নারী কীসে আটকায়
‘সুখে দুঃখে কর সহচরী’
সম্প্রতি কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্র্যুডো ও তার স্ত্রী সোফিয়ার বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক মাধ্যমে আবারও আলোচনায় ‘নারী কীসে আটকায়?’
যুগ যুগ ধরে নারীকে কেন্দ্র করে এক রহস্যময়ীর চরিত্র কল্পনা করে কবি সাহিত্যিকেরা লিখে গেছেন নানা কাব্য, গদ্য। নারী আসলেই কী চায়? নারী কী ধন চায়, মন চায় নাকি রূপ চায়? নারী কী চায় এ প্রশ্ন খুব সহজে ব্যাখ্যা করাটা মুশকিল হলেও কিছুটা ধারণা দিয়ে গেছেন আমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যার কাছে আমরা সবাই জীবনের নানা আয়োজন, প্রয়োজনে হাজির হই। ‘চিত্রাঙ্গদা’য় কবিগুরু বলছেন-
আমি চিত্রাঙ্গদা।
দেবী নহি, নহি আমি সামান্য রমণী।
পূজা করি রাখিবে মাথায়, সেও আমি নই;
অবহেলা করি পুষিয়া রাখিবে
পিছে সেও আমি নহি। যদি পার্শ্বে রাখো
মোরে সংকটের পথে, দুরূহ চিন্তার
যদি অংশ দাও, যদি অনুমতি কর
কঠিন ব্রতের তব সহায় হইতে,
যদি সুখে দুঃখে মোরে কর সহচরী
আমার পাইবে তবে পরিচয়।
নারী পুরুষ সম্পর্কের বিষয়টি আজকের নয়। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই এই রসায়ন নিয়ে রয়েছে নানাবিধ আলাপ। অ্যাডামের গন্ধম ফল খাওয়ার জন্য দায়ী করা হয় ইভকে অথচ অ্যাডাম একজন সচেতন ও প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ছিলেন। কবি সাহিত্যিকরা তাদের বিভিন্ন লেখায়ও নারীকে বিভিন্ন উপাধিতে আখ্যা দিয়ে গেছেন যার রেশ চলছে যুগ যুগ ধরেই।
এই যে আলোচনা। ‘নারী কীসে আটকায়’র গোড়া রয়ে গেছে সেই অ্যাডাম ইভের ইতিহাসের মাঝেই। দোষ চাপানোর সংস্কৃতি আমাদের মানব ইতিহাসের একদম পুরোনো একটা বিষয়। সমাজ পরিবর্তন হয়েছে। মাতৃতান্ত্রিক থেকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিবর্তনের সাথে সাথে ক্ষমতারও বিবর্তন হয়েছে। আর আমরা সবাই জানি ক্ষমতার বিবর্তন মানেই দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার। এখন এই দুর্বল বা সবলের সংজ্ঞাকে কেবল অর্থের মাপকাঠি দিয়ে বুঝলে চলবে না। বুঝতে হবে মানসিক, সামাজিক ও আর্থিক বিবেচনায়ও।
প্রতিবার আলোচিত কোনো দম্পতির বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে আর পুরোনো আলোচনা নতুন করে সামনে আসে। কোনো আলোচনায়ই কোনোদিন কেউ পুরুষের চরিত্র বিশ্লেষণ করে না। শুরুতেই চলে যায় নারী কেন সংসার টিকাতে পারলো না সেই আলোচনায়। বিল ও মেলিন্দা গেটসের বিচ্ছেদ হোক আর মিথিলা তাহসানের বিচ্ছেদ হোক বা হালের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পুরুষ প্রধানমন্ত্রী ট্র্যুডোর ঘটনাই হোক আলোচনায় আসে মেলিন্দা, মিথিলা আর সোফি।
এসব আলোচনার মর্মার্থ হচ্ছে নারী আসলেই কোনো কিছুতেই সন্তুষ্ট হয় না। বিভিন্ন ধরনের মিম বানানো হচ্ছে নারীদের হেয় করে। বলা হচ্ছে একজন আকর্ষণীয় চেহারার প্রধানমন্ত্রী যার অর্থ, গাড়ি, বাড়ি, প্রতিপত্তি কোনো কিছুরই অভাব নেই তাকেও ছেড়ে দেয় নারীরা।
অর্থাৎ, নারী এক রহস্যময়ী চরিত্র, যার নিজের পছন্দের বিষয়ে কোনো স্থায়িত্ব থাকে না। কখনও বলা হয় নারীরা অর্থলোভী আবার কখনও বলা হয় নারীর চরিত্রই খারাপ সে এক পুরুষে সন্তুষ্ট থাকে না। জাস্টিন ট্র্যুডোর পিতারও কিন্তু বিচ্ছেদ হয়েছিল। ট্র্যুডোর ঘটনায় এমনও কথা এসেছে যে সোফি অন্য পুরুষে আসক্ত হয়েছে বলেই বিয়ের ১৮ বছর পর এসে এই বিচ্ছেদ।
তিনটি সন্তানের চিন্তা কি কেবলই একজন সোফির? জাস্টিন ট্র্যুডোর নয় কেন? আসলে ১৮ বছরের সংসার না টিকার কারণ বোঝা বাইরের মানুষের সাধ্য কি? তাদের বাস্তবতা কেবল তারাই ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। অথচ আমরা বাইরের বিশ্বের মানুষেরাও রাতদিন নষ্ট করে ফেলছি কেন তাদের সংসার টিকলো না সেই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের রাস্তায়।
আসলে সংসার বা সম্পর্ক বিষয়টা কখনও একজনের শর্তের ওপর নির্ভর করতে পারে না। মানুষ মাত্রই বিচিত্রতায় পূর্ণ প্রাণী। বুঝ হওয়া থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রকৃতির নিয়মে মানুষের বিবর্তন ঘটতে থাকে। সেই বিবর্তন বা পরিবর্তন যাই বলি না কেন সেটি বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন রূপ বা আকৃতিতে এসে ধরা দিতেই পারে। এ পরিবর্তন নারী বা পুরুষ মেনে আসে না। এখানে নারী বা পুরুষ বলে আলোচনা হওয়াটা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। আমাদের নাটক সিনেমায়ও সবসময় নারীকেই হেয় করে দেখানো হয় বেশিরভাগ।
সম্প্রতি পরিচালক রায়হান রাফির আলোচিত ‘সুড়ঙ্গ’ সিনেমার কাহিনি নিয়েও চলছে বিতর্ক। এই সিনেমায় দেখানো হয়েছে একজন লোভী নারীর পরিণতি কেমন হওয়া উচিত। কিন্তু যেভাবে একপেশেভাবে কেবল নারীটিকেই চিত্রায়ন করা হয়েছে ঘটনা কি আসলেই এত সহযে ব্যাখ্যা করা যায়? না করা উচিত বিশেষ করে যখন একটি বৃহৎ পরিসরে কিছু দেখানো হয় যার একটি সামাজিক প্রভাব তৈরি হতে পারে। মানুষের মনস্তত্ত্ব বলেও একটা চ্যাপ্টার থেকে যায়। এ অধ্যায়টিকে উপেক্ষা করে কেবল একপেশে পরিণতি দেখালে বিষয়টার গভীরতা থাকে না।
সমাজে কখনই নারীদের অন্তরের কথাগুলো শুনতে চায়নি বা চায় না। সমাজ ধরেই নিয়েছে নারী হচ্ছে পুরুষের অধীনের একজন। এখানে নারীদের নিজস্বতা বলতে কিছু থাকবে না। পুরুষ সঙ্গীটি যেমন চাইবে কেবল সেটাকেই মেনে চলা নিয়তি। আর এই দৃষ্টিকোণ থেকেই গড়ে ওঠে সব দৃশ্যপট যেখানে নারীকে কখনও ডাইনি, কখনও ধান্দাবাজ কখনও লোভী আবার কখনও হিংস্র হিসেবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা হয়।
‘নারী কীসে আটকায়’ এর উত্তর কিছুটা হলেও পাওয়া যাবে চিত্রাঙ্গদার কথাগুলোকে বুঝতে গিয়ে। চিত্রাঙ্গদা বলছে, নারীকে দেবী বলা লাগবে না, আবার অতি তুচ্ছ রমণী বলেও তাকে অবহেলার সুযোগ নেই। নারী তার সঙ্গীর একজন বিশ্বস্ত ‘সঙ্গী’ হতে চায়। উপরেও যেতে চায় না আবার নিচেও পড়তে চায় না। ‘সঙ্গী’কে বুঝতে হলে কিন্তু পরিশ্রম করতে হয়। সময় দিতে হয়। চেষ্টা করতে হয়। যোগ্য মর্যাদাটুকু নিশ্চিত করতে হয় কথায় নয়, কাজে।
সংকট বা চিন্তায়, সুখ বা আরামে সব মুহূর্তের সঙ্গী হতে চায় নারী। সেই সঙ্গে অর্থ বা মোহ কোনোটাই প্রধান নয়। নারী অবশ্যই ‘লোভী’ কিন্তু সেই লোভ সঙ্গ দেওয়ার লোভ, নারী ধূর্ত কিন্তু সেই ধূর্ততায় ভণ্ডামী নেই আছে কেবল জয় করার আকাঙ্ক্ষা। নারী ছলনাময়ী নয় নারী প্রকৃতিপ্রদত্ত ক্ষমতায় ক্ষমতাশালী যে প্রয়োজনে সবকিছুকে ধারণ করতে পারে। অপ্রয়োজনে তাকে টলানো যায় না সহজে তাই নারী অহংকারীও বটে। দিনশেষে নারী আসলে তার অবস্থান ও মর্যাদার স্বীকৃতিতে আটকায়।
লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/এএসএম