অতঃপর লবিং এর ফল দাঁড়ালো কি?

মোস্তফা হোসেইন
মোস্তফা হোসেইন মোস্তফা হোসেইন
প্রকাশিত: ১০:০১ এএম, ২৩ আগস্ট ২০২৩

বাংলাদেশের রাজনীতি বিদেশি প্রভাবমুক্ত এমনটা বলার সুযোগ কম। অধিকাংশ উন্নত দেশই পরোক্ষভাবে হলেও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের সংশ্লিষ্টতা অনেক সময়ই স্পষ্ট হয়ে যায়, তারা বাংলাদেশকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী চালানোর চেষ্টা করে। এই চেষ্টা শুধু আজই নয়। একাত্তরে পৃথিবীর দুই ধারার রাজনৈতিক বলয়ই নিজেদের মতো বাংলাদেশকে পেতে পরোক্ষ প্রতিযোগিতায় নেমেছিলো, যা পরবর্তীকালেও অব্যাহত থাকে।

হাল আমলে বাংলাদেশের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হওয়ার পর তাদের চেষ্টাগুলো আরও স্পষ্ট হতে থাকে। বিশেষ করে নির্বাচন ঘনিয়ে এলে তারা অধিকতর সক্রিয় হয়। বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তারা নড়েচড়ে বসেছে। রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের কাছে ধরনা দিচ্ছে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাই বিদেশিদের সমর্থন কোন দিকে কতটা সেটাও রাজনৈতিক হিসেবে যুক্ত হয়ে পড়েছে।

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র একদিকে, অন্যদিকে ভারত, চীন, রাশিয়া স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে। চলতি মাসের আগেও ভারতের অবস্থান ছিল অস্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক মহলে রমরমা আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়। বিরোধী মহল তাদের অর্জন কিংবা তাদের পক্ষে বিদেশি মতামত হিসেবে তাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। একইসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আগের মতোই বিদেশমুখী হওয়ার প্রতিযোগিতা তৈরি হয়। একদল সকালে বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে যায় তো আরেকদল যায় বিকেলে। এমন অবস্থা বেশ কিছুদিন ধরে চলতে থাকে। একইসঙ্গে বিদেশে প্রতিনিধি প্রেরণ এবং লবিস্ট নিয়োগের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টাও সংবাদ মাধ্যমে জানা যায়।

রাজনৈতিক দলগুলোর এহেন কর্মকাণ্ডে গণমাধ্যমগুলোও উৎসাহিত হয়। তারাও রাজনৈতিক সংবাদ হিসেবে বিদেশি কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপগুলো প্রকাশ করতে থাকে। সংবাদগুলো কৌতূহল জাগানোর মতোও।

সম্প্রতি ভারত বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন সম্পর্কে বার্তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে। যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়ে দিয়েছে ভারতের কাছে প্রতিবেশী বাংলাদেশে বিএনপি সরকার গঠন করলে সন্ত্রাসী সংগঠন জামায়াতে ইসলামির মতো বিভিন্ন দাঙ্গাবাজ সংগঠন আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, যা ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র কারও জন্যই শুভ হবে না। এই বার্তা মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন বিষয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছে।

এতদিন যারা মনে করেছিলেন ভারত হয়তো চুপ থাকবে তাদের ভুল সংশোধন হয়ে গেলো এর পর থেকে। এর পেছনে অবশ্য যুক্তিও আছে। যারা মনে করেন, সন্ত্রাসী জামায়াত সম্পর্কে ভারতের এই বার্তা, তাদের উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি ও বাংলাদেশের সহযোগিতার অতীত দেখতে হবে। দেখতে হবে ১০ ট্রাক অস্ত্রের বিষয়টিও। একইসঙ্গে দেখতে হবে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে দমনে শেখ হাসিনা সরকারের আন্তরিকতার বিষয়টিও। ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কারা মদত দিতো কীভাবে পাকিস্তানি সহযোগিতায় ভারতে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা হয়েছে, সেগুলো ভারত জানে। সুতরাং ভারত কোন দিকে যাবে সেটা তার স্বার্থ চিন্তা করেই ঠিক করবে।

ভারতের পর্যবেক্ষণ অবশ্যই আছে। তাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে, কে বাংলাদেশের ক্ষমতায় এলে তাদের কী অবস্থা হবে। মাত্র কয়েক বছর আগে সম্ভবত ২০১৮ সালে বিএনপি ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেছিল। তাদের সিনিয়র নেতাদের কয়েকজন দিল্লির দরবারে গিয়ে ধরনাও দিয়েছিল। সে সময় তারা প্রয়োজনে জামায়াত সঙ্গ ত্যাগ করবে বলেও ঘোষণা করেছিল। বাস্তবতা ভিন্নতর। এই কয় বছরে জামায়াতের সঙ্গে তাদের যে বন্ধন তা মোটেও হালকা হয়নি। জামায়াতকে নিয়ে তাদের যে জোট সেই জোটও বহাল আছে এবং জামায়াতকে সঙ্গে নিয়েই। সুযোগ বুঝে কখনো কখনো বলে জামায়াত তাদের নির্বাচনী জোটের সঙ্গী মাত্র। কিন্তু তাদের ২৭ দফার বড় দফায় বলা আছে, বিজয়ী হলে তারা জোটসঙ্গীদের নিয়ে সরকার গঠন করবে। তার মানে তারা বিজয়ী হলে আবারও জামায়াতিদের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা তুলে দেওয়ার রাস্তা ক্লিয়ার করে রেখেছে। এমতাবস্থায় ২০১৮ সালের বক্তব্যকে কি তারা দশ হাত দূরে ঠেলে দিলো না? এমতাবস্থায় ভারতের সমর্থন তারা পাবেন না এটা স্বাভাবিক। যার প্রতিফলন দেখা গেছে।

এদিকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সরকারি দলকে বিপাকে ফেলেছে এমন প্রচারণা বাংলাদেশের বিরোধী মহল থেকে ঢালাও প্রচার হচ্ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এ নিষেধাজ্ঞা প্রকৃতপক্ষেও শাসকদলের সামনে একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল। কিন্তু বিরোধী দল এটাকে নিয়ে মোটামুটি ভালো অবস্থানও তৈরি করতে পেরেছিল। কিন্তু যে মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বলা হলো, কেউ যদি নির্বাচনী পরিবেশ বিঘ্নিত করে তাহলে আগামীতে তারও ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে একটু অতীতের ছোঁয়া লেগে যায়।

অগ্নিসন্ত্রাস, ভোটকেন্দ্রে হামলা, পুড়িয়ে দেওয়া, প্রিসাইডিং অফিসার খুন করার মতো ঘটনাগুলো প্রামাণ্য দলিল হিসেবে চলে আসে। সেক্ষেত্রে বলা যায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর যে অবস্থা হয়েছিল শাসকদলের, পরের ঘোষণা বিরোধী দলকেও দুশ্চিন্তায় ফেলে। এগুলো অভ্যন্তরীণ বিষয়। তবে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মাথা গলানোর সুযোগ যে আমাদের রাজনীতিবিদরাই করে দিয়েছেন তা স্পষ্ট।

শাসকদলকে পাকে ফেলার জন্য বিএনপি বিদেশিদের কাছে ধরনা দিয়েছে, আবার শাসকদলও তার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে বিদেশিদের সুযোগ দিয়েছে, এটা অস্বীকার করার উপায় কি? দেখার বিষয় হচ্ছে কে কতটা আশ্বাস পেয়েছে। শাসকদলের মানসিকতা চীনপন্থি নয়। এটা সবসময়ই বলা হয়। অন্যদিকে বিরোধী দল বিএনপির জন্মলগ্নে চীনপন্থি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গীদের যুক্ত করতে পারায় স্বাভাবিকভাবে চীনের সমর্থন তাদের পাওয়ার কথা। কিন্তু পরিস্থিতি তেমন নয়। ভারতের প্রতিপক্ষ চীনকেও বাংলাদেশ দক্ষতার সঙ্গে হেন্ডেল করেছে।

এমনটা বলার সুযোগ নেই শাসকদলের জোটসঙ্গী কয়েকটি দলের নেতার চীন সফরের কারণে বর্তমান শাসকদলের সঙ্গে চীনের সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছে। আগামী নির্বাচন ও বাংলাদেশের রাজনীতি বিষয়ে যখনই যুক্তরাষ্ট্র কিছু বলেছে, কাউন্টার বক্তব্য চীন থেকে এসে গেছে বিলম্ব না করে। রাশিয়ার মতো চীনও বলেছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র মাথা ঘামাচ্ছে কেন?

ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে একটি দলের লবিং প্রচেষ্টার বিষয়টি। কিন্তু বিনিময় কি খেয়াল করা দরকার বলে মনে করি। কিন্তু লবিংয়ের ফল তাদের জন্য কতটা সুখকর? সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশ ককাসের নতুন সদস্য কংগ্রেসম্যান অ্যান্ড্রু গারবারিনো মন্তব্য করেছেন, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিগত ১৪ বছর ধরে বাংলাদেশে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ দমনেও বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকার প্রশংসা করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে মত দিয়েছেন মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশ ককাসের নতুন সদস্য কংগ্রেসম্যান অ্যান্ড্রু গারবারিনো’ (যুগান্তর ১৯ আগস্ট,২০২৩)

চীন রাশিয়াসহ কয়েকটি দেশের মন্তব্যের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বলেছে, তারা বাংলাদেশের নির্বাচন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। তাহলে লবিংয়ের ফল কি দাঁড়ালো।

এর মধ্যে ২২ আগস্ট শেখ হাসিনার দক্ষিণ আফ্রিকায় যাওয়ার কথা ব্রিকসের সম্মেলনে যোগ দিতে। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণে তিনি সেখানে যাচ্ছেন। ওখানে অবস্থানকালে একাধিক সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হওয়ার কথা। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সেখানে দেখা না হলেও সেপ্টেম্বরে নতুন দিল্লিতে জি-২০ এর সম্মেলনে তিনি নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠক করবেন বলে কথা রয়েছে। তবে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠকে তিনি কিছু চাওয়ার আগেই ভারত তাদের মনোভাব প্রকাশ করে দিয়েছে। সুতরাং এবার যদি কিছু বলতেই হয় তাহলে তিনি নরেন্দ্র মোদীকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে পারেন।

বৈদেশিক যোগাযোগ এবং বৈদেশিক সমর্থন বিশ্লেষণ করলে আরও চোখে পড়বে, শেখ হাসিনার সরকার বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্র নীতিকে দক্ষতার সঙ্গে প্রয়োগ করতে পেরেছে। ভারতের সঙ্গে চীনের বৈরী সম্পর্ক হওয়ার পরও চীনকে বাংলাদেশ তার বন্ধু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। আবার চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক থাকার পরও দুটি দেশের মধ্যেই সুসম্পর্ক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। প্রতিটি দেশই বাংলাদেশে রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা চায় দেশটির উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার প্রয়োজনে।

আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, সরকারবিরোধী লবিং এবং ধরনা দেওয়ার ফল ধরনাধারীদের পক্ষে যায়নি। গেছে উন্নয়নের পক্ষে এবং বাংলাদেশের অনুকূলে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চালে কোন দল কাকে ঘায়েল করবে তার ওপর নির্ভর করে জনমতের পাল্লা কার দিকে ভারী হবে কতটা। দেশের মানুষ নিশ্চয়ই চোখে দেখা উন্নয়নকে উপেক্ষা করবে না। নিশ্চয়ই তারা আগামীতে কোনো ১৫ আগস্ট কিংবা ২১ আগস্ট ঘটার কোনো মাধ্যমকে স্বাগত জানাবে না। কোনদিকে কে যায়, বছর শেষ হওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক, গবেষক, কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/এএসএম

সরকারবিরোধী লবিং এবং ধরনা দেওয়ার ফল ধরনাধারীদের পক্ষে যায়নি। গেছে উন্নয়নের পক্ষে এবং বাংলাদেশের অনুকূলে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চালে কোন দল কাকে ঘায়েল করবে তার ওপর নির্ভর করে জনমতের পাল্লা কার দিকে ভারী হবে কতটা। দেশের মানুষ নিশ্চয়ই চোখে দেখা উন্নয়নকে উপেক্ষা করবে না। নিশ্চয়ই তারা আগামীতে ১৫ আগস্ট কিংবা ২১ আগস্ট ঘটার কোনো মাধ্যমকে স্বাগত জানাবে না। কোনদিকে কে যায়, বছর শেষ হওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।