আন্দোলনের চাইতে বিদেশি চাপে ভরসা বেশি?
ইমরান খানকে দেশটির প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে অপসারণ করতে চাপ দিয়েছিল মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক নিউজ আউটলেট দ্য ইন্টারসেপ্ট পাকিস্তানের ফাঁস হওয়া একটি সরকারি নথি সাইফার-এর বরাতে দিয়ে এই খবর প্রকাশ করেছে। ইমরান খান নিজেও বলেছিলেন তাকে সরাতে চায় আমেরিকা এবং এ জন্য যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করছে।
গোপনীয় সেই নথিতে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তা দক্ষিণ ও মধ্য-এশিয়াবিষয়ক ব্যুরোর সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু এবং তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আসাদ মাজিদ খান মধ্যে বৈঠকের বিবরণ রয়েছে। এতে দেখা যায় ডোনাল্ড লু কীভাবে ইমরান খানকে উৎখাতে চাপ দিয়েছিলেন এবং বিনিময়ে ছিল ইসলামাবাদের সাথে উষ্ণ সম্পর্কের প্রতিশ্রুতি এবং সেটা না করলে পাকিস্তানকে একঘরে করে রাখার হুমকিও।
এই খবরটি এমন সময়ে ফাঁস হলো যখন বাংলাদেশের অব্যন্তরীণ রাজনীতি ও অন্যান বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপ অনেক দৃশ্যমান। ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস একাধিক বৈঠিক করছেন বিরোধী ও সরকারি দলের সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্র থেকেও আসছেন একাধিক ব্যক্তি।
এখন আন্দোলনের মাঠে সক্রিয় বিএনপি এবং সমমনা চলগুলো। তবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলগুলো সব চেয়ে আছে বিএনপির দিকে। এরই মধ্যে সরকার পতনের যে এক দফা আন্দোলন শুরু করেছে তার চূড়ান্ত পর্যায়ের প্রথম পর্ব শেষ হয়েছে যা গত ১২ জুলাই শুরু হয়েছিল। মাঠের আন্দোলনে থাকলেও বিদেশি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের চাপকেই ভরসা মনে করছে বিএনপি। দল ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের নিয়মিত ব্রিফিং-এ একজন দলীয় সাংবাদিক প্রেরণ করে প্রতিদিন বাংলাদেশ বিষয়ে সরকার বিরোধী প্রশ্ন করছে এবং মার্কিন কর্মকর্তাদের মুখ থেকে সরকার বিরোধী সংবাদ সৃষ্টি করছে।
‘বিশৃঙ্খলা’ সৃষ্টি করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারী থাকলেও বিএনপির কর্মসূচির বিষয়ে সরকার আগের চেয়ে ‘নমনীয়’ নীতিতে হাঁটছে। বিএনপি মনে করছে এজন্য অবদান রেখেছে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা নীতি এবং ২০২১ সালের র্যাবের ওপর দেয়া স্যাংশন। বিএনপি বিশ্বাস করে প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাইলেই এখন আর কঠোর হতে পারবে না ভিসা নীতির জন্য। কারণ প্রায় প্রত্যেক বড় কর্মকর্তার বাড়ি-ঘর, সম্পদ আর অর্থ আছে যুক্তরাষ্ট্রে। সন্তান এবং স্বজনরাও আছে।
পাকিস্তানের ফাঁস হওয়া নথিতে কিছুটা উল্লসিত হতে পারে বিএনপি। নাম উঠেছে ডোনাল্ড লু’র যিনি বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন কয়েক দফা। তাই বিএনপির পুরো পরিকল্পনাটাই হলো মাঠে কিছুটা আন্দোলনে থাকা আর বাইরে বিদেশিদের দিয়ে চাপ দিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলা। কিন্তু রাজনৈতিক আন্দোলনের বাস্তবতা অবশ্য এতটা পরিকল্পনামাফিক চলে না।
যেভাবে ঘোষণা এসেছিল বিএনপিসহ আরও প্রায ৩৫ টি দল থেকে তাতে মনে হয়েছিল ১২ জুলাইতেই একটা এসপার উসপার হয়ে যাবে। সরকারের পতন ঘটবে। সেই সময় বিদেশিরাও সমানতালে তাদের দৌড় ঝাঁপ বজায় রেখেছিল। মাঠে আওয়ামী লীগ নিজেও তার শক্তি দেখিয়েছে, পুলিশও পরিস্থিতি ভালোভাবে সামাল দিয়েছে। সংঘর্ষ হয়েছে, নেতা-কর্মী গ্রেফতার হয়েছে, কিন্তু বড় কোনো কিছু হয়নি।
বারবার ঘোষণা দিয়ে সরকার হঠানোর ‘চূড়ান্ত’ আন্দোলন আসলে কোনটা সে নিয়ে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা। ফলে এই নিয়ে তৃণমূল বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরাজ করছে ধোঁয়াশা। এর মধ্যেই মাঠের আন্দোলনের প্রধান ভরসা জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সভাপতিকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে নিষ্ক্রিয়তার কারণে।
আন্দোলন যত ‘জনপ্রিয়’ হয়, ‘স্বতঃস্ফূর্ততা’র হার তত বাড়তে থাকে। বিএনপি ও বিরোধী রাজনীতিকরা এমনটাই মনে করছেন। নিজেদের সমর্থন ভিত্তি বাড়িয়ে আন্দোলনে দলীয় নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি চোখে পড়ার মতো স্বতঃস্ফূর্ততা আনাটাই বড় চ্যালেঞ্জ।
তবে বিএনপির সে রকম কৌশল দৃশ্যমান নয়। বরং মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে সরকার পতন আন্দোলনের চেয়েও সরকারের ওপর বিদেশি চাপ বাড়াতে চায় দলটি। এই নতুন রাজনীতির চলন ও ব্যাকরণ অনুধাবন করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিদেশি চাপে সরকার সরে যাবে এমন বিশ্বাস অরাজনৈতিক বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
জনপ্রিয়তাবাদের কেন্দ্রে রয়েছে মানুষ। সেই মানুষকে ব্যাপক হারে সংশ্লিষ্ট না করে বাইরের উপর নির্ভরতা প্রমাণ করে এই রাজনীতির কোনো নির্দিষ্ট বাঁধাধরা, মতাদর্শ ও কার্যক্রম নেই।
তবে সরকারের জন্য সময়টি চ্যালেঞ্জের। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নাগরিক নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়া এবং দেশটির দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ঢাকা সফর করেছেন। কয়েকদিন আগে ঘুরে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বৈশ্বিক দুর্নীতি দমনবিষয়ক সমন্বয়ক রিচার্ড নেফিউ। আসন্ন দ্বাদশ নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে আগামী অক্টোবরে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রি-অ্যাসেসমেন্ট টিম আসবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। দল আসছে যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকেও।
বিদেশিদের এমন চাপে উল্লসিত বিএনপি। একজন বিএনপি জোটের নেতা টেলিভিশন টকশো-তে বলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হলো পৃথিবীর প্রেসিডেন্ট। সেই উচ্চাশা থেকেই সামগ্রিক নির্ভরতা তাদের উপর। তবে বাস্তবতা হলো রাজপথে তৎপরতা না থাকলে বা নিজস্ব শক্তি এবং মনোবল না থাকলে কেউ সাহায্যের হাত বাড়ায় না। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারবে বিএনপি? কারণ সরকার এবং সরকারি দলও চুপচাপ বসে থাকবে না। তাদেরও সামর্থ্য আছে মাঠে লোক সমাগমের। সরকারি দলের কথা একটাই যে সংবিধানের মধ্যে থেকে শেখ হাসিনার অধীনেই ভাল নির্বাচন করা। সেটা কতখানি বিএনপি মানবে, বিদেশিরা কীভাবে চাবে সেটা হয়তো পরিষ্কার হবে আক্টোবরে মার্কিন প্রতিনিধিদলের সফরের পরই।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।
এইচআর/এএসএম