তত্ত্বাবধায়ক সরকার সমর্থন করা উচিত হবে না ইউরোপীয় ইউনিয়নের
সম্প্রতি ‘দ্য ইইউ মাস্ট নট সাপোর্ট আ কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক নিবন্ধে বর্তমানে ইউরোপিয়ান ইনস্টিটিউট অব ইনোভেশন অ্যান্ড টেকনোলজি’র (ইআইটি) সদস্য এবং ইইউ’র সাবেক কমিশনার ও ধর্ম বিষয়ক বিশেষ দূত ইয়ান ফিজেল বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) উচিত হবে না বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে কোনোভাবেই সমর্থন দেওয়া।
এই নিবন্ধে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা দেওয়া হলে তা আবারও সামরিক বাহিনীর হাতে চলে যেতে পারে। যেমনটা ঘটেছিল এখন থেকে ১৭ বছর আগে ২০০৬ সালে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দুটি দেশ থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের দৃষ্টান্ত দিয়ে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে সমর্থন না দিতে ইইউ নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ইয়ান ফিজেল।
নিবন্ধে বাংলাদেশ পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে ইয়ান ফিজেল বলেন, ‘বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। আমাদের সবাইকে দেশটির দিকে নজর দেওয়া উচিত। ’
বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তিক্ত ইতিহাস তুলে ধরে ইইউর সাবেক এই কমিশনার বলেছেন, সবশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলে ঘটনাক্রমে তা সেনাবাহিনীর হাতে চলে যায়। ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা থাকলেও তারা নির্বাচনই স্থগিত করে।
২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত কার্যত দেশ শাসন করে। ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর সেই সময় প্রধান বিরোধী দল ও বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচন বয়কট করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। শীর্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর সব নেতাকে গ্রেফতার করা হয় এবং প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো একটা অনির্বাচিত সরকার পরবর্তী দুই বছর ধরে যেসব কর্মকাণ্ড চালিয়েছিল, তা সাধারণত কোনো জান্তা সরকারই করে থাকে।
বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকর্মীদের বিভিন্ন হয়রানি করা ও জেল-জরিমানা দেওয়া হয়। সেদিনের সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি প্রত্যাখ্যানের ক্ষেত্রে অন্যতম বড় প্রভাবক হয়ে থাকতে পারে।
ইয়ান ফিজেল বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এমন একটি ব্যবস্থা যা বিশ্বের আর কোথাও নেই। ২০১১ সালে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট এই ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেন। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকার বলেছে, আগের নির্বাচনগুলোতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তা ছিল। কারণ সে সময়গেুলোতে বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনের কোনো আইনি ভিত্তি ছিল না। তবে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য একটি নতুন আইন পাস করা হয়।
সম্প্রতি বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে চাপ অব্যাহত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেই সঙ্গে নির্বাচন তদারকি করতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের স্বাগত জানিয়েছেন তিনি।
নিবন্ধে বলা হয়, চলতি বছরের জুনে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর গাজীপুরে সাম্প্রতিক স্থানীয় নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে ও বড় কোনো অঘটন ছাড়াই অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে কম ব্যবধানে হারিয়ে দিয়েছেন। যদিও বিএনপি এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি।
ইয়ান ফিজেলের মতে, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধীদের নির্বাচন বয়কটের আশঙ্কা রয়েছে। সেক্ষেত্রে এই অঞ্চলে আরেকটি সামরিক হস্তক্ষেপের মঞ্চও প্রস্তুত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে যদি সামরিক বাহিনীকে থামাতে হয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সামরিক নেতাদের এটা অবশ্যই স্পষ্ট করে দিতে হবে যে এর পরিণতি হবে দ্রুত, অত্যন্ত কঠোর এবং ব্যক্তিগত।
একটা স্বাধীন দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তখনই নির্বাচন পরিচালনা করার কথা আসে যখন ঐ দেশে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা- বিশৃংখলা বিরাজ করে। বাংলাদেশে বর্তমানে রাজনৈতিক শৃঙ্খলা বিরাজ করছে কেননা এদেশে বিদ্যমান সকল রাজনৈতিক দলসমূহ স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করার এবং সভা-সমাবেশ করার সমান সুযোগ পাচ্ছে। সবগুলো দল নির্বাচনে সমানভাবে অংশগ্রহণ ও নির্বাচন করে জনগণের কল্যাণে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন ও দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করার সর্বোচ্চ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ার কথা বলে দেশের শৃঙ্খলাপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ নষ্ট করার কোনো ধরনের যৌক্তিকতা নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাওয়ার নামে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি না করে বিএনপিসহ সব দলের উচিত জনসমর্থনে বিশ্বাস করে বাংলাদেশের জনগণের সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট হওয়া। জনসমর্থনহীন কোনো দলই নির্বাচনে জয়লাভ করা সম্ভব হবেনা সে যার অধীনেই নির্বাচন হোক।
পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার দাবি তখনই মানুষ তোলে যখন দেশে কোন নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন থাকবেনা। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন আছে সংবিধান স্বীকৃত। এই সংবিধান স্বীকৃত এমন নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন থাকার পরও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি করা নিত্যান্তই অবান্তর।
বিএনপিসহ অন্যান্য দলের নেতাকর্মীরাও জানে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালে আওয়ামিলীগ ও বিএনপিসহ অন্যান্য সব দলের নেতাকর্মীদের কতভাবে হয়রানির শিকার ও জেল-জরিমানার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের নামে পূনরায় এই ইতিহাসের অবতারণা করার চেষ্টা করা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের শান্তিকামী মানুষের অশান্তির কারণ করে বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট করে দেশে অরাজকতা তৈরির করার চেষ্টা করা ছাড়া আর কিছুই না। বাংলাদেশে সংবিধান স্বীকৃত নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন আছে।
একটি দেশের নির্বাচন ঐ দেশের সংবিধান স্বীকৃত নির্বাচন কমিশনের অধীনে হবে এটাই তো একটা স্বাধীন এবং গণতান্ত্রিক দেশের মূল কথা। সংবিধান স্বীকৃত এমন নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন থাকার পরেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার দাবি করা মূলত ঐ দেশের সংবিধানকে অমান্য করার সমতূল্য। কোনো রাজনৈতিক দলেরই উচিত হবেনা দেশের সংবিধানকে অমান্য করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি করা।
সুতরাং বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক স্বাধীন দেশ। গণতন্ত্রের চর্চার মাধ্যমে এদেশের মানুষ শান্তিতে আছে এবং দেশ ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বের মাধ্যমে।
বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে না তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে হৈ চৈ করে দেশের শান্তিকামী মানুষের জীবনে অশান্তির সৃষ্টি করা। বরং তাদের উচিত জনসমর্থন আদায়ে মাঠে থেকে জনগণের সমর্থন আদায় করার মাধ্যমে জন ভোটে নির্বাচনে জয়লাভ করার মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা। কোনো রাজনৈতিক দলেরই উচিত হবে না তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের নামে দেশের শৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট করা।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ইতিহাসের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত জনসমর্থন ও গণতন্ত্রে বিশ্বাস রেখে পথ চলেছে যার জন্য জনগণ আওয়ামী লীগকে কখনও বিএনপির মতো ছুড়ে ফেলে দেয়নি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বরাবরের মতো জনগণের উপর বিশ্বাস ছিল এবং আছে এবং থাকবে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত দেশকে নিয়ে সব ধরনের ষড়যন্ত্র বাদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার আদর্শ থেকে শিক্ষা নিয়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে শান্তিপূর্ণ অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে দেশের জনকল্যাণে অংশগ্রহণ করার।
লেখক: ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হস্পিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/এএসএম