গণমিছিল থেকে গণভবন কত দূর?
বাংলাদেশে দুটি ভবন আছে গুরুত্বপূর্ণ, ক্ষমতার কেন্দ্র বলা যায়। ঐতিহ্যবাহী বঙ্গভবন রাষ্ট্রপতির অফিসিয়াল বাসভবন, আর গণভবন প্রধানমন্ত্রীর। রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার হলে বঙ্গভবন হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ, ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। আর সংসদীয় পদ্ধতির সরকারে গণভবন হয়ে ওঠে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। তবে হিসাবটা সবসময় এত সরল নয়।
বাংলাদেশের সব রাষ্ট্রপতি যেমন বঙ্গভবনে থাকেননি, তেমনি সব প্রধানমন্ত্রীও গণভবনে থাকেননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ও ধানমন্ডির ৩২ নাম্বারের অরক্ষিত সাধারণ বাসায় থাকতেন। জীবন দিয়ে যার মূল্য দিতে হয়েছে তাঁকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর হুট করেই বঙ্গভবন হয়ে ওঠে ক্ষমতার কেন্দ্র, ক্ষমতা নয় আসলে ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র।
খন্দকার মোশতাককে সামনে রেখে খুনিরা বঙ্গভবনে বসেই সারাদেশের ওপর ছড়ি ঘোরাতো। যদিও তাদের অপতৎপরতা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ৭৫এর ৭ নভেম্বর পালাবদলের পর বঙ্গভবন ছিটকে পড়ে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে। এরপর জিয়াউর রহমান ও এইচ এম এরশাদ দীর্ঘদিন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বা রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশ শাসন করলেও তারা কখনো বঙ্গভবনে থাকেননি। ক্যান্টনমেন্টের নিরাপদ বেষ্টনীতে থেকেই তারা দেশ শাসন করেছেন।
বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির ৩২ নাম্বারের সাধারণ বাড়িতে থাকলেও অফিস করতেন গণভবনে। তাঁর দিনের বড় একটা সময় কাটতো গণভবনে। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার ২১ বছর পর জনগণের রায় নিয়ে ক্ষমতায় আসেন তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি তাঁর পিতার স্মৃতিবিজড়িত গণভবনকেই বেছে নিলেন থাকার জন্য। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন সত্যিকার অর্থেই হয়ে উঠলো প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন। বেগম খালেদা জিয়াও তিন মেয়াদে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু তিনিও কখনো প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে থাকেননি। স্বামী জিয়াউর রহমানের মত তিনিও ক্যান্টনমেন্টের বাসায় থেকেই দেশ শাসন করেছেন।
শুরুতে যেমনটি বলেছি, বঙ্গভবন রাষ্ট্রপতির অফিসিয়াল বাসভবন আর গণভবন প্রধানমন্ত্রীর অফিসিয়াল বাসভবন হলেও, পুরো বিষয়টি নির্ভর করে ব্যক্তির ওপর। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে ক্ষমতার বিকল্প কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বনানীর হাওয়া ভবন। তখনকার প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান হাওয়া ভবনে বসেই দেশ ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন।
হঠাৎ বঙ্গভবন, গণভবন, হাওয়া ভবন নিয়ে বিশ্লেষণের কারণ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের একটি বক্তব্য। বিএনপি এখন সরকার পতনের একদফা আন্দোলন করছে। অনেকদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে গেলেও গত ১২ জুলাই নয়াপল্টনের এক সমাবেশ থেকে সরকার পতনের একদফা আন্দোলন শুরু করে। একদফা ঘোষণার পর জুলাই মাসেই পদযাত্রা, মহাসমাবেশ, অবস্থান কর্মসূচি পালন করে বিএনপি।
সমাবেশ, মহাসমাবেশ, পদযাত্রায় বিপুল লোক সমাগম হলেও অবস্থান কর্মসূচিতে এসে তারা হোঁচট খায়। অবস্থান কর্মসূচির ব্যর্থতার পর একদফার আন্দোলনে বিরতি দিয়েছিল বিএনপি। ১৩ তিন পর গত শুক্রবার আবার গণমিছিল নিয়ে মাঠে নেমেছে বিএনপি। সমাবেশ, পদযাত্রা, মহাসমাবেশে বিপুল লোকসমাগম বিএনপিকে দারুণ আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল। এই আত্মবিশ্বাসের ফাঁদেই আটকে যায় বিএনপি। মহাসমাবেশে সারাদেশ থেকে লোকজন এসেছিল।
বিএনপির আশা ছিল, সারাদেশ থেকে আসা লোকজনকে ঢাকায় রেখে আন্দোলন অব্যাহত রেখে সরকারের ওপর প্রবল চাপ তৈরি করা। সে কারণেই মহাসমাবেশ থেকেই পরদিন রাজধানীর প্রবেশপথগুলোতে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এই অবস্থান কর্মসূচি তাদের আন্দোলনের সমন্বয়হীনতার বড় উদাহরণ হয়ে আছে। বিপুল লোকসমাগম দেখে তাৎক্ষণিক উত্তেজনায় পরদিনই অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দেয়া হয়। যুগপত আন্দোলনে থাকা বিএনপির অন্য সহযোগী দলগুলোও অবস্থান কর্মসূচি সম্পর্কে কিছুই জানতো না। এমনকি বিএনপির স্থায়ী কমিটির অনেক সদস্যও এ কর্মসূচি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। তারওপর বিএনপি এ কর্মসূচির জন্য পুলিশের অনুমতিও পায়নি।
সব মিলিয়ে একেবারে অপ্রস্তুত অবস্থায় অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। কিন্তু মাঠে নেমে দেখা গেল অবস্থান নেয়ার মত নেতাকর্মী নেই। আগের দিনের মহাসমাবেশে আসা লাখো লোক রাতের মধ্যেই রীতিমত হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। কর্মী তো দূরের কথা, নির্ধারিত নেতারাও নির্ধারিত স্থানে ছিলেন না। গয়েশ্বর রায় ও আমানউল্লাহ আমান পুলিশের সঙ্গে বিতন্ডায় জড়িয়ে কর্মসূচির মুখরক্ষা করেন। কিন্তু সরকার কৌশলে তাদের নিয়েও দলের মথ্যে সন্দেহ সৃষ্টি করে ফেলে।
অবস্থান কর্মসূচির ব্যর্থতা একদফার আন্দোলন নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে বিএনপিকে। দায়িত্ব পেয়েও যারা পালন করেননি, তাদের ব্যাপারে বেশ কঠোর অবস্থানে যায় বিএনপি। পদ হারান ছাত্রদলের সভাপতি। টানা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কৌশল থেকে পিছু হটে বিএনপি। ফলে ১৩ দিনের বিরতি দিয়ে আবার গণমিছিল নিয়ে মাঠে নেমেছে তারা। বিএনপির আন্দোলন করার সক্ষমতা নেই, বিএনপির জনসম্পৃক্ততা নেই- এসব অভিযোগ তারা ভুল প্রমাণ করেছে আগেই। এখন আন্দোলন শান্তিপূর্ণ রেখে পরিণতির দিকে এগিয়ে নেয়াটাই বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য প্রয়োজন কৌশলী হওয়া ও পরিপক্কতার পরিচয় দেয়া।
বিএনপি গণমিছিল থেকে গণভবনে পৌঁছাতে চায়, ভালো কথা। এটাই তাদের চাওয়া। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছাতে হলে আগে দূরত্ব মাপতে হবে। গণমিছিল থেকে গণভবনের দূরত্ব কতো বুঝতে হবে, গন্তব্যের পথ কতটা বন্ধুর, পথে বাধা এলে কীভাবে তা টপকাবে; তাও ঠিক কররে রাখতে হবে। পৌঁছাতে চাইলেই সব জায়গায় পৌঁছানো যায় না সবসময়।
শুক্রবারের গণমিছিলে দেয়া বক্তব্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমাদের দফা এক, দাবি এক—এই সরকারের পদত্যাগ। শেখ হাসিনাকে গণবিদায় করতে হবে। ওই গণভবনে পৌঁছাতে হবে, বঙ্গভবনে পৌঁছাতে হবে।’ মির্জা ফখরুলের লক্ষ্য খুব পরিষ্কার- ক্ষমতায় যেতে হবে। গণভবন ও বঙ্গভবন এখানে প্রতীকী, ক্ষমতায় যাওয়াটাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু কীভাবে বিএনপি সেই লক্ষ্যে পৌঁছাবে, সেটা এখনও পরিষ্কার নয়। কীভাবে তারা সরকারকে গণবিদায় করে গণভবনে পৌঁছাবেন, সেটা স্পষ্ট করে বলতে হবে।
প্রথম কথা হলো, বিএনপি যে একদফার আন্দোলন করছে, তার পরিণতি কী? এখন পর্যন্ত আন্দোলনে তারা সরকারের ওপর পদত্যাগ করার মত প্রবল চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি। খুব শিগগিরই আন্দোলনকে সেই মাত্রায় পৌছে নেয়ারও কোনো রোডম্যাপ নেই। ২০১৩, ১৪, ১৫ সালে এরচেয়ে অনেক প্রবল ও সহিংস আন্দোলন করেও তারা সরকারকে টলাতে পারেনি। এবার তাদের মূল ভরসা বিদেশী চাপ। আবার বিদেশীদের তৎপরতায় সরকার যেমন চাপে আছে, বিপাকে আছে বিএনপিও।
বিদেশীদের চাপের কারণেই আন্দোলনকে সহিংস পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ারও সুযোগ নেই। আবার সহিংস আন্দোলনে গেলে মার্কিন ভিসা নীতি প্রয়োগ হতে পারে তাতের ওপরও। একদফার আন্দোলনে গিয়ে বিএনপি আসলে নিজেরাই নিজেদের পাতা ফাঁদে আটকে গেছে। সরকার যদি বিএনপির দাবি মেনে পদত্যাগ না করে, তাহলে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, তার কোনো পরিস্কার ব্যাখ্যা নেই। আবার সরকার পদত্যাগ করলে কাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে, নির্বাচন হবে কাদের অধীনে; তারও কোনো ব্যাখ্যা নেই।
সময় কিন্তু দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। নভেম্বরেই আগামী নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা হয়ে যাবে। এরমধ্যে বিএনপি যদি তাদের একদফা দাবির ফয়সালা করতে না পারে, তাহলে কী হবে? সরকার যদি বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যায় এবং বিদেশীদের চাওয়া অনুযায়ী অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করে; তাহলে বিএনপির করণীয় কী হবে? সবসময় আন্দোলনের নানা কৌশল আগে থেকেই ঠিক করে রাখতে হয়। প্রয়োজনে কিছু কৌশল ঘোষণাও করতে হয়, যাতে মানুষ বিভ্রান্ত না হয়।
বিএনপি গণমিছিল থেকে গণভবনে পৌঁছাতে চায়, ভালো কথা। এটাই তাদের চাওয়া। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছাতে হলে আগে দূরত্ব মাপতে হবে। গণমিছিল থেকে গণভবনের দূরত্ব কতো বুঝতে হবে, গন্তব্যের পথ কতটা বন্ধুর, পথে বাধা এলে কীভাবে তা টপকাবে; তাও ঠিক কররে রাখতে হবে। পৌঁছাতে চাইলেই সব জায়গায় পৌঁছানো যায় না সবসময়।
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/জেআইএম