বটিয়াঘাটা, এক ছোট আফগানিস্তান!

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ০৯:৫০ এএম, ০৫ আগস্ট ২০২৩

আফগানিস্তানে ২০ বছর পর জঙ্গি তালেবানরা ফিরে আসার পর পুরো দেশটা নারীদের জন্য দোজখে পরিণত হয়েছে। মেয়েদের লেখাপড়া, খেলাধুলা বন্ধ, সব চাকরি থেকে নারীরা বিতাড়িত। সম্প্রতি নারীদের সাজার জন্য যে বিউটি পার্লার ছিল সেগুলোও বন্ধ করেছে তালেবান সরকার। সব ধরনের বাদ্যযন্ত্র পুড়িয়ে দিয়েছে।

বাংলাদেশেও এরকম কিছু ছোট ছোট আফগান পকেট আছে। সম্প্রতি খুলনার বটিয়াঘাটায় এমন এক আফগান পকেটের সন্ধান পাওয়া গেছে। যে নারী ফুটবলাররা আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে দেশের জন্য সম্মান ও সাফল্য বয়ে এসেছেন তাদের ওপর আক্রমণ হয়েছে, তাদের মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছে। চরম মৌলবাদী ও সহিংস সেই আক্রমণ। সেখানে বিভাগীয় অনূর্ধ্ব-১৭ দলের চার নারী খেলোয়াড় হামলার শিকার হয়েছেন।

মেয়েরা কেন খেলবে? আবার খেলবেই যদি তাহলে হাফ প্যান্ট ও ছোট জামা পরে খেলবে? এসব হলো সেই নিপীড়কদের প্রশ্ন এবং এর সূত্র ধরেই হামলা। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে মন্দিরে ঢুকে ছয়টি মূর্তি ভাংচুর করেছে এক যুবক। শাহজাদাপুর ইউনিয়নের নিয়ামতপুর গ্রামে রয়েছে বেশ কয়েকটি মন্দির। গত বৃহস্পতিবার রাত ৮টা ৩৫ মিনিটে বিদ্যুৎ চলে গেলে চারদিকে অন্ধকার হয়ে পড়ে। এ সুযোগে গ্রামের দুর্গামন্দিরে প্রবেশ করে এক যুবক। মন্দিরে রক্ষিত দুর্গা পূজার লক্ষ্মী, সরস্বতী, দুর্গা, কার্তিক, গণেশ ও মহাদেব নামের ছয়টি মূর্তি একে একে ভাঙচুর করে ওই যুবক। এর আগে আমরা মুন্সিগঞ্জে হিন্দু বিজ্ঞান শিক্ষককের হেনস্তা, নড়াইলে হিন্দু কলেজ অধ্যক্ষকে জুতার মালা পরানোর ঘটনায় কারও কিছু হয়নি।

এরকম ছোট ছোট পকেট আফগানিস্তান দেশের সর্বত্র। খোদ ঢাকা শহরে জাতির পিতার ভাস্কর্য স্থাপন করার বিরুদ্ধে হুমকি দিয়েছিলেন হেফাজত নেতা মামুনুল হক। মামুনুল কারাগারে থাকলেও সেই ভাস্কর্য আজও বসায়নি সরকার। শুধু এমন পকেটই নয়, দু’বছর আগে সারাদেশে দুর্গাপূজার সময় হিন্দুদের ওপর আক্রমণ, মন্দির ধ্বংস, অগ্নিসংযোগ প্রমাণ করে দেশটাই আসলে আফগানিস্তাএ পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

খুলনার ঘটনা নিয়ে সারাদেশে, বিশেষ করে রাজনৈতিক মহলে কোনো আলোড়ন নেই। যে দল আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী সে দলও নীরব। আর তাই শুধু আক্রমণ করেই ক্ষান্ত হয়নি হামলাকারীরা। এ ঘটনায় করা মামলা তুলে নিতে আসামিরা হুমকি দিচ্ছে। অন্যথায় নারী ফুটবলারদের শরীরে অ্যাসিড নিক্ষেপের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। আসামিদের হুমকিতে নারী ফুটবলাররা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন। আলোড়ন নেই বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনেও। একটি বিবৃতি দিয়েই নিজেদের দায় শেষ করেছে কাজী সালাউদ্দিনের ফেডারেশন।

খুলনার বটিয়াঘাটায় মেয়ে ফুটবলারদের বিরোধিতার শুরু করেন একজন নারী এবং আক্রমণও করেন তিনি। তিনি তার পুরো পরিবার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন ফুটবলার সাদিয়ার ওপর, আহত করেন সাদিয়াকে এবং তার মাকে। সেই নারী এর আগে মাঠে গিয়ে মেয়েদের ফুটবল অনুশীলনের ছবি গোপনে তুলে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন।

একটা সমাজ যখন রাজনৈতিকভাবে, মনস্তাত্ত্বিকভাবে মৌলবাদী শক্তির হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তখন তা ভয়ের কারণ হয়। যারা এ সত্যটা বুঝতে পারছেন, তারা বিপন্ন বোধ করছেন। তারা মাঝে মাঝে মুখ খুলছেন। কেউ বলছেন নিরাপত্তাহীনতা, কেউ আবার বলছেন অসহিষ্ণুতা। তবে সমাজের রাজনৈতিক বৃহদাংশ চুপ করে আছে, আপস করছে এই মৌলবাদের সাথে। কোনো চিন্তাভাবনার অবকাশ নেই। আজ ইউটিউব, ফেসবুক এমনকি মূলধারার কিছু কিছু মাধ্যমেও একদল লোক অশিক্ষা কুশিক্ষা ছড়াচ্ছে। এদের বক্তৃতার বড় অংশজুড়ে থাকে নারীর প্রতি কুৎসা। নারীদের দমন করার সব কৌশল তারা মানুষকে শেখান এসব বক্তব্যে।

মানুষের ভিতরে ঘুমিয়ে থাকা সাম্প্রদায়িক হিংসাকে জাগানোর কাজ করছে তারা। এটা তাদের রাজনীতি এবং তারা সমর্থন পাচ্ছে অন্য রাজনীতি থেকেও। জঘন্য কুরুচিকর ভাষায় চলে এখনকার প্রচার। কে কত বেশি জঘন্য ভাষা ব্যবহার করতে পারে তারই যেন প্রতিযোগিতা চলছে। এগুলোই কি ধর্মীয় রাজনীতির পুঁজি? যারা দূরদ্রষ্টা তারা বুঝতে পারছেন, যে শক্তিতে আমাদের ঐক্যবন্ধন সেই শক্তি একবার যদি আলগা হতে শুরু করে, তবে সমূহ বিপদ।

নারীর প্রতি সহিংসতাই একমাত্র অপরাধ যেখানে বিচারপ্রর্থীর পোশাক ও চরিত্র বিশ্লেষণ করা হয়। বটিয়াঘাটায়ও তাই ঘটেছে। মেয়েরা কেন ছোট পোশাক পরবে, এই হল নিপীড়কদের ক্ষোভ। শুরু থেকে প্রশাসন ও পুলিশের সাড়া খুব ধীরগতির। আসামিরা মামলা তুলে নিতে হুমকি দিচ্ছে অথচ এদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না।

বোঝা যায় আসামিদের কোনো একটা বড় খুঁটির জোর আছে। পুলিশের বোঝা উচিত যে, মূল অভিযুক্ত যেমন আইনের চোখে দণ্ডের যোগ্য, এই মেয়ে ফুটবলারদের প্রতি সহিংসতাকে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সমর্থন করেছে তারাও অপরাধী। শুধু তাই নয়, নিজের দায়বদ্ধতা পালন না করাটাও নিজেদের জন্য অপরাধ।

বাংলাদেশের সংবিধান নারীর জীবন ও জীবিকার মৌলিক অধিকারকে স্বীকার করে সহিংসতা ও আক্রমণমুক্ত জীবনে নারীর অধিকার জন্মগত বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমাদের দণ্ডবিধিতে নারী নিপীড়নকে দণ্ডনীয় বলে চিহ্নিত করেছে। তাই খুলনার বটিয়াঘাটার স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশকে দ্রুত আইনী ব্যবস্থা নিতে হবে আসামিদের বিরুদ্ধে।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।

এইচআর/এমএস

সমাজের রাজনৈতিক বৃহদাংশ চুপ করে আছে, আপস করছে এই মৌলবাদের সাথে। কোনো চিন্তাভাবনার অবকাশ নেই। আজ ইউটিউব, ফেসবুক এমনকি মূলধারার কিছু কিছু মাধ্যমেও একদল লোক অশিক্ষা কুশিক্ষা ছড়াচ্ছে। এদের বক্তৃতার বড় অংশ জুড়ে থাকে নারীর প্রতি কুৎসা। নারীদের দমন করার সব কৌশল তারা মানুষকে শেখান এসব বক্তব্যে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।