সবচেয়ে অরাজনৈতিক হচ্ছে কৃষক

ড. মাহবুব হাসান
ড. মাহবুব হাসান ড. মাহবুব হাসান , কবি, সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৯:২৪ এএম, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কে না জানে চাষীরা রাজনীতি করে না। তারা সংঘবদ্ধ নয়, তারা গোষ্ঠীবদ্ধ নয় বলেই তারা তাদের নিত্যদিনের প্রয়োজনের কথা বলতে পারে না। সরকারের রাজনৈতিক ও উন্নয়নের চোখ এবং কান তাদের নিত্যদিনের প্রয়োজনের ব্যাপারে ব্যাপকভাবে তৎপর নয়।

আজ আর রাজনীতি নিয়ে নয়, কথা বলতে চাইছি রাজনীতির বাইরের (তারা কি বাইরের) কৃষকদের নিয়ে। তারা নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন বলেই আমরা গ্রাসাচ্ছাদন করতে পারছি। সেটা রাজনীতিকরা/সরকার মানুন বা না মানুন, তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না্, তবে একটা তথ্য আমাকে যেমন চমকে দিয়েছে, তেমনি আপনাদেরও চমকে দেবে, আমার বিশ্বাস।

আমরা ভেতো বাঙালি, আমরা বাঙালি না বাংলাদেশি এই তর্কে রাতদিন কাননা করি। চাষারা সে খবর রাখে না। তারা নিজেদের বলে আমরা কামলাজীবনের মানুষ, কামলা দিয়ে খাই, কামলা দিয়ে ধান বুনি, ধান ফলাই। কিন্তু সেই ধানের বা ফসলের দাম পাই না। কথাটা অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। ধানের উৎপাদন কতোগুণ বেড়েছে তা কি আমাদের মনে আছে?

না নেই, কিন্তু ১৭-১৮ কোটি মানুষ কিন্তু ঠিকই খেয়ে পরে, খেয়ে না পরে, অর্ধাহারে অনিদ্রায় রাত কাটাচ্ছে। এটা সরকার মানবেন না। কিন্তু যারা খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন তারা পরিসংখ্যান ও খাদ্য বিতরণের জরিপ এবং নিরাপদ জীবনের বিষয় নিয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন এবং আমাদের জানান তাদের বিশ্বাস না করলে কি চলে? একটা রিপোর্ট পড়ে আসি, তাহলে ব্যাপারটা পরিষ্কারভাবে বোঝা যাবে।

বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য চাল। মোট আবাদি জমির প্রায় ৭৫ শতাংশেই ধান ফলান কৃষক। তাদের প্রচেষ্টায় উৎপাদনের হারও বেড়েছে আগের চেয়ে বেশি। তবে সেচ, সার ও কীটনাশকসহ প্রায় সব ধরনের কৃষি উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় লাভ কমেছে। ফলে কৃষকের জীবনমান উন্নয়নে সবচেয়ে কম প্রভাব ফেলছে ধান চাষাবাদ। দূর হচ্ছে না দারিদ্র্য। সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে বিভিন্ন ফসল ও প্রাণিসম্পদ-সংশ্লিষ্ট উৎপাদনের সঙ্গে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের হার, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও পরিমিত খাদ্য গ্রহণের হারকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। বিভিন্ন ফসল ও প্রাণিসম্পদ-সংশ্লিষ্ট উৎপাদনের মধ্যে রয়েছে ধান, পাট, কন্দাল ফসল, উদ্যান ফসল, ডাল ও তেলজাতীয় শস্য, মাংস ও দুধ উৎপাদন এবং মৎস্য চাষ।

চলতি বছরের জুলাইয়ে আইএফপিআরআইয়ের ‘বাংলাদেশ এগ্রি ফুড সিস্টেম স্ট্রাকচার অ্যান্ড ড্রাইভার্স অব ট্রান্সফরমেশন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, এক দশকে (২০০৯-১৯) বাংলাদেশে জীবনমান উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে ভুট্টা, পাট, মাংস ও দুধ উৎপাদন। এর পরই রয়েছে কন্দাল ফসল, উদ্যান ফসল, ডাল ও তেল শস্য উৎপাদন এবং মৎস্য চাষ। তবে কৃষকের জীবনমানে সবচেয়ে কম প্রভাব ফেলছে ধান উৎপাদন।

কৃষকের দারিদ্র্য কমিয়ে আনতে বড় ভূমিকা রাখছে ভুট্টার চাষাবাদ। ক্রমান্বয়ে এর পরই রয়েছে কন্দাল ফসল বা আলু উৎপাদন, পাট, তেল ও ডাল শস্য, উদ্যান ফসল, ধান চাষাবাদ, মৎস্য এবং মাংস ও দুধ উৎপাদন। ক্ষুধার হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রেও এগিয়ে আছে ভুট্টা। এরপর ধান, কন্দাল ফসল, তেল ও ডাল শস্য, পাট ও মৎস্য চাষ। তবে এক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রাণিসম্পদ-সংশ্লিষ্ট উৎপাদনের ভূমিকা নেতিবাচক।

গবেষণায় যুক্ত ছিলেন আইএফপিআরআইয়ের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো জিনশেন দিয়াও ও কার্ল পাউ, পরিচালক জেমস থার্লো, জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী অ্যাঙ্গা প্রদেশা ও জোসি র‌্যান্দ্রিয়ামঞ্জি এবং পলিসি মডেলিং ইউনিটের গবেষণা বিশ্লেষক মিয়া এলিস।

রুরাল ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড পলিসি অ্যানালাইসিস (আরআইএপিএ) মডেলে (মোট স্কোর এক ধরা হয়) জীবনমান উন্নয়নে ভুট্টা ও পাটের স্কোর শূন্য দশমিক ৬৫, মাংস ও দুধ উৎপাদন শূন্য দশমিক ৩৯, কন্দাল ফসল শূন্য দশমিক ৩২, উদ্যান ফসল শূন্য দশমিক ৩১, ডাল ও তেলজাতীয় শস্য শূন্য দশমিক ১৯, মৎস্য চাষ শূন্য দশমিক ১৬ এবং ধান উৎপাদনের স্কোর হয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ১২। এছাড়া অন্য প্রাণিসম্পদের স্কোর শূন্য দশমিক শূন্য ৫। (ব.বা ২৮ আগস্ট ২৩)

গরিবি হটানোর সংগ্রামই করি আমরা। সে হোক সরকার কিংবা শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, দোকানদার, কাঁচাবাজারের মুদি বা চাকরিজীবী শিক্ষিত মানুষ। আর উৎপাদক কৃষক, যার যার পরিপ্রেক্ষিত থেকে তারা গরিবি হটানোর কাজে ব্যস্ত। আর সেটা তো স্বাভাবিক? এই স্বাভাবিকতার পথে কোনো রকম জটিলতা নেই। বরং আমাদের ভাবনা হচ্ছে গত ৫৩ বছরে আমাদের বিভিন্ন ধরনের শস্য উৎপাদনে বৈচিত্র্য যেমন এসেছে তেমনি এসেছে চাষীদের কর্মদক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও প্রযোজনকে কাজে লাগানোর প্রচেষ্টা। সেই ক্ষেত্রে তারা সফল।

গবেষণা বলছে আমাদের প্রধান খাদ্য ধান/চাল। ওই ফসল আমরা ৯০ শতাংশ উৎপাদন করি। ৭০ শতাংশ জমিতে ধান ফলান কৃষকরা। এ সাফল্য বগল বাজানোর মতোই উৎসাহজনক। কিন্তু কোন ফাঁকে যে ভুটা আমাদের চাষার জীবনে ঢুকেছে তা বলতে পারবো না। সেই ভুটা আমাদের খাদ্যঘাটতির একটি বড় অংশ সামাল দিচ্ছে। ক্ষুধা নিবারণে রাখছে অবদান। কান্দাল, যা মূলত আলুজাতীয় ফসল উৎপাদনের রীতি ও পদ্ধতি তো বহুকালের, কিন্তু তার প্রয়োজনের বিষয়টি আমরা যারা নগরবাসী সাধারণজন, তারা জানিই না। আমরা কেবল বলতে থাকি গোল আলুর দাম বেড়ে গেলো।

সরকার করেন কি? চালের দাম বাড়লেও আমাদের মুখে ওই একই কথা। তেলবীজ সরিষাকে আমরা পাশে সরিয়ে রেখেছিলাম, সয়াবিনের কারণে। সয়াবিনের তেল নাকি শরীরের জন্য ভালো, তা হালকা, তাই সরিষাকে পাশে সরিয়ে দিয়ে সয়াবিন তেল আমদানিতে মনোযোগী হয়েছি আমরা। অর্থাৎ আমরা আমদানিনির্ভর হয়ে ওঠেছি। এতোদিন পর বিজ্ঞানিরাই বললেন শরীরের জন্য সরিষার তেলই ভালো। তাহলে গত শতকের সত্তরের দশকে যে সব বিজ্ঞানী বলেছিলেন যে সয়াবিন তেল ভালো, তারা কি মিথ্যা বলেছিলেন? হ্যাঁ, তারা অনেকটাই সত্য লুকিয়েছিলেন।

সয়াবিন তেলের উৎপাদক/ব্যবসায়ীদের জন্য বাজার সৃষ্টি করেছিলেন। ওই মিথ্যাই আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক সরকার তেলবীজ সরিষার ওপর আবার জোর দিয়েছেন। আমরা ফিরে যাবো সেই আদি সরিষার ঘ্রাণময় তেলে, যা স্বাস্থ্যসম্মত। নাকি এখানেও একপালা গান আছে। জ্ঞানী বিজ্ঞানীদের ওপর থেকে বিশ্বাস হালকা হয়ে যাচ্ছে।

সন্দেহ দানা বাঁধছে। তারা বিভিন্ন কোম্পানির অর্থে লালিত পালিত হয়ে তাদের পক্ষেই কাজ করেন। তাহলে কি এই যে গবেষণা সংস্থা খাদ্যবিষয়ে আমাদের সচেতন করার প্রয়াস চালাচ্ছেন, আমাদের খাদ্য উৎপাদক কৃষক লাভবান হতে পারছে না ধান উৎপাদন করতে গিয়ে, এই সত্য যদি তাদের কানে যায়, তাহলে তারা ধান উৎপাদন কমিয়ে দিয়ে অন্য লাভবান ফসল উৎপাদনে উৎসাহী হবে।

রুরাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পলিসি অ্যানালাইসিস যে অ্যানালিসিস করেছে, সেখানে কি আমাদের গরিবি হটানোর বিষয় আছে? আমরা প্রায়ই শুনি যে কৃষকেরা তাদের ফসলের ন্যায্যমূল্য পায় না। তাদের ফসল উৎপাদনের যে খরচ তার দাম তারা পায়, তা দিয়ে লাভ থাকে না। এই যে লাভ থাকা না থাকা, এটাই হচ্ছে আসল। ধান উৎপাদন করে যদি পেট চালাতে না পারে, তাহলে তো ওই ফসল উৎপাদনে তাদের উৎসাহ, সাহস থাকবে না।

সেই চিন্তা ধারায় যদি উৎপাদক কৃষককে পেয়ে বসে, তাহলে তো ধান উৎপাদনে ঘাটতি আরও বেড়ে যাবে। এমনিতেই আমাদের ধান উৎপাদনে ঘাটতি আছে ৮-১০ লাখ টন, গম উৎপাদনে ঘাটতি ৬-৭ লাখ টন, অন্যান্য ফসলের উৎপাদনেও আমাদের ঘাটতি আছে। আমরা তো নিত্যদিনই পেঁয়াজ আনি ভারত থেকে। এখন আরও ১৩টি দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির পারমিশন দিয়েছে সরকার। সেই তালিকায় বালু মরুর দেশ কুয়েতও আছে। ভারত পেঁয়াজ রফতানির ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ কর আরোপ করেছে। ফলে আমরা ওই পেঁয়াজ কিনে দেশবাসীকে খাওয়াতে পারবো না। দাম বেশি পড়বে। আবার আমাদের আমদানিকারক ও আড়তদার ব্যবসায়ীদের হাতে এসে সেই পেঁয়াজ আর কাঁচামরিচের দাম কতোটা বেড়েছে, সে কথায় গেলে রাজনৈতিক সরকারের ব্যর্থতার কথাই ওঠে আসবে। সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানোর বিষয়টি এতকাল ছিল গুটিকয়েক আমদানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে, (সয়াবিন তেল, চিনি ইত্যাদি) এখন তা কাঁচামরিচেও ছড়িয়ে পড়েছে। ভারত থেকে আনা কাঁচামরিচের দাম প্রথমদিকে পড়েছিল ২৪-২৫ টাকা। এখন নাকি পড়ে ৮০-৯০ টাকা। ফলে গণমানুষকে সেই পণ্য কিনে খেতে হয় ২০০ টাকা কেজি দরে।

এখন আমাদের কি করা উচিত? আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি দারুণভাবে ভাবাচ্ছে আমাদের। আমরা গম/ভুট্টার উৎপাদনে জোর দিতে পারি। কান্দাল ফসলে আমাদের অগ্রগামিতা বেশ। খাদ্য ডাইভারসিটি সৃষ্টি করতে হলে কোথায় কোথায় কি কি ধরনের উদ্যোগ আয়োজন করতে হবে, সেই জরুরি গবেষণাটি আজ আমাদের দরকার। আমাদের ভূমির পরিমাণ কম, জনসংখ্যা অনেক বেশি। জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করে রফতানি করার বিকল্প নেই। খাদ্যশস্যের নিরাপত্তা এভাবেও সামাল দেওয়া যেতে পারে।

# ০৮/৩০/২৩#

লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/এমএস

খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি দারুণভাবে ভাবাচ্ছে আমাদের। আমরা গম ও ভুট্টার উৎপাদনে জোর দিতে পারি। কান্দাল ফসলে আমাদের অগ্রগামিতা বেশ। খাদ্য ডাইভারসিটি সৃষ্টি করতে হলে কোথায় কোথায় কি কি ধরনের উদ্যোগ আয়োজন করতে হবে, সেই জরুরি গবেষণাটি আজ আমাদের দরকার। আমাদের ভূমির পরিমাণ কম, জনসংখ্যা অনেক বেশি। জনসংখ্যা জনশক্তিতে রূপান্তর করে রফতানি করার বিকল্প নেই।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।