এমটিএফই’র প্রতারণা

ডিজিটাল পকেটমারদের আটকানোর দায়িত্ব কার?

লীনা পারভীন
লীনা পারভীন লীনা পারভীন , কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৯:৫৯ এএম, ২৪ আগস্ট ২০২৩

আমার আম্মার বয়স ৭০ বা তার কিছু বেশি হবে। ফেসবুক নাই কিন্তু ইউটিউবের দর্শক। সম্প্রতি তাকে স্মার্ট ফোন কিনে দেয়া হয়েছে যাতে সন্তান ও বিদেশে থাকা নাতনীদের সাথে ভিডিও কলে বা হোয়াটস অ্যাপে কথা বলতে পারে।

হঠাৎ করে আম্মা জানতে চাইছে মোবাইলে নাকি মাসে ৬,০০০ টাকা আয় করা যায়? আমার মাথায় হাত। জানতে চাইলাম, তুমি কীভাবে জানলা? জানালো সে মোবাইলে আসা বিভিন্ন ভিডিও থেকে জানতে পেরেছে। ততধিক আতকে উঠে জানতে চাইলাম, কোথাও ক্লিক করোনাইতো? বা কারও সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করোনাইতো? করেনাই জেনে নিশ্চিত হলাম।

ঠিক তারপরেই নিউজ লিংক পেলাম MTFE (Metaverse Foreign Exchange Group Inc) নামের এক কোম্পানি কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট করে হাওয়া। এই সংবাদ পড়তে না পড়তেই আমার মোবাইলে মেসেজ এলো Dear Sir/Madam, use your mobile anytime anywhere and earn 2,000 Taka per day as salary. কন্টাক্ট ইনফো হিসেবে একটা লিংক পাঠিয়েছে। প্রতিনিয়ত এমন লোভনীয় অফার দিয়ে আমাদের অলস মস্তিষ্ককে উত্তেজিত করা হচ্ছে।

কেবল টাকা ইনকামই কেন? বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ইন্টারভিউ ছাড়াই চাকরির বিজ্ঞাপন পাচ্ছি আমরা। লিংকডিনে ঢুকলেই দেখা যায় দেশী বিদেশী চেহারার ইউজারদের আইডি থেকে আকর্ষণীয় সব দেশে আকর্ষণীয় বেতনে ভুরি ভুরি চাকরির অফার। পড়লে মনে হবে যেন আরে এতো সুবর্ণ সুযোগ। অভিজ্ঞতা ছাড়া, বিনা বিনিয়োগে বিদেশী কোম্পানিতে চাকরি। হোক আর না হোক, চেষ্টা করতেতো সমস্যা নাই।

কাজ না করে অল্পপুঁজি বা বিনা পুঁজিতে আয় করতে কার না সাধ হয়। কিন্তু সামান্য মগজটুকু ব্যবহার করলেই বুঝা যাওয়ার কথা এতো সহজই যদি সবকিছু হতো তাহলে দেশে কোটি কোটি বেকার থাকতো না। কর্মসংস্থান করতে পারছে না বলে সরকারকে এতো গালি শুনতে হতো না। এমন ফাও আয়ের রাস্তাটুকু খুলে দিলেতো সরকারেরই লাভ।

এখানেই সীমাবদ্ধ নয় মানুষ ঠকানোর গল্প। আজকাল যুক্ত হয়েছে ক্রিপ্টোকারেন্সি নামক নতুন এক ধান্দা। বিদেশে কিছু কিছু দেশে এ ধরণের লেনদেন বা বিনিয়োগ বৈধ বলে গণ্য হলেও বাংলাদেশে এটা এখনও অবৈধ। ক্রিপ্টকারেন্সি হচ্ছে ব্যংকিং এর বিকল্প অর্থাৎ, কাগুজে মুদ্রার বিকল্প হিসেবে ডিজিটাল মুদ্রার ব্যবহার। বিস্তারিত গুগল করলেই জানা যাবে।

এ ধরনের লেনদেন এখনও সিউকিউরিটি দুয়ার পার হতে পারেনি বলেই বিশ্ববাজারে স্বীকৃতি অর্জন করতে পারেনি। চীনের মত দেশে এটাকে ব্যান করা হয়েছে। এই উঠতি আর পড়তির মাঝে বাংলাদেশকে টার্গেট করে এগুচ্ছে কিছু দেশী বিদেশী চক্র। বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বিশ্বের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। কিন্তু এই বিনিয়োগের বেশিরভাগটাই আসছে অবৈধ রাস্তায়। এর অন্যতম উদাহরণ বাংলাদেশ ব্যাংক এর তহবিল পাচার। কোটি কোটি টাকা নিয়ে গিয়েছে বিদেশী পাচারকারীরা।

এই যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, এর ভালো দিক হচ্ছে মানুষের জীবনমান উন্নতি কিন্তু অশিক্ষিত মানুষের হাতে যদি অনাকাঙ্খিতভাবে অনেক টাকা চলে আসে তখন তারা চোখেমুখে লাল রঙ দেখতে থাকে। মানে সেই টাকা ঠিক কোন পথে খরচ করবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার বেলায় যে শিক্ষা থাকা দরকার সেটা নিতে পারেনা আর সেই অর্থেই আমি অশিক্ষিত বলেছি। আশা করি কেউ এর অন্য অর্থ খুঁজতে যাবেন না।

অন্যদিকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কি সবার ঘরে সমান ফল তুলে দিচ্ছে? দিচ্ছে না। বৈষম্য নিচ থেকে উপরের দিকে ক্রমশ বাড়ছে। অর্থাৎ, নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনে যে মাত্রার পরিবর্তন আসছে উচ্চ শ্রেণির আসছে তার চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে। যার ফলে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমছে না। এর সুযোগ নিচ্ছে ফটকা কারবারীরা।

মানুষের মধ্যে ক্রমেই অল্প পরিশ্রমে উপরে উঠার বাসনা বাড়ছে কিন্তু সুযোগ কম আর সুযোগ যা আছে সেখানে অনেক ক্রাইটেরিয়া মেনে চলতে হয়। অত সময় কোথায়? সমাজে বিরাজমান ক্রমবর্ধমান চাহিদা, অর্থনৈতিক উন্নয়নের তুলনায় বৈষম্যের সংখ্যা ও পরিমাণগত পার্থক্যের কারণে জন্মানো হাহাকার (অন্য অর্থে লোভ) অন্যদিকে সরকারের ঘোষিত উদ্যোক্তা হবার প্রকল্প যাকে ইংরেজীতে বলে “স্টার্টাপ বিজনেস” ইত্যাদির সুযোগে বাজারে গজিয়ে উঠছে ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, MTFE এর মত ধোঁকাবাজ কোম্পানি। খেয়াল করে দেখেন, নামের মধ্যে মেটাভার্স ও ইনকর্পোরেশন যুক্ত করে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের রাস্তাকে সহজ করেছে। এর আগে আমরা জেনেছিলাম ডেসটিনি, নিউ ওয়ে ইত্যাদি নামের কোম্পানিগুলো মানুষকে কীভাবে বোকা বানিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল।

মানুষের বোকামি, অতিরিক্ত লোভ আর অল্প পরিশ্রমে বেশি আয়ের স্বপ্ন এগুলোকে উস্কে দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায় নেয়ার উদাসীনতা। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়েছি কিন্তু ডিজিটাল ওয়েভের সাথে যেসব ক্ষতিকর ময়লা আবর্জনা আসবে সেগুলোকে আটকানোর কোন ছাকনী বসাইনি আমরা। না সিস্টেমে না মানুষের মগজে কোথাও কোন প্রাতিষ্ঠানিক মেকানিজম বসানো হয়নি এখনও। ফলাফল বারবার ধোঁকা খাওয়ার পরেও সাধারণ মানুষকে এসব থেকে আটকানো যাচ্ছেনা।

এমন ধোঁকাবাজি কি এরপরেও বন্ধ হয়ে যাবে? মানুষ কি আবারও ধরা খাবেনা? এর কোনোটারই পরিবর্তন হবে না যদি না সরকার সকল গেটওয়েতে গেটকিপার বসায়। পাহাড়াদার বসাতে হবে শক্ত করে। তথ্য বা টাকা কোনটাই যেন কেউ চাইলেই সহজে হাঁকিয়ে নিতে না পারে সেই দিকটাকে দিতে হবে সর্বোচ্চ প্রাধান্য।

একদিকে মানুষকে শিক্ষিত করতে হবে বৈধ পথে আয়ের চিন্তা করতে অন্যদিকে ডিজিটাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে যাতে কোনো ধান্দাবাজ বা সুযোগ সন্ধানী আমাদের দেশ বা দেশের মানুষের পকেট কেটে নিতে না পারে সেই ব্যবস্থাটা করাও সরকারের দায়িত্ব।

লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, কলামিস্ট।

এইচআর/এএসএম

একদিকে মানুষকে শিক্ষিত করতে হবে বৈধ পথে আয়ের চিন্তা করতে অন্যদিকে ডিজিটাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে যাতে কোনো ধান্দাবাজ বা সুযোগ সন্ধানী আমাদের দেশ বা দেশের মানুষের পকেট কেটে নিতে না পারে সেই ব্যবস্থাটা করাও সরকারের দায়িত্ব

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।