেতনতার কারণে বাংলাদেশ মশার প্রজননের উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে। বলা হচ্ছে এই আবহাওয়াটা আরও কিছুদিন বিরাজ করবে। এমন আবহাওয়া পাশের পশ্চিমবঙ্গেও আছে, তবে সেখানে মশা কমেছে এবং ডেঙ্গুও নিয়ন্ত্রণে।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে পাশের কলকাতা বড় সাফল্য পেলেও ঢাকা কেন পারছে না, এমন কথা বারবার উঠছে। এডিশ মশা নিধনে মানহীন কীটনাশক ব্যবহার, ডেঙ্গুর প্রকৃত চিত্র চিহ্নিত, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও বিভাগের মধ্যে সমন্বয়, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি এবং ক্রয় থেকে নিধন পর্যন্ত প্রতিপদে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে মানুষের কাছের জনপ্রতিনিধি কাউন্সিলররা। এদের মাধ্যমেই জনগণকে সম্পৃক্ত করে একটা সামাজিক আন্দোলন তৈরি করা যেত।
আমাদের ব্যর্থতা মশা নিধনে। সিটি কর্পোরেশন এবং পৌরসভাগুলোর প্রধান কাজ মশা মারা ও ময়লা পরিষ্কার করা। দুটোতেই ব্যর্থ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনের এই প্রতিষ্ঠানগুলো। শুধু এডিস মশা নয়, কোনো মশাই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না এই মন্ত্রণালয়। ভয়াবহ অবস্থা। ডেঙ্গুর থাবায় এখন মশার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। কিন্তু মশার বিস্তার কখনোই থামানো যায়নি বা থামানো হয়নি। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসা-বাড়িতে দিনের বেলায়ও মশারি টাঙিয়ে রাখতে হয়। মশার যন্ত্রণা থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে প্রতিবছর এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়। কিন্তু কাজের মান বাড়ে না।
মশা মারার কার্যকর ব্যবস্থা দৃশ্যমান নয়। মশা মরে না, কারণ তারা যে ওষুধ নিয়ে আসেন সেই ওষুধের মধ্যেও দুর্নীতি হয়, যার কারণে সে ওষুধ দ্বারা মশা নিধন হয় না। সম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে সরবরাহ করা মশার লার্ভা নিধনের জৈব কীটনাশক বিটিআই (বাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস) আমদানিতে প্রতারণার বিষয় প্রমাণিত হয়েছে। আর সে জন্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মার্শাল এগ্রোভেট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে ডিএনসিসি।
এই কোম্পানি সরবরাহকৃত পাঁচ হাজার কেজি বিটিআই বেস্ট কেমিক্যাল ইন্ডাষ্টিজ লি:, সিঙ্গাপুরের উৎপাদিত এবং তাদের নিকট হতে সংগ্রহ করা হয়েছে মর্মে উল্লেখ করা হলেও পরে প্রমাণিত হয় যে এগুলো নিম্নমানের চীনা ওষুধ। শাস্তি বলতে শুধু কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে এই কোম্পানিকে।
রাজধানীতে ফগার মেশিন দিয়ে মশা মারার চেষ্টা করে সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু সেটা খুব একটা কাজে আসছে না। তাহলে কার্যকর উপায়টা কি সেটা দ্রুত ভাবতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি মেয়রগণ যতই র্যালি করুন, সেলিব্রিটিদের দিয়ে প্রচারাভিযান পরিচালনা করেন না কেন, আসল কাজ মশা নিধন।
সমস্যা হলো জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে ডেঙ্গু মশা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয়নি কখনও। কাজের কাজ তেমন কিছু হচ্ছে না। হচ্ছে বিক্ষিপ্তভাবে লোক দেখানো অকার্যকর কার্যক্রম। মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সীমাবদ্ধতা, অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সারা দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে যা লক্ষাধিক মানুষের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া এবং দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যুর কারণ। তাই মশা দিবসের দুইদিন পর পত্রিকায় শিরোনাম হয় দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে এবারই ডেঙ্গুতে বেশি আক্রান্ত।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে পাশের কলকাতা বড় সাফল্য পেলেও ঢাকা কেন পারছে না, এমন কথা বারবার উঠছে। এডিশ মশা নিধনে মানহীন কীটনাশক ব্যবহার, ডেঙ্গুর প্রকৃত চিত্র চিহ্নিত, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও বিভাগের মধ্যে সমন্বয়, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি এবং ক্রয় থেকে নিধন পর্যন্ত প্রতিপদে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে মানুষের কাছের জনপ্রতিনিধি কাউন্সিলররা। এদের মাধ্যমেই জনগণকে সম্পৃক্ত করে একটা সামাজিক আন্দোলন তৈরি করা যেত। সেটাও হয়নি।
আরেকটি বিষয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং সিটি কর্পোরেশনকে মাথায় রাখা দরকার যে, মশা নিধন কোনো মৌসুমি কাজ নয়। সারাবছরের কাজ। মানুষ কেন সচেতন না, একথা বহুবার বলা যাবে। মানুষের জীবনকে মূল্য দিলে মশা মারতে হবে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।
এইচআর/জেআইএম