শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ডিজিটাল সুস্থতা অপরিহার্য

ড. মতিউর রহমান
ড. মতিউর রহমান ড. মতিউর রহমান , গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।
প্রকাশিত: ০৯:০৫ এএম, ০৪ জুলাই ২০২৩

ইন্টারনেটসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অন্যান্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ইন্টারনেটে দীর্ঘ সময় ব্যয় করার ফলে আসীন আচরণ বৃদ্ধি পাওয়া এবং কায়িক পরিশ্রমের অভাব শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। শিক্ষার্থীদের শারীরিক অনুশীলন এবং বহিরাঙ্গন কার্যকলাপের অভাব অলসতার অনুভূতি ও বদমেজাজ বৃদ্ধি এবং সামগ্রিক সুস্থতা হ্রাস করতে অবদান রাখছে।

একদিকে ইন্টারনেট শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক ও বহির্বিশ্বের সাথে সংযোগের সুযোগ প্রদান করছে। অন্যদিকে অত্যাধিক অনলাইন ব্যস্ততা তাদের সামাজিক বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। শিক্ষার্থীরা মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে অনলাইনে অন্যদের সাথে আলাপচারিতায় বেশি সময় ব্যয় করছে, যা তাদের মধ্যে একাকিত্ব ও বাস্তব সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি তৈরিতে অবদান রাখছে।

ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো গুজব ছড়ানো, কাউকে লজ্জায় ফেলা, অনলাইন হুমকিসহ সাইবার বুলিং এবং উদ্দেশ্যমূলক হয়রানির স্থান হয়ে উঠছে। এই ধরনের প্রতিকূল অভিজ্ঞতা একজন শিক্ষার্থীর আত্মসম্মান, আত্মবিশ্বাস এবং সামগ্রিক মানসিক সুস্থতার ওপর উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাব ফেলতে পারে।

আঁচল ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে, প্রায় ৭২.২ শতাংশ শিক্ষার্থী ইন্টারনেট ব্যবহার করার সময় কোনো না কোনো সময়ে মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে, ইন্টারনেট ব্যবহারের অতিরিক্ত আসক্তি তাদের পড়াশোনায় মনোযোগ নষ্ট করছে। প্রায় ৩৪.৩ শতাংশ শিক্ষার্থী উল্লেখ করেছে যে, ইন্টারনেটে সময় কাটানো তাদের দৈনন্দিন জীবনে ‘খুবই নেতিবাচক' প্রভাব ফেলে।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইন্টারনেট ব্যবহার পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের ক্ষতি করে। সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ১৩.১ শতাংশ শিক্ষার্থী উল্লেখ করেছে যে, ইন্টারনেট ব্যবহার তাদের আত্মকেন্দ্রিক করে তুলেছে। এছাড়া ২৫.৭ শতাংশ শিক্ষার্থী উল্লেখ করেছে যে, ইন্টারনেট ব্যবহার করার সময় অনলাইনে ‘অপ্রয়োজনীয় কাজে’ সময় নষ্ট হয়।

প্রায় ৫৮.৭ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রতি রাতে পর্যাপ্ত ঘুমাতে পারে না। তাদের মধ্যে, ৩০.৪ শতাংশ শিক্ষার্থী ঘুমের অভাবের জন্য রাত জেগে ইন্টারনেট ব্যবহারকে সম্পূর্ণভাবে দায়ী করেছে। প্রায় ৩২.৯ শতাংশ শিক্ষার্থী ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফি বা যৌন ইঙ্গিতমূলক বিষয়বস্তু সম্পর্কিত ওয়েবসাইট ব্রাউজ করে।

আঁচল ফাউন্ডেশনের সমীক্ষায় আরও জানা গেছে যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। প্রায় ১০.১ শতাংশ শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অন্যদের সাফল্যে হতাশাবোধ করেন। এছাড়া ১০.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যের সাফল্যের খবরে ঈর্ষান্বিত হয়। অন্যদের সাফল্যের খবর জেনে প্রায় ১৮.৭ শতাংশ শিক্ষার্থী নিজেদের নিকৃষ্ট মনে করে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা বিভিন্নভাবে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্বকে প্রভাবিত করছে। সমীক্ষার তথ্য অনুসারে, ২৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ধৈর্য হারিয়ে ফেলে, ২৬ শতাংশ শিক্ষার্থী হঠাৎ রেগে যায় এবং ২৭.৭ শতাংশ শিক্ষার্থী নীরব হয়ে যায়।

সোশ্যাল মিডিয়া নিউজফিডে খারাপ খবরের প্রভাবও এ গবেষণায় তুলে ধরা হয়েছে। অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে, ২৩.৭ শতাংশ সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিদিন ভয়ঙ্কর খবর বা খারাপ খবর দেখে আতঙ্কিত হয়, ২১.৭ শতাংশ মানসিক আঘাতে ভোগে এবং ৩৭ শতাংশেরও বেশি ভয়ানক খবর পড়ে ও দেখে বিপন্ন ও বিষণ্ণ বোধ করে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ইন্টারনেট বা সোশ্যাল মিডিয়ার নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় ডিজিটাল সুস্থতা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দায়িত্বশীল ব্যবহার প্রচার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে স্ক্রিন টাইম পরিচালনা, একটি স্বাস্থ্যকর অনলাইন উপস্থিতি গড়ে তোলা, গঠনমূলক সমালোচনা, ইতিবাচক মূল্যায়ন, ডিজিটাল সাক্ষরতার প্রচার এবং পরিবার, স্কুল এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত উদ্বেগ সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনাকে উৎসাহিত করার কৌশলগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।

বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডিজিটাল সুস্থতা প্রচারের পাশাপাশি ডিজিটাল প্রযুক্তির সাথে একটি স্বাস্থ্যকর এবং ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলাও জরুরি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এজন্য ডিজিটাল ডিভাইস এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের সময়সীমা নির্ধারণ করতে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে হবে। এজন্য শিক্ষামূলক কার্যক্রম, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া এবং ব্যাপক প্রচারণা প্রয়োজন। একটি সুস্থ ভার্চুয়াল এবং বাস্তব জগতের কর্মকাণ্ডের মধ্যে ভারসাম্য উন্নীত করতে নিয়মিত বিরতি এবং অফলাইন কার্যকলাপকে উৎসাহিত করতে হবে।

ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করার সময় শিক্ষার্থীদের সচেতন হওয়ার গুