নারী কিছুতেই আটকায় না, আটকানো হয়

জব্বার হোসেন
জব্বার হোসেন জব্বার হোসেন , সাংবাদিক, কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৭:৫৩ পিএম, ১২ আগস্ট ২০২৩

একবার বিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, একই সঙ্গে বাবা এবং মা দুটোই হওয়া যায় কি না? আবেদ চৌধুরী অনেক বড় জেনেটিক বিজ্ঞানী। অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন, গবেষণা করেন। তিনি আমার প্রশ্নে খুব বিস্মিত হয়েছিলেন। বললেন, কি বলছেন আপনি? বললাম, সেলফ্ ফার্টিলাইজেশন। তিনি আরও বিস্মিত হয়ে বললেন, যেমন? বললাম, হাইড্রাতে যেমন হয়, আবার অনেক ফুল নিজেই নিজেকে নিষিক্ত করে। নিজের সঙ্গে নিজে। বললেন, তা হয়, কিন্তু মানুষের মতো উন্নত জীবের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। মানুষের বায়োমেকানিক্স ভিন্ন। এখানে বাবা এবং মা আলাদা আলাদা। আর নারী কেবল মাত্র মা হতে পারে, সন্তান ধারণ এবং জন্ম দিতে পারে।

মানুষের জন্ম সত্যিই এক বিস্ময়। কি করে মাতৃগর্ভে একটি ভ্রণ দিন মাস পার করে মানব শিশুতে রূপ নেয়, পরিণত হয় তা ভাবনারও অতীত। তা কেবল মাত্র মহান স্রষ্টা আল্লাহ্ তায়ালাই জানেন। তার এক অপার মহিমা। আর এই মহিমা ধারণের গুণ, যোগ্যতা, ক্ষমতা মহান সৃষ্টিকর্তা কেবল নারীকেই দিয়েছেন। মাতৃগর্ভের স্মৃতি আমাদের মনেও থাকে না, সে আরেক জীবন! জন্মের পর আরেক নতুন যাপন।

নারীর এই যে গুণ, যোগ্যতা, ক্ষমতা তা বিস্ময়ের চেয়েও বিস্ময়কর। এই সক্ষমতা, ধৈর্য, সাহসিকতা আর কাউকে দেয়া হয়নি। কোন পুরুষকে যদি ভাবতে বলা হয়, মা হবার কথা সে রীতিমত জ্ঞান হারাবার উপক্রম হবে। আমি তো ভাবতেও পারি না, কি করে একজন নারী দিন মাস পার করে সন্তান ধারণ করে, আবার সে তার সকল স্বাভাবিক কাজকর্মও করে। শুধুমাত্র মেয়েদের পক্ষে, মায়েদের পক্ষেই সম্ভব জগতে। এমন কি যে নারী মা হয়নি বা কোন কারণে যার মা হওয়া হয়ে উঠেনি, সেও কিন্তু একই মানসিক যোগ্যতা রাখে, প্রস্তুতি থাকে, মেয়ে হবার কারণে।

ফলে প্রতিটি নারী জগতের শ্রেষ্ঠতম সক্ষম, সামর্থ্যবান, ক্ষমতাবান মানুষ-আমার বিবেচনায়। ফলে নারী কীসে আটকায়? বলে যারা উত্তর খোঁজায় ব্যস্ত, তাদের ব্যস্ততা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে শেষ পর্যন্ত।

সবচেয়ে বড় কথা, এই ক্ষেত্রে প্রশ্ন তোলাটাই নেহাত অমূলক। নারী কিছুতেই আটকায় না। জন্মগত ভাবে সে মুক্ত, স্বাধীন, নিজের মতো। তাকে বরং বিভিন্নভাবে আটকানোর কৌশল খোঁজে পুরুষতন্ত্র। কখনো তারা আটকাবার এই কৌশলের নাম দেয় রাষ্ট্র, কখনো নাম দেয় সমাজ, কখনো নাম দেয় ধর্ম, কখনো নাম দেয় সংস্কৃতি-রীতি। যখন যেমন নাম দিলে সুবিধে তাদের। বলে রাখা ভালো, ধর্মও নারীকে আটকায়নি। এমনকি ইসলামও নয়।

বরং প্রকৃত ইসলাম ও মোল্লাতন্ত্র যে এক নয় তা বোঝা জরুরি। ইসলামে বলা হয়েছে, পর্দা নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু কোথাও কি শুনেছেন কেউ, পুরুষের পর্দার কথা? কোনো আলোচনা বা কোথাও? আর এই পর্দারও অনেক ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, পরিস্থিতি, প্রেক্ষাপট রয়েছে। শুধু হাত মোজা, পা মোজা আর হেজাবে মুখ ঢাকার অর্থ পর্দা নয়। পর্দার অর্থ আরো অনেক বড়, উন্নত মানসিকতার এক আধ্যাত্ম।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা জাস্টিন ট্রুডো বা বিলগেটসের ডিভোর্স নিয়ে তামাশা করছেন, ট্রল করছেন, ‘বউ চলে গেছে’ বলে তাদের নিয়ে হাস্যরস করছেন, তারা বোকা।

ডিভোর্সের কোনো বয়স নেই। বিয়ের পরদিনও হতে পারে আবার বয়স যখন ৭৫ তখনও হতে পারে। সভ্য মানুষের প্রচুর মিচ্যুয়াল ডিভোর্সের উদাহরণ রয়েছে। এখানে কেউ কাউকে ছেড়ে চলে যাওয়া নয়। দুজন দুজনের মতো ভদ্রভাবে সরে যাওয়া। অসভ্য, অভদ্র, ইতররাই দেখবেন জুতো ছোড়াছড়ি করে, গালাগালি করে, দুর্নাম রটিয়ে, চারিত্রিক দোষ দিয়ে আবার একসময়ে বসবাস করে। আবার তাদের ঘরে নতুন সন্তান হয়। নিজেদের প্রতি সম্মান না থাকলে এই একত্রেবাস আসলে দুঃসহবাস। যে কোনো মূল্যে এক ছাদের নিচে দুজনের থাকাটা তখন আর কোনো অর্থ অনুবাদ করে না।

আর একটি কথা মনে রাখা আবশ্যক, যে মেয়েদের দেখে আপনারা অভ্যস্ত, সব মেয়ে সেই একই ধরনে গড়া নাও হতে পারে। ফলে সব মেয়েকে একই ‘গ্রামারে’ ফেলা যাবে না।

কোনো মেয়েতো সামান্য লিপস্টিকেও আটকায়, কোন মেয়ে গাড়ি নয়, নেহাত গাড়ির লিফট বা পিক অ্যান্ড ড্রপ নেয়াতে, কোনো মেয়ে ট্রিট পেতে, কোন মেয়ে স্ক্রিনে চেহারা দেখাতে, কোনো মেয়ে হয়তো ‘ইনক্রিমেন্ট’ বাড়াতে আটকায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে মেয়েরা আটকে যায় পুরুষতন্ত্রের ফাঁদে। আটকে গিয়ে নিজেও হয়ে উঠে পুরুষতান্ত্রিক। এই বলয় থেকে, ফাঁদ থেকে কেবল সাহসী আর আত্মসম্মানে দীপ্ত মেয়েদেরই মুক্তি মেলে। পুরুষকে যেমন ঢালাও ভাবে ‘পুরুষ মানেই লম্পট’ এমন বলা যাবে না। বলাটা অসভ্যতা, তেমনি যে কোনো মেয়েকে উদ্দেশ্য করে, ‘নারী কীসে আটকায়’ বলাটাও অন্যায়।

প্রতিটি মানুষ আলাদা, মানুষের সম্মানবোধ আলাদা। যাপন, বিশ্বাস, আদর্শ ভিন্ন। জীবনবোধ নিজের মতো। যার যার দায়, নিজের দায়িত্বও তাই। সব মেয়ে নিশ্চয়ই লোভী নয়, রক্ষিতা নয়, উপপত্নী নয়, যৌনদাসী নয়। সবার সেই রুচিও নেই। কিছু থাকলেও নেই, না থাকলেই নেই।

ঐ যে রাস্তার ধারে, মোড়ে টং দোকান করে সুফিয়া, সালমা, নাজমা, রহিমারা তাদের দিকে তাকান। রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে, মাথা উচু করে সততার সঙ্গে শ্রম দিয়ে যাচ্ছে, উপার্জন করছে নিজের যোগ্যতায়; তারা কিছুতেই আটকায় না, আপনি চাইলেও আটকাতে পারবেন না।

লেখক: সম্পাদক, আজ সারাবেলা। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডট কম, যুক্তরাষ্ট্র।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।