‘আসুন, বাংলাদেশের মানুষকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিই’
বাংলাদেশের রাজনীতি এখন রোলার কোস্টারে চড়েছে যেন। রাজপথ উত্তাল, দফা-পাল্টা দফা, কর্মসূচিতে-পাল্টা কর্মসূচিতে সরগরম। তবে হঠাৎ এই ভরা বর্ষায় রাজনীতির রাজপথে নেমে আসার উপলক্ষ্য কিন্তু জনগণ নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রাক-নির্বাচনী প্রতিনিধি দল এখন বাংলাদেশ সফর করছে। দুই সপ্তাহের সফরে তারা নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সব মহলের সাথে বৈঠক করছে। এর আগে মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার তিনদিনের সফরেও আগামী নির্বাচনই ছিল মূল ফোকাস। আর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মাঠের কর্মসূচির মূল ফোকাস ছিল বিদেশিরা।
গত সপ্তাহেও এই কলামে লিখেছিলাম ‘নির্বাচন দেশে তৎপরতা বিদেশে’। এই সপ্তাহে এটা আরও বেশি করে প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা দেখে মনে হচ্ছে, বিদেশি শক্তি এসে সরকারকে হটিয়ে অন্য কাউকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। জনগণের যেন এখানে কোনো ভূমিকাই নেই। অথচ রাজনৈতিক দলগুলো মুখে সারাক্ষণ জনগণের কথা বলেন।
আমরা সবকিছু বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে তৈরি হলেও, তারা কিন্তু তা নিতে রাজি নয়। উজরা জেয়া তার বহুল আলোচিত সফরে প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রসচিব, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার সাথে সিরিজ বৈঠক করেছেন। কিন্তু তিনি বিরোধী রাজনৈতিক দলের কারও সাথে কথা বলেননি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া খুব পরিষ্কার। তারা একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। সেই প্রক্রিয়া নির্বিঘ্ন করার জন্য তারা সবকিছু করবে। এই প্রক্রিয়ায় যারাই বাধা দেবে, তাদের ভিসা না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর এই ভিসা নীতি সরকারি দল ও বিরোধী দল সবার জন্যই প্রযোজ্য। উজরা জেয়ার সফরে প্রধানমন্ত্রীসহ দায়িত্বশীলরা সবাই এ ব্যাপারে তাদের দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা বলেছেন।
আপাতত সেই অঙ্গীকারে আস্থা রাখছে যুক্তরাষ্ট্র। অঙ্গীকারের ব্যত্যয় ঘটলে নিশ্চয়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরও কঠোর ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু যতক্ষণ নির্বাচন প্রক্রিয়া বিঘ্নিত না হচ্ছে, ততক্ষণ তো যুক্তরাষ্ট্রেরও আর নতুন করে কিছু করার নেই। উজরা জেয়া সংলাপের ওপর জোর দিয়েছেন। তবে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন ‘আমরা সবাই সংলাপ চাই। তবে এই প্রক্রিয়ায় আমরা সরাসরি যুক্ত নই।’
উজরা জেয়া এটাও বলেছেন, ‘আমি সহিংসতা প্রত্যাখ্যান করে সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক, শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও ন্যায্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমর্থন করতে সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানাই।’ উজরা জেয়া সম্ভাব্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নির্বাচন বর্জনের বিষয়কে বাংলাদেশের জনগণের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মন্তব্য করে বলেছেন, ‘এ বিষয়ে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা দেখছি না। আমি শুধু বলতে চাই, আমরা কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ নিই না।’
উজরা জেয়া স্পষ্ট করে বললেও, অনেকে তার কথা বুঝতে পারেননি। যারা উজরা জেয়ার সফরের দিকে তাকিয়েছিলেন, ভেবেছিলেন, তিনি এসেই সরকার হটিয়ে দেবেন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করে দেবেন; তারা বেশ হতাশই হয়েছেন। তারা বলছেন, উজরা জেয়া একজন কূটনীতিক। আর কূটনীতিকরা মুখে যতটা বলেন, তাদের কথার ভেতরে লুকিয়ে থাকে আরও অনেক বেশি কথা। না বলা কথার চেয়ে আমরা যদি বলা কথার দিকে তাকাই, সেখানেও তো বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষার সাথে কোনো অমিল নেই। সবাই একটি অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। মানুষ যেন তার ভোট দিতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেন আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেন, সবার চাওয়াও তাই। অবাধ নির্বাচনের পথে কী কী বাধা আছে; তা দূর করতে তাদের সব চেষ্টা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেন আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেন, কারও পক্ষেই কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলা সম্ভব নয়। তাদের দেশে যে প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হয়, তারা তো শুধু সেটার পক্ষেই ওকালতি করতে পারবেন। বিদ্যমান ব্যবস্থায় যাতে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা যায়, সেই চেষ্টাটাই তারা করতে পারেন শুধু। সরকারের ওপর কঠোর নজরদারি, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ব্যাপারে সজাগ থাকতে পারে তারা। কিন্তু সরকার বদলে দেয়ার কোনো এখতিয়ার তাদের নেই। এই এখতিয়ার আছে শুধু বাংলাদেশের। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা এই বিষয়টাই বুঝতে পারেন না বা বুঝতে চান না। জনগণের ওপর তাদের কোনো ভরসা নেই।
বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা যেটা বছরের পর বছর রাজনীতি করেও বুঝতে পারেননি। উজরা জেয়া তিনদিনের সফরে সেটা বুঝে গেছেন। যাওয়ার আগে বার্তা সংস্থা ইউএনবিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উজরা জেয়া আসল কথাটি বলে দিয়েছেন স্পষ্ট করে, ‘আসুন, আমরা বাংলাদেশের জনগণকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ করে দিই।’ আমাদের রাজনীতিবিদদের দেশের জনগণের প্রতি কোনো আস্থা বা সম্মান না থাকলেও বিদেশি এক কূটনীতিক কিন্তু জনগণকে যথার্থ সম্মান দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগও পরপর দুটি নির্বাচন করে ফেলেছে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ ছাড়াই। আর বিএনপিরও জনগণের ওপর আস্থা আছে, এমনটি মনে হয়নি কখনোই। তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা একটি দলকে ক্ষমতা থেকে হটানোর একটিই উপায়- তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তুলে সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায় করে অবাধ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। কিন্তু গত ১৪ বছরে বিএনপি কখনোই সরকারের ওপর চাপ দেওয়ার মতো কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। ২০১৩, ২০১৪ সালে আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস, জ্বালাও-পোড়াও করলেও তাতে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল না। বিএনপি যদি আবার আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস করতে নামে; যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিশ্চয়ই তাদের পাশে থাকবে না। সবকিছুর আগে সবাই চায় শান্তি।
বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা যেটা বছরের পর বছর রাজনীতি করেও বুঝতে পারেননি। উজরা জেয়া তিনদিনের সফরে সেটা বুঝে গেছেন। যাওয়ার আগে বার্তা সংস্থা ইউএনবিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উজরা জেয়া আসল কথাটি বলে দিয়েছেন স্পষ্ট করে, ‘আসুন, আমরা বাংলাদেশের জনগণকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ করে দিই।’ আমাদের রাজনীতিবিদদের দেশের জনগণের প্রতি কোনো আস্থা বা সম্মান না থাকলেও বিদেশি এক কূটনীতিক কিন্তু জনগণকে যথার্থ সম্মান দিয়েছেন।
একটা বিষয় পরিষ্কার, সংলাপ হোক আর নির্বাচন; সেটা আমাদেরই করতে হবে। কেউ করেও দেবে না। এমনকি কেউ মধ্যস্ততাও করবে না। আমাদের সমস্যা আমাদেরই মেটাতে হবে। তারা শুধু দেখবে, খেলার মাঠটা সমান আছে কি না, খেলায় কেউ ফাউল করছে কি না। উজরা জেয়া যেটা বলেছেন, সেটা মেসনে আমরা যদি জনগণের দুয়ারে ফিরে যাই, তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেই; তাহলেই দেশের জন্য মঙ্গল। ঠিকঠাক নির্বাচনের জন্য দুই দলকেই আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। দুই পক্ষকেই ছাড় দিতে হবে।
নির্বাচনকালীন একটা গ্রহণযোগ্য সরকার ব্যবস্থা ঠিক করতে হবে। সারাবিশ্বে যে প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হয়, সে প্রক্রিয়ায় আস্থা রাখতে হবে। দলগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস দূর করতে হবে। উজরা জেয়া বলেছেন বলে নয়; আমাদের রাজনীতিবিদদের মন থেকে বিশ্বাস করতে হবে, জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। তাদেরই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দিতে হবে।
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম