নারী কেন স্বামীর ঘর ছাড়ে?
নরওয়েজিয়ান নাট্যকার হেনরিক ইবসেনের লেখা তিন অঙ্কের নাটক ‘এ ডলস হাউস’। বই আকারে নাটকটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৭৯ সালের ডিসেম্বরে। এই নাটকে ইবসেন উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন, নারী কেন স্বামীর ঘর ছাড়ে।
আসুন নাটকের গল্পটি জানি।
নাটকটির প্রধান চরিত্র নোরা স্বামীর অসুস্থতার সময় বড় অঙ্কের অর্থ গোপনে ধার করেছিলেন। তবে স্বামীকে সেটা জানতে দেননি তিনি। কষ্ট করে হলেও একাই কিস্তিতে সেই ঋণ শোধ করে যাচ্ছিলেন। এদিকে নোরার স্বামী টোরভাল্ড মনে করেন, নোরা এখনো অনেক ছোট এবং অনেক কিছুই সে বুঝতে পারে না। আর সে কারণেই নোরাকে ‘ডল’ (পুতুল) বলে ডাকেন তিনি।
এরই মধ্যে ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান টোরভাল্ড। দায়িত্ব পেয়েই ব্যাংকের কর্মী নিলস ক্রোগস্তাদকে চাকরিচ্যুত করার উদ্যোগ নেন তিনি। নিলসের বিরুদ্ধে অভিযোগ, স্বাক্ষর জাল করে টাকা তুলেছিলেন তিনি। এই নিলসের কাছ থেকেই টাকা ধার করেছিলেন নোরা।
পরে জানা যায়, আসলে নিজের বাবার স্বাক্ষর জাল করে টাকাটা নোরাই তুলেছিল স্বামীকে সুস্থ করে তোলার জন্য। এ সময় নিলস নিজের চাকরি বাঁচানোর জন্য নোরাকে অনুরোধ করে। নয়তো নোরার স্বামীর কাছে সব ঘটনা খুলে বলার হুমকি দেয়।
তবে টোরভাল্ডকে এ কথা বোঝাতে ব্যর্থ হয় নোরা। কারণ নোরার স্বামী মনে করেন, ব্যবসার বিষয়ে নোরা কিছুই জানে না এবং এটা বোঝার ক্ষমতাও তার নেই। একসময় টোরভাল্ড বুঝতে পারে, নোরাই তার বাবার স্বাক্ষর জাল করে ব্যাংক থেকে টাকা তুলেছে। এ কথা জানার পর বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয় টোরভাল্ড। যদিও সে জানে না যে তাকে সুস্থ করে তুলতেই নোরা এ কাজ করেছে।
শেষমেশ নোরাও বুঝতে পারে, যে ভালোবাসা সে টোরভাল্ডকে দিয়েছে, তার যোগ্য সে নয়। নোরাও তার পথ আলাদা করে নেয়।অর্থাৎ স্বামীকে অনেক ভালোবাসার পরও নোরা ঘর করতে পারে না। তাকে স্বামীর ঘর ছাড়তেই হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর বিয়ে-সংসার ব্যবস্থা ও সামাজিক নিয়মকানুনের সমালোচনা করার কারণে বিখ্যাত হয়ে আছে ইবসেনের এই নাটক। সে সময়ে নাটকটি নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। নাটকের মূল চরিত্র নোরা। একসময় স্বামী, সংসার আর সন্তানের দায়িত্ব ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে চায় সে। নিজেকে নতুন করে চেনার, জানার আগ্রহ তৈরি হয় তার মধ্যে। ইবসেন এই নাটক লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন এ ধারণা থেকে যে, ‘একজন নারী আধুনিক সমাজে কখনোই নিজের মতো করে বাস করতে পারে না।’ কারণ, এটি একটি পুরুষশাসিত সমাজ। এই সমাজের আইন তৈরি করে পুরুষরা, আইন প্রয়োগ ও বিচার প্রক্রিয়াও পুরুষদের হাতে। সে কারণেই তাঁরা পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকেই নারীদের বিষয়গুলো নির্ধারণ করেন।
নারীর নিজের ঘর
ভার্জিনিয়া উলফ A room of one's own শীর্ষক বক্তৃতায় বলেন, যদি নিজের একটি ঘর আর ৫০০ পাউন্ডের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়, নারীরাও অনেক উন্নতমানের সাহিত্য উপহার দিতে পারতেন। জেন অস্টেন, জর্জ ইলিয়ট, মেরি কারমাইকেলের মতো লেখিকাদের অত্যন্ত প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও শেক্সপিয়ারের স্তরে উন্নীত হতে পারছেন না পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নানা অসঙ্গতির কারণে। এর মধ্যে বড় সমস্যা হলো আর্থিক সমস্যা। আর তাই নারীকে নির্ভর করতে হয় পুরুষের ওপর। তাই আর্থিকভাবে পরাধীন নারী নিজের পছন্দমতো জীবনকে যাপন করলেও কখনও কখনও জীবন উদযাপনের কথা ভাবতেই পারেন না। পরাধীনতা তাই কোন দৃশ্যমান শৃঙ্খল নয়, পরাধীনতা একটি সেই সকল নারীর জীবনে বিভীষিকা হয়ে আসে।ভার্জিনিয়া উলফ এই সমাজের কাছে একটি প্রশ্ন রাখেন 'নারীকে নিচে ফেলে রাখলে পুরুষরা বড় হবে কী করে? আর পুরুষরা এই মনোভাব বজায় রাখলে নারীদের মুক্তি মিলবে কী করে?'
ভার্জিনিয়া উলফ নারীকেন্দ্রিক সমস্যার মূলে আলো ফেলেছেন। নারীর সামাজিক অবস্থান সুদৃঢ়করণের জন্য তার স্বাবলম্বী হওয়াটা জরুরি, জরুরি বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশও। এসব যখন সাধিত হবে তখন নারীর প্রতি অবমাননা অনেকাংশে কমে আসবে। পুরুষতন্ত্রের একাধিপত্যতে ফাটল ধরবে। এমন আশাবাদ আমরা ব্যক্ত করতেই পারি। ১৯২৮ থেকে ২০২৩ এই ৯৫ বছরে পৃথিবীতে অনেক কিছুর বদল ঘটেছে। নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা উন্নত বিশ্বে অনেকটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় নারী শিক্ষা গ্রহণ করে পুরুষের পাশাপাশি বৃহত্তর কর্মজগতে পা রেখেছে। জলে, স্থলে, আকাশ সর্বত্র নিজের যোগ্যতায় কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে তার অবস্থানের কি খুব বেশি উন্নতি ঘটেছে? এমন প্রশ্ন চলেই আসে চারপাশের সমাজ বাস্তবতাকে পর্যবেক্ষণ করতে গেলে। পয়সা আয় করা আর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা হয়তো এক কথা নয়। আবার স্বাবলম্বী হওয়াও ভিন্ন বিষয়।
এ তো গেল ভার্জিনিয়া উলফ কথিত পাঁচশ পাউন্ড আয় সংক্রান্ত বিষয়ের কথা। বাকি আছে নারীর নিজের একটি কামরা। নিশ্চয় প্রতীকী ভাবনা এটি। কামরা বলতে স্পেসকে বোঝানো হয়েছে। চিন্তার স্বাধীনতাকে বোঝানো হয়েছে। বোঝানো হয়েছে নিজের প্রজ্ঞা, মেধা আর মননশীলতাকে কাজে লাগিয়ে সৃজনশীল কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার স্বাধীনতাকে। একটি মুক্ত আকাশ দরকার সকলের জন্য। যে আকাশে থাকবে ইচ্ছে মতো উড়ার স্বাধীনতা, চলার স্বাধীনাতা, বলার স্বাধীনতা। পুরুষ যেভাবেই হোক তা উপভোগ করে। যখন নারীর প্রসঙ্গ আসে তখন পদে পদে বাধার দেয়াল দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। সমাজ নারীর জন্য এক অদৃশ্য কারাগার বানিয়ে রেখেছে। দেখা যায় না কিন্তু নড়াচড়া করতে গেলে বাধা আসে, ব্যথা লাগে কখনো বা মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, থাকে রক্তাক্ত হওয়ার সম্ভাবনাও। এই সমাজ কিন্তু নারী-পুরুষ উভয়ের। অর্থাৎ এখানে পুরুষতন্ত্রের ছাঁচে নারীও ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। কিংবা নারী তার খণ্ডিত জ্ঞানের জন্য উদারনৈতিক চিন্তা দ্বারা উদ্ভাসিত হতে পারে না। নারীর স্বাধীনতা হরণে কোনো কোনো নারীও পুরুষের কাতারে শামিল হয়। নিজের জীবনের অবরুদ্ধতা তাকে ডানাহীন পাখিতে পরিণত করেছে বলে অন্যের ডানাকে সেও অপছন্দ করছে। কিংবা উড়ার স্বাধীনতা স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়ার মনটাই তাদের তৈরি হয়নি!
লেখক: সরকারি কর্মকর্তা।
এইচআর/এএসএম