হিরো আলমের ‘ইমোশন’ ব্যবসা সত্যিই ভয়ংকর
বাজার হিসেবে বাংলাদেশ খুব উর্বর। শুধু উর্বর বললে যতটা না ভুল হবে তার চেয়ে বেশি হবে অন্যায়। বলা উচিত খুবই খুবই খুবই উর্বরভূমি। এখানে যে যা পারে বিক্রি করছে, লাভ তুলছে এবং তা বিনা পুঁজিতে। কেউ বিক্রি করছে চেতনা, কেউ গণতন্ত্র, কেউ মানবাধিকার, কেউ ধর্মানুভূতি, কেউ তথাকথিত মানবিকতা- যে যা পারে, যার যা খুশি। এখানে পুঁজি একটাই তা হচ্ছে মানুষের আবেগ আর অনুভূতি। এই ইমোশন কাজে লাগিয়ে দেদারসে বাণিজ্য করে যাচ্ছে একেকজন। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। আলোচিত চরিত্র হিরো আলমও এর ব্যতিক্রম কেউ নয়, কিছু নয়। নেহাত পুঁজিবাদী, সুবিধাবাদী, অতি মুনাফালোভী এক চরিত্র মাত্র।
বাজার, বিপণন এবং মনস্বত্ব হিরো আলম খুব ভালো বোঝেন। সোজাকথা মার্কেট ইকোনমি এবং মার্কেটিং স্বয়ং ফিলিপ কটলারও তার মতো বোঝেন কি না সন্দেহ বাঙালির ইমোশনকে পুঁজি করে ভালো দামে যে কোন কিছু বেচাকেনা সম্ভব তা তিনি বুঝে গেছেন এবং চরম মাত্রায় সফলও হয়েছেন। কিন্তু তার এই উৎকট সাফল্য যে সমাজের জন্য, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভয়াবহ ক্ষতির কারণ তা অনেকেই বুঝতে পারছেন না। আর রাজনৈতিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত বুদ্ধিজীবীরা তামাশা দেখছেন। কোনো কোনো তথাকথিত মার্কসবাদী, লেলিনবাদী বুদ্ধিজীবী হিরো আলমকে শ্রেণি চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘শ্রেণি চরিত্র’ হিসেবে আখ্যা ও ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
হিরো আলম মোটেও কোনো শ্রেণি চরিত্র নয়। তাকে ‘প্রলিতারিয়েত’ বা শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধি বানানোর চেষ্টা অন্যায়। তিনি খুবই চতুর এবং কৌশলী একজন মানুষ, যিনি মানুষের দারিদ্র্যতা বেচাকেনা করে অর্থের মালিক হয়েছেন। মানুষ ছোট থেকে বড় হয়। স্বল্প উপার্জন থেকে অধিক উপার্জনে সক্ষম হয়। অর্থবিত্তের মালিক হয়। এই হওয়াটা মোটেও অন্যায় নয়। কিন্তু হওয়ার প্রক্রিয়া, কৌশল হিসেবে কেউ যদি মানুষের দারিদ্র্য, বঞ্চনাকে বেছে নেয় তা অন্যায়।
হিরো আলম মার্কেটিংয়ের যে কৌশলটি বেছে নিয়েছেন সেখানে বলেন- তিনি দরিদ্র, তিনি গরিব মানুষ, তার চেহারা খারাপ এসব। তার চেহারা সুন্দর কি অসুন্দর সেটা কোনো ইস্যু নয়। চেহারা যার যার, মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহপাক যাকে যেমন বানিয়েছেন সে তেমন। হুমায়ুন ফরিদী কি প্রচলিতভাবে খুব হ্যান্ডসাম ছিলেন কিংবা নানা পাটেকার? হলিউডের উদাহরণে নাইবা গেলাম। যার যে কাজ সেটা যদি তিনি যথার্থভাবে করতে পারেন তবেই সার্থকতা।
হিরো আলম যে মিউজিক ভিডিও, সিনেমা বানান এসব কী আদৌ নাটক বা সিনেমা? চতুর হিরো আলম ইচ্ছে করেই তার মাপের চেয়ে বড় শার্ট পরেন, বড় জুতা পরেন যেন দেখতে তাকে বেখাপ্পা লাগে। নায়িকা যেন তার চেয়ে বড় হন, স্বাস্থ্যবতী হন-তবেই তো লোকে হাসবে, ট্রল হবে, টিটকারী হবে-বাড়তে থাকবে তার ভিউ, জমতে থাকবে অ্যাকাউন্টে ডলার। হিরো আলমের ডলার প্রয়োজন, অন্য কিছু নয়।
তিনি মার্কেটিংয়ে সফল তবে এটি নেগেটিভ মার্কেটিং। নেগেটিভ মার্কেটিংয়ের সমস্যা হচ্ছে এ বিপণন কৌশল এক ধরনের নেগেটিভিটি ছড়ায়। যে নেগেটিভিটি সোসায়টিতেও নেগেটিভ ইমপেক্ট তৈরি করে। নেতিবাচকতা ছড়ায়। যার প্রভাব ভয়াবহ। তেজস্ক্রিয়ার মাত্রা বিবেচনা করলে চেরোনবিলের চেয়েও ভয়ংকর।
দৃশ্যমান বাস্তবতায় সমাজে যে বার্তাটি যাচ্ছে তা হলো- কেউ কোনো কাজ যথার্থভাবে না করলেও তার পক্ষে ভালো উপার্জন করা সম্ভব। এমনকি কোনো কাজের জন্য কোনো মানুষের দক্ষতা, যোগ্যতারও প্রয়োজন নেই। যোগ্যতা না থাকলেও তিনি উপার্জন করতে পারেন। ফলে পুঁজিবাদী সমাজে তরুণদের বড় একটি অংশ ভেবেই নিচ্ছে যোগ্যতার প্রয়োজন নেই। অযোগ্যতাও একটি যোগ্যতা; না হলে উপার্জন হচ্ছে কীভাবে হিরো আলম সাহেবের? আবার গণমাধ্যমও তার প্রচার করছে। শুধু দেশি গণমাধ্যম নয় কোনো কোনো বিদেশি গণমাধ্যমও তাকে প্রচার দিতে ব্যস্ত একথাও সত্য।
আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে চাই, গণমাধ্যম নিজেও রুচিহীনতায় আক্রান্ত। সমাজের প্রভাবই গণমাধ্যমে পড়ে। ফলে টাকার জন্য মরিয়া যে অসভ্য সমাজ আমরা সবাই মিলে গড়ে তুলতে ব্যস্ত, টাকাই আমাদের একমাত্র অবাধ্য তার ছায়াসম্পাতই গণমাধ্যমের চরিত্র হবে স্বাভাবিক। ফলে ডিজিটাল প্লাটফর্মের সঙ্গে পরিচয়ের পর আমাদের মিডিয়া হয়ে উঠেছে ‘ভিউ বেইজড’ মিডিয়।
রুচি তৈরি দূরে থাকুক, নিজের রুচি বিসর্জন দিতেও সে মরিয়া। তা যদি না হয় তবে বিভিন্ন মিডিয়ার ফেসবুক পেজে হিরো আলমের গান, সাক্ষাৎকার, ছবির ক্লিপ কেন? গণমাধ্যমের যদি রুচির বিকৃতি না ঘটে তাহলে মিডিয়াগুলোর পেজে হিরো আলমের পাশাপাশি সেফুদা, সানাই মাহবুব, হেলেনারা কেন? এদেশে কী তারকার অভাব নাকি লোকের?ফলে গণমাধ্যম সম্পর্কে যে মানুষের মনে নেতিবাচক ধারণা উৎপাদিত হচ্ছে তা নিয়ে গণমাধ্যমের ব্যক্তিদের মধ্যেও কোনো ভাবাবেগ নেই।
রুচি তৈরি দূরে থাকুক, নিজের রুচি বিসর্জন দিতেও সে মরিয়া। তা যদি না হয় তবে বিভিন্ন মিডিয়ার ফেসবুক পেজে হিরো আলমের গান, সাক্ষাৎকার, ছবির ক্লিপ কেন? গণমাধ্যমের যদি রুচির বিকৃতি না ঘটে তাহলে মিডিয়াগুলোর পেজে হিরো আলমের পাশাপাশি সেফুদা, সানাই মাহবুব, হেলেনারা কেন? এদেশে কী তারকার অভাব নাকি লোকের?
বাণিজ্যিক মিডিয়া অবশ্যই উপার্জনকে প্রাধান্য দেবে কিন্তু প্রাধান্য দিতে গিয়ে যা ইচ্ছা তাই প্রচার করে নিজেদের ইমেজ ও গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট করলে দিনশেষে যে মানুষের কাছে তারাও হিরো আলমে পরিণত হবেন, একথা তাদের কে বোঝাবে?
হিরো আলম তার বাণিজ্যিক কৌশল হিসেবে সব সময়ই আলোচনায় থাকতে চান, যার নবতর সংযোজন রাজনীতিতে পদার্পণ। তিনি কখনো মেম্বার হতে চান, কখনো চেয়ারম্যান, কখনো এমপি। কথা হচ্ছে রাজনীতি কি ছেলেখেলা, নাকি তামাশা? আমার ট্রল হবে, ভিউ ভাড়বে- এজন্য আমি চাইলাম আর মনোনয়নপত্র তুললাম। নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে গেলাম?
ন্যূনতম যোগ্যতা, অভিজ্ঞতার প্রয়োজন নেই? হিরো আলমের কি আদৌ কোনো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা আছে। ২০০ টাকা করে জাকাতের শাড়ি লুঙ্গি কিনে, বিশ-পঞ্চাশ জন মানুষের মধ্যে বিলিয়ে ফেসবুকে ছবি দিলেই কি নেতা? রাজনীতি কি এতই তামাশা?
কেউ কেউ আবার এ তামাশায় মজা নিচ্ছেন, কেউ কেউ তাকে বিশাল সাহসী আর প্রতিবাদী হিসেবে দাঁড় করাচ্ছেন। কেউ কেউ নিজেদের রাজনৈতিক লাভ মনে করে তার কর্মকাণ্ডের নেপথ্যে টাকাও ঢালছেন। কিন্তু দিনশেষে ক্ষতি করছেন প্রত্যেকে নিজের, আর হিরো আলম লাভ করছেন। উপার্জন করছেন। রাজনীতি যদি করতেই হয়, আপনি আওয়ামী লীগ বা বিএনপি যে দলেরই হোন না কেন হিরো আলমের কর্মকাণ্ড কোনো ভালো উদাহরণ নয়।
যাই করেন- রাজনীতি, সংস্কৃতি, সমাজ, সংসার কোয়ালিটি নিশ্চিত করা প্রত্যেক ক্ষেত্রে ভীষণ জরুরি। তা যদি নিশ্চিত না করেন তবে আপনাকেই নষ্ট, পচা, গন্ধ নিয়ে থাকতে হবে। আর সেই গন্ধ আপনাকেও আক্রান্ত করবে, যার দায় কেউ নেবে না।
দিন শেষে পুঁজি তার মুনাফা তুলে নেবে। লোকসান হবে আপনার, লাভ হবে অন্যের।
লেখক: সম্পাদক, আজ সারাবেলা। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডট কম, যুক্তরাষ্ট্র।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম