ডেঙ্গুতে মৃত্যু, স্বাস্থ্যমন্ত্রী যা বলেন
একটি ঘাতক আতঙ্ক বিরাজ করছে এই মহানগরের আনাচে-কানাচে জুড়ে। আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যিনি মহামান্য মন্ত্রী তিনি বলেছেন, ডেঙ্গুতে মৃত্যু নিয়ে এখনো জাতীয় সঙ্কট বা আতঙ্কিত হয়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণার সময় আসেনি।
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে নয়জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮৫ জনে। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন দুই হাজার ২৯৩ জন। যা একদিনে এ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে রোববার (২৩ জুলাই) একদিনে দুই হাজার ২৯২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
সোমবার (২৪ জুলাই) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ ডা. মো. জাহিদুল ইসলাম সই করা ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো ( জাগোনিউজ-২৫ জুলাই, ২৩) সত্যই আতঙ্কিত হওয়ার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি। আমরা তখনই ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কিত হবো যখন দেখবো সরকারের কোনো মন্ত্রী/এমপি বা প্রশাসনের কোনো সচিবের ডেঙ্গু হয়েছে। তারাই তো আমাদের এতদ্বিষয়ক ল্যান্ডমার্ক। একজন গরিব মানুষ, একজন শ্রমিক ও তার শিশু বা মহানগরীর প্রান্তিক এলাকার বস্তিবাসী ও তাদের শিশুরা যতই ডেঙ্গুতে মরুক বা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতাল ভরে ফেলুক, তারা তো আর মানুষের পর্য়ায়ে পড়ে না।
তারা তো সারা বছরই নোংরা-আবর্জনার ভরপুর বাস স্থানে বা পরিবেশেই বাস করে। তারা ভীষণ রকম অসচেতন ও ওই রকম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই জন্মেছে, বড় হয়ে উঠছে। তারা নিজেদের বসবাসের জায়গা কেন পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে না? সরকার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে তো প্রতিনিয়তই প্রচারণা চালানো হচ্ছে, কিভাবে নিজেরা পরিবেশ সুস্থ ও স্বাভাবিক করে রাখবেন, সেই পরামর্শ দিচ্ছেন, তারপরও তারা যদি তাদের জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো না করেই বাস করতে থাকেন, তাহলে তো সরকার বা মন্ত্রণালয় এসে তাদের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন করে দেবে না।
আর মন্ত্রী মহোদয় তো বলেই দিয়েছেন, মশা মারার দায়িত্ব তার নয়। তিনি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করছেন এবং করেই চলেছেন। তার পরও তো ডেঙ্গুতে মানুষ মরছে। মশা মারার জন্য গত ৫০ বছরের কামানদাগা ওষুধ ছিটানোর প্রয়াস আমরা দেখেছি। তাতে মশা মরেনি কখনোই। ডিডিটি পাওডার বা মশা মারার ওষুধের মান নিয়ে বহু কথা বলেছেন সাংবাদিকরা। বলেছেন সমাজের সচ্ছল-অসচ্ছল সচেতন মানুষেরা, কিন্তু মশা মারার ওষুধের মান বাড়েনি বা সেই ওষুধে কোনো কাজ হয়নি।
মহানগরের নালা-ডোবা মজে যাওয়া পুকুর ও বাসা-বাড়ির কোণা-কানছিতে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে মশা বেশ জোরে শোরেই জন্মনিয়ন্ত্রণহীনভাবে উৎপাদন বাড়িয়ে চলেছে। মশার লার্ভা দমনে কামানদাগানেওয়ালা সিটির কর্মীবাহিনীর তৎপরতা আমরা টিভি ক্রিনে দেখেছি। উত্তরের মেয়র মহোদয় বলেছেন তিনি তো নিরন্তরই চেষ্টা করছেন, কিন্তু মশা মরছে না। সেটা কেন হচ্ছে না, তাতে তিনি বিস্মিত। তাহলে কি ওষুধে কোনো রকম কাজ হচ্ছে না? ওষুধের মান কি নিম্নমানের? নাকি মশারা তাদের জীবনশৈলী পরিবর্তন করে নিয়েছে? তারা কি ওষুধ-প্রুফ হয়ে গেছে?
ওষুধের নামে কর্মীবাহিনী পানি ছিটিয়ে চলেছেন? সেই সঙ্গে এই আষাঢ় ও শ্রাবণের এই দিনগুলোতে এডিস মশার লার্ভা মারার বা দমনের কার্য়ক্রম কেন চলছে, সে প্রশ্নটি যাদের আত্মীয়-স্বজন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তারা করছেন।
কেন বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজগুলো করা হয়নি? তখন কেন ওষুধ ছিটানো হলো না। তখন কেন তারা কালঘুমের গরমকাল! অতিবাহিত করেছেন? এই যে দুটি সিটির হাজার হাজার পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা কর্মী আছেন তারা কেন, তাদের নিয়ন্ত্রক অফিসারগণ কি রাজনৈতিক কর্মে নিয়োজিত ছিলেন? যার জন্য তারা সরকারের বা সিটির মেয়রের প্রোগ্রামে অ্যাটেন করেছেন কাজ না করে?
যদি এই রকম কোনো সত্য লুকিয়ে থাকে, তাহলে তাদের সে-কথাগুলো সমস্বরে সম্মিলিতভাবে বলা উচিত। এই কারণে বলা উচিত যে আমাদের জনপ্রতিনিধিরা কি করেন, সেই প্রশ্নটির একটি সঠিক জবাব দেবার জন্য। এটা করলেই যে ভয়ে মরে যাবে এডিস-বাহিনী বা তারা লার্ভা উৎপাদনে ক্ষান্তি দেবে, এমন নয়, তাহলে আমরা যারা এডিসের কামড়ের অপেক্ষায় আছি, তারা শান্তি পাবো।
এটা হলো এই এডিস মশাসংক্রান্ত মৃত্যু বিষয়ক পরিস্থিতির একটা দিক। ঠিক উল্টো পিঠে আছে এই মহানগরের বাসিন্দাদের নাগরিক হয়ে উঠার মতো যোগ্যতা। অনেকেই দাবি করবেন, আমরা সজাগ-সচেতন। কিন্তু তারা কড়ে আঙুলে গোনা মানুষ। উচ্চশিক্ষিত, শিক্ষিত ও প্রায় শিক্ষিত ধান্ধাবাজ শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা কিন্তু মশক এডিসের মতোই। তারা ধান্ধায় ব্যস্ত।
রাজনৈতিক সরকারের কাছে থেকে কিভাবে মাল খসিয়ে নিয়ে আসতে পারবে, সেই চিন্তায় তাদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। তাদের দালানের ছাদে, বারান্দায় বা কার্ণিশের কোণায় জমে, পচে যাওয়া ময়লার স্তুপে জন্ম নেয় মশা। সেখানে এডিসের সংখ্যাই বেশি। তাদের কামড়ে শিশু-কিশোরসহ বয়স্ক-বয়স্কা মানুষের ডেঙ্গু হতে দেরি হয় না। আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগী প্রতিদিনই বাড়ছে। প্রতিদিনই মানুষ মরছে।
এইসত্য কি মহামান্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী, মেয়র মহোদয় এবং প্রজ্ঞাবান প্রশাসনের লোকেরা বুঝতে পারেন না?
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৫ হাজার ২৭০ জন। তাদের মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২১ হাজার ১৮৭ জন। আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন ১৪ হাজার ৮৩ জন।
একই সময়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ২৭ হাজার ৬২২ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ১৬ হাজার ৬৪৪ জন এবং ঢাকার বাইরের ১০ হাজার ৯৭৮ জন। এর আগে ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ২৮১ জন মারা যান। ওই বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ডেঙ্গুতে ২৭ জনের মৃত্যু হয়। একই সঙ্গে আলোচ্য বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। সবশেষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব এস. এম নাজিয়া সুলতানা (ডব্লিউটিও উইং)। ৩০তম বিসিএস-এর এই কর্মকর্তা আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। (জাগো নিউজ ২৫- ০৭ -২৩)
এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে ঢাকার মেয়রদ্বয় কতোটা সজাগ ছিলেন, আর কতোটা রাজনৈতিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন। মেয়রদের রাজনীতি থেকে বিচ্যুত না করলে তারা সময়মত মশানিধনের কাজ করবেন বলে মনে হয় না। কারণ, মানুষ মরুক বা না মরুক তারা রাজনীতির সঙ্গেই সময় ব্যয় করেন বেশি। ফলে লার্ভা উৎপাদক মহানগরীর নালা-ডোবা, বাড়ির কোণাকানছিতে জমে/পচে থাকা পানিতে এডিসের উৎপাদন বেশ ভালোই হতে থাকে। আর অন্যপ্রজাতির মশার কথা নাইবা বললাম।
প্রতিদিনই ডেঙ্গুতে মানুষ মরছে। একটি প্রাণ চলে গেলে কি তা ফিরিয়ে আনা সম্ভব? তাহলে কি করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বললেন, জরুরি অবস্থা ঘোষণার সময় হয়নি? হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্সগণ সেবা দিয়ে তো প্রাণ বাঁচাতে পারছে না। এডিসের কামড় থেকে মানুষকে বাঁচান, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
২৫/০৭/২৩
লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/এএসএম