অন্যের সাহায্য চাওয়ার আগে একটু ভাবুন
ধরুন, আপনি একটা বনের মধ্যে হারিয়ে গেছেন যে বনে শুধু পশুপাখি আছে কিন্তু কোনো মানুষ নেই। দেখবেন, আপনি ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছেন। কারও সাথে কথা বলতে পারছেন না। সংগঠিত ভাবে কিছু করতে পারছেন না। আপনিও ধীরে ধীরে ওই বনের প্রাণীদের মতো একজন হয়ে যাবেন। আপনার মূল সত্তা হয়তো শেষ হবে না কিন্তু আপনি সমাজবদ্ধ জীবন তখন আর থাকবেন না। মানুষ আসলে একা একা বসবাস করতে পারে না। সেজন্যই তার সঙ্গী লাগে, তার পরিবার লাগে, তার সমাজ লাগে, তার একটা দেশ লাগে।
সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষ তার নিজের বুদ্ধিমত্তাকে যেমন কাজে লাগাতে পারে তেমন পারে একটা টিমের শক্তিকে কাজে লাগাতে, যা অন্য কোনো প্রাণী পারে না। বর্তমানের মানুষ যেখানেই অবস্থান করুক না কেন টেকনোলজির কারণে এখন সবাই জোটবদ্ধ। এখন সারা পৃথিবীর মানুষ একসাথে কাজ করতে পারে। এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই মানুষ অনন্য, অন্য প্রাণী থেকে মানুষ আলাদা। আপনি যদি বড় কিছু করতে চান, তাহলে আপনার যেটা দরকার সেটা হচ্ছে অন্যের সাহায্য।
আমি যে বিষয় নিয়ে বলব লিখব সেটা হচ্ছে, The power of asking বা কারও কাছে কিছু চাওয়ার যে একটা দুর্দান্ত ক্ষমতা আছে, সেই ক্ষমতা নিয়ে। একদিন আমি আমার এক ক্লায়েন্টের অফিস থেকে অনেক রাতে ফিরছি। ফেরার পথে, বনানী ওভারব্রিজের সামনে এসে হঠাৎ আমার গাড়ি বন্ধ হয়ে গেলো। গাড়ি থেকে নামলাম, নামার পরে দেখি, গাড়ি দিয়ে সামনের ইঞ্জিন থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। ইতোমধ্যে, গাড়ি যে গরম হয়েছে, সেটা আমি খেয়াল করিনি। আমার গাড়ির মধ্যে কোনো পানিও নেই। আমি চিন্তায় পড়লাম এই ভেবে যে এত রাতে আমি কাকে কোথায় পাবো।
তখন আমি একটা কাজ করতে পারতাম, সেটা হচ্ছে আমি চুপচাপ গাড়ির মধ্যে বসে থাকতে পারতাম অথবা কোন উবার ডেকে আমি বাসায় চলে আসতে পারতাম গাড়ি রাস্তায় রেখে। কিন্তু আমি যেটা করলাম সেটা হচ্ছে আমি মানুষের কাছ থেকে সাহায্য চাইতে শুরু করলাম। সবাই গাড়িতে যাচ্ছে, কেউ এই গভীর রাতে পথে হেঁটে যাচ্ছে না।
আমি হাত দেখালাম, সাহায্যের ভঙ্গিতে হাত নাড়ালাম। অনেকেই চলে গেলো, থামলো না বটে কিন্তু দু-একজন থামলো। তারা তাদের গাড়ির ভিতরে যে পানি ছিল, সেই পানিটা দিয়ে আমার গাড়ি ঠান্ডা করার চেষ্টা করলো। এবং একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখলাম যে, একজন ড্রাইভার সাহেব গাড়ি থেকে নেমে তার বালতি নিয়ে ছুটে গেলেন পানি এনে আমাকে সাহায্য করার জন্যে। আমি ড্রাইভার সাহেবদের আন্তরিকতা ও সাহায্য করার মনোভাব দেখে সত্যিই ওই রাতে খুব অবাক হয়েছিলাম।
এখানে যেটা বলার আছে সেটা হচ্ছে এত রাতে কর্মক্লান্ত কিছু মানুষ কিন্তু আমার সাহায্য করতে এগিয়ে এল। কেন এগিয়ে আসলো? কারণ তাদের কাছে আমি সাহায্য চেয়েছিলাম। আপনারা যারা অন্যের কাছে সাহায্য চাইতে শঙ্কোচবোধ করেন, অন্যের কাছে সাহায্য চাইতে লজ্জাবোধ করেন তাদের উদ্দেশ্যে আমার কথা হচ্ছে, যদি উন্নতি করতে চান, ব্যবসায় সফল হতে চান, যদি প্রফেশনাল লাইফে ভালো করতে চান, তাহলে আপনার একার যে শক্তি, এই শক্তি অতি সামান্য, এই একার শক্তি দিয়ে আপনি খুব বেশি দূর যেতে পারবেন না। আপনাকে অনেকগুলো হাতকে একসাথে করতে শিখতে হবে।
অনেকগুলো হাত যখন আপনার জন্য খাটবে, অনেকগুলো সহযোগিতার হাত যখন আপনার দিকে প্রসারিত হবে, তখন আপনার কাজটা অতি সহজে হয়ে যাবে, আপনার বিজনেস উন্নতি করা অনেক সহজ হবে। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে আপনি চাইবেন কি না এবং চাইলে কীভাবে চাইবেন। তাছাড়া আপনার সাহায্য দরকার কেন এবং কোন কাজের জন্য আপনার সাহায্য দরকার সেটা ঠিক করে চিন্তা করে নেওয়া দরকার। দেখুন ভিক্ষা চাওয়াও কিন্তু একটা সাহায্যের প্রত্যাশা। আপনি যে সাহায্য চাচ্ছেন, এটা কিন্তু ভিক্ষা নয়। এটা হচ্ছে অ্যাসিস্টান্স। এটা সেই সাহায্য, যা আপনার প্রতিষ্ঠানকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করবে, আপনার প্রতিষ্ঠান যেখানে আছে, সেখান থেকে সামনে যেতে সাহায্য করবে। আপনি যেখানে আছেন, সেখান থেকে সামনে যেতে আপনাকে সাহায্য করবে।
আপনারা যখন কোনো বিপদে পড়বেন বা কোনো বিপদে না পড়লেও আপনি যখন নিজের অবস্থানের পরিবর্তন করতে চাইবেন, নিজের ব্যবসার উন্নতি চাইবেন, তখন আপনার অনেকের সাহায্য ও সহযোগিতা লাগবে। অনেককে আপনার প্রয়োজনের কথা বুঝাতে হবে। এখন কীভাবে? এটি বোঝাতে হবে খুব ভদ্রভাবে, খুব নম্রভাবে, কমিউনিকেশন হতে হবে ইফেক্টিভ। এবং এই বোঝানোর মধ্যে বা এই চাওয়ার মধ্যে কিন্তু ভিক্ষাবৃত্তির মতো হাত পাতার বিষয়টা থাকবে না। এখানে বোঝানোর বিষয়টা থাকবে যে, আপনার সাহায্য দরকার কারণ আপনি ঝামেলায় পড়েছেন অথবা আপনি উন্নতি করতে চান। কারণ অন্যের সাহায্য ছাড়া আপনি উন্নতি করতে পারবেন না। যে আপনাকে সাহায্য করছেন তারও কিন্তু ভ্যালু হচ্ছে কারণ সে আপনাকে সাহায্য করে নিজে তৃপ্তি বোধ করছে এবং সে আপনাকে সাহায্য করে আপনার কর্মকাণ্ডের একটা পার্ট হচ্ছে।
সুতরাং আপনার যখন সাহায্য দরকার, সাহায্য চাইতে কুণ্ঠা বোধ করবেন না। কারণ আপনার প্রয়োজন আরেকজন বুঝবে কীভাবে? আপনি যে সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, আপনার আপনজনদের, বন্ধু-বান্ধবদের, প্রতিবেশীদের, আপনার আশপাশের লোকদের সেটা জানতে হবে। তারা জানলে তখন তারা আপনার সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে তৎপর হবেন, তখন তারা আপনাকে উন্নতির দিকে অগ্রসর হতে সহায়তা করবেন। কিন্তু তারা যদি আপনার প্রয়োজনটা না জানেন তাহলে তারাতো আপনাকে সাহায্য করতে পারবেন না।
প্রকৃতপক্ষে আমাদের চারপাশের প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যে একটা হেল্পিং অ্যাটিটিউড আছে। আমরা অন্যদের সাহায্য করতে চাই। এজন্য আপনি আপনার প্রয়োজনটা সুন্দর করে উপস্থাপন করুন। আপনি কথার মাধ্যমে উপস্থাপন করতে পারেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় উপস্থাপন করতে পারেন, আপনার ওয়েবসাইটের মাধ্যমে উপস্থাপন করতে পারেন। এমনকি ইউটিউবের মাধ্যমেও উপস্থাপন করতে পারেন। দেখবেন আপনি যা চাচ্ছেন, সেটা পাচ্ছেন। তবে চাওয়াটা হতে হবে যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত।
মজার ব্যাপার হচ্ছে আপনি চাচ্ছেন হয়তো একজনের কাছে কিন্তু সাহায্য করার মানুষ অনেক। মনে রাখতে হবে আপনি ঈশ্বরের কাছে বা আল্লাহর কাছে কিছু না চাইলে প্রাপ্তির আশা করা উচিত কি? যদিও স্রষ্টা বোঝেন আমাদের অন্তরের চাওয়া । সেজন্য আমরা না চাইতেই অনেক কিছু পাই। কিন্তু মানুষ সব বুঝবে না। মানুষ তো অন্তর্যামী নয়। কথায় বলে, বাচ্চা না কাঁদলে মাও দুধ দেয় না। কথা সত্য। যে চাচ্ছে সে পাচ্ছে। যে চাচ্ছে না সে পাচ্ছে না।
তাই চাইতে শিখুন এবং সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে শিখুন। মিথ্যা নয়, সত্য কথা সুন্দর করে উপস্থাপন করুন। আমার বিশ্বাস আপনি যা চাচ্ছেন তা পাবেন। আপনি বিজনেসে সাফল্য চাইলে সেটা পাবেন, প্রফেশনাল লাইফে, আপনার চাকরি জীবনে সফলতা চাইলে আপনি সেটা পাবেন। শুধু অন্যের সাহায্যকে একত্রিত করতে হবে, ভালোভাবে চাইতে জানতে হবে। একটি ছয় বছরের একটা বাচ্চা যেমন পড়ে গেলে বা ব্যথা পেলে অন্যের সাহায্য খোঁজে, আমরা যারা বড় তারাও যখন বিপদে পড়েন, যখন উন্নতি করতে চান, যখন সমস্যায় পড়েন, তখন অন্যের সাহায্য খুঁজতে হবে।
লেখক: কলাম লেখক, অর্থনীতি বিশ্লেষক, ফাইন্যান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট; সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল।
এইচআর/ফারুক/এএসএম