বিশ্বব্যবস্থায় সদাচার প্রয়োজন
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম ব্যক্তি ও রাষ্ট্রিক জীবনে সমকালের অনতিক্রম্য সদাচারী মানুষ হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। তিনি ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের একটি সভায় বলেছিলেন, Where there is righteousness in the heart, there is beauty in the character. When there is beauty in the character, there is harmony in the home. When there is harmony in the home, there is the order in the nation. When there is the order in the nation, there is peace in the world.
আজ বিশ্বব্যবস্থা এক ঋণাত্মক পরিস্থিতির মধ্যে পর্যবসিত। অসহনশীল বাস্তবতার মুখোমুখি বিশ্ববাসী। বিশ্বব্যাপী করোনাকালীন এবং করোনা-উত্তর সার্বিক বিপর্যয়, দেশে দেশে যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খাদ্য ও অর্থনৈতিক সংকট এবং মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশে সৃষ্ট মানবিক সংকট আজ বিশ্বব্যবস্থাকে ভারসাম্যহীন করে তুলেছে।
অস্থিতিশীল এই পরিস্থিতির জন্য দায় এড়াতে পারে না শক্তিধর রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক জোট ও বহুদেশীয় সংস্থাসমূহ। এমন বহুমুখী বিপর্যয় থেকে উত্তরণকল্পে প্রয়োজন বিশ্বব্যবস্থায় সর্বজনীন সদাচার। এপিজে আবদুল কালামের উদ্ধৃতির মধ্যেই আমরা সেই সদাচারী বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার একটা সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা পাই, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে শান্তির অন্বেষণ।
সম্প্রতি রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে বিদ্যমান ‘কৃষ্ণসাগর শস্য চুক্তি’র মেয়াদ শেষ হয়েছে। রাশিয়া এ চুক্তির মেয়াদ আর বাড়াতে চাচ্ছে না। ভ্লাদিমির পুতিনের অভিযোগ, পশ্চিমা শক্তি চুক্তি মোতাবেক খাদ্য ও সার রপ্তানির ক্ষেত্রে রাশিয়ার শর্ত ও স্বার্থ সংরক্ষণ করেনি। এমন পরিস্থিতিতে কৃষ্ণসাগরের শস্য করিডোর পুনরায় সংকুচিত হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে বিশ্বজুড়ে যে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য রপ্তানি করা হয় সেটি বিঘ্নিত হবে।
ফলে food supply chain ভেঙে পড়বে; খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে; খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হবে; বিদ্যমান খাদ্যসংকট ঘনীভূত হয়ে দেশে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। এ সংকট নিরসনে বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলছে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন; তবে মার্কিন বলয়ভুক্ত সংস্থা দুটির ভূমিকা বেশ একপাক্ষিক। ফলে সমাধানের পথ মসৃণ নয়, বরং সংকটময় গন্তব্য অত্যাসন্ন। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিবাদপ্রসূত অতলস্পর্শী এ অনিশ্চয়তায় কোথাও কোনো জবাবদিহি নেই; সমাধানের সদিচ্ছা নেই।
এটি বস্তুত বিশ্বব্যবস্থায় মনুষ্যত্ব ও সদাচারের সংকট; যা থেকে উত্তরণ প্রয়োজন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সভ্যতার সংকট’ অভিভাষণে বলেছিলেন, ‘মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপমান মনে করি।’ সুতরাং আমরা স্বপ্ন দেখতেই পারি—সুন্দর সময় আসবে, শান্তিকামী মানুষ তখন প্রাণখুলে হাসবে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী রমিম উদ্দিন আহম্মেদ ইয়াজ (২২) ও অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যে ব্যবসায়ী আবুল হাসিম (৪২) পৃথক দুটি সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছেন। ইয়াজের ঘটনায় অবশ্য সমবেদনা জানিয়েছে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস। তবে যুক্তরাষ্ট্রে এমন মানবিক বিপর্যয় হতাশাজনক। গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান অনুসারে, সে দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বর্ণবাদী গোষ্ঠী এবং সন্ত্রাসীদের হাতে যে সংখ্যক সাধারণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে তা প্রতি বছরই অতীতের রেকর্ডকে অতিক্রম করছে।
গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন, সুশাসন, সামাজিক নিরাপত্তা, জবাবদিহিসহ আধুনিক বিশ্বব্যবস্থার সব সূচকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে একটি মডেল এবং শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্র হিসেবে দাবি করে; অথচ মানুষের জীবনাধিকারের এমন অবনমন তারা রোধ করতে পারছে না। নিরাপদ ও উন্নত জীবনের স্বপ্নে যারা সে দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করছে তাদের একটি নিরাপদ জীবন নিশ্চিতে দেশটির সক্ষমতা ও সদিচ্ছা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো হুইসেল ব্লোয়ারদের এক্ষেত্রে টুঁ শব্দটাও করতে দেখা যায় না। অবশ্য, এসব ক্ষেত্রে তাদের সংঘকেন্দ্রিক রাজনীতি ও সংস্থাকেন্দ্রিক কৌশল-স্বার্থ-লক্ষ্যসহ আরও কিছু বিষয় বিবেচ্য। তারা সব দেশে, সব সময়, সব বিষয়ে দৃষ্টিপাত করে না; তারা সমীকরণ মিলিয়ে কাজ করে। যেমন- চলতি বছরের ১৭ জুন প্যারিসে পুলিশের নির্দেশ অমান্য করে গাড়ি চালানোয় নাহেল এম (১৭) নামে এক তরুণকে গুলি করে হত্যা করেছে ফ্রান্স পুলিশ।
বিচারবহির্ভূত এমন হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ফ্রান্সজুড়ে মারাত্মক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে এবং এ পর্যন্ত ৭০০ জনেরও বেশি নাগরিককে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অথচ এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাসমূহ ও বিশ্বসংস্থাসমূহ কাঠের চশমা পরে বসে আছে। ফলে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বিশ্বশান্তি, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের এজেন্ডাবাহী এসব সংঘ ও সংস্থার নৈতিক গ্রহণযোগ্যতা ও ন্যায়াচার।
এটি বিশ্ব রাজনীতির একটি চিরাচরিত চরিত্র যে, যখন কোনো পরিমিত শক্তি ও সক্ষমতার দেশ ধীরে ধীরে সব ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে টেকসই অবস্থান তৈরি করে তখন পদে পদে প্রতিবন্ধকতা আসে। বিশ্বব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত আধিপত্যবাদী বলয় চেষ্টা করে বিভিন্নভাবে সে দেশের গতিরোধ করতে।
সাম্প্রতিক সময়ে এমনই একটি প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে নিযুক্ত ১৩ বিদেশি মিশন প্রধানের মাত্রাতিরিক্ত তৎপরতার মুখোমুখি হয়েছি আমরা। ঢাকা-১৭ আসনের উপ-নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম ও তার সঙ্গীদের সঙ্গে কয়েকজন যুবকের ধস্তাধস্তি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে; বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী স্বল্প সময়ের মধ্যে অপরাধীদের গ্রেফতার ও নিয়মানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে; এবং স্বয়ং সরকারপ্রধান দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন।
এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং ভোটারদের জন্য নির্বিঘ্ন ভোটাধিকার পরিবেশ নিশ্চিত করে নির্বাচন কমিশন তাদের সক্ষমতা, সদাচার ও স্বাধীনতার প্রকাশ ঘটিয়েছে। অথচ নির্বাচন পরবর্তী যৌথ-প্রতিক্রিয়ায় ১৩ জন কূটনীতিক সামগ্রিক চিত্র ও সফলতাকে পাশ কাটিয়ে শুধু ধস্তাধস্তির বিষয়টি সামনে এনে নির্বাচনকে জবরদস্তিমূলকভাবে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছেন, যা ভিয়েনা কনভেনশনের ৪১ নম্বর আর্টিকেল It is the duty of the one receiving immunities and privileges to respect the laws of the receiving state. It is also their duty not to interfere in the internal affairs of that state.-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
কূটনীতিকদের এমন শিষ্টাচারবহির্ভূত এবং নজিরবিহীন আচরণ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা তথা সুসংহত গণতন্ত্র-লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে বড় ধরনের ব্যত্যয় সৃষ্টি করবে বলে আশঙ্কা জাগে। পাশাপাশি এমন কূটনৈতিক চর্চা বিশ্বব্যবস্থাকেও ভারসাম্যহীন করে তুলতে পারে; প্রান্তিক পর্যায়ের দেশসমূহের সার্বভৌমত্ববোধে সৃষ্টি হতে পারে নিরাপত্তাহীনতা। এমন বৈশ্বিক সংকট এড়াতে অনতিবিলম্বে প্রতিটি দেশের right to sovereignty-কে সম্মান জানানোর মতো বিশ্বমানস সৃষ্টি হতে হবে।
বর্তমান সময়ের আরেকটি অসহনীয় বৈশ্বিক সংকট হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাব। এশিয়া ও ইউরোপে চলছে ভয়াবহ তাপপ্রবাহ। নাসার তথ্যমতে, এ বছরের জুন ছিল ১৭৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণতম মাস। অন্যদিকে, দাবানলে পুড়ছে অস্ট্রেলিয়া, গ্রিস, যুক্তরাষ্ট্রসহ নানা দেশের নানা অঞ্চল; পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত অ্যামাজন বন বিলীন হচ্ছে বারবার দাবানলে।
পাশাপাশি মরু-রূপান্তর, অসময়ে বন্যা, ঝড়সহ নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিশ্ব আজ বিপর্যস্ত; তবে এসবের মূল কারণ অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনে মূল দায়টা মানুষেরই; বহুলাংশে শিল্পোন্নত দেশসমূহের। জলবায়ু বিষয়ে বহু কথা হচ্ছে, নিত্যনতুন সংস্থা গঠিত হচ্ছে কিন্তু কাজের কাজ কতটুকু হচ্ছে? শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহ কী করছে?
বরং, প্রথম দেশ হিসেবে নিজস্ব তহবিল দিয়ে ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড’ গঠন করে বাংলাদেশ বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে—ইচ্ছাশক্তি অর্থশক্তির চেয়ে বড়। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জলবায়ু অর্থায়ন বাংলাদেশেরই সর্বাগ্রে প্রাপ্য।
এটি হতাশাজনক যে, জলবায়ুর প্রতিকূল পরিবর্তন বিষয়ে বিশ্বব্যবস্থায় কোনো জবাবদিহির চর্চা দেখা যাচ্ছে না, প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের তোড়জোড় নেই, সংকট উত্তরণের সদিচ্ছাও সামান্য। সবকিছু মিলে একটি বৈশ্বিক ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। বিশ্বব্যবস্থার এমন অসংহত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র-সংঘ-সংস্থাসহ সব পর্যায়ে বিবেকপ্রসূত সদাচার প্রয়োজন; মানুষ বাঁচানোর মনুষ্যত্ব প্রয়োজন, যুদ্ধ ও আধিপত্যমুক্ত শান্তিসুন্দর পৃথিবী প্রয়োজন।
লেখক: কলামিস্ট ও বিশ্লেষক।
এইচআর/ফারুক/এমএস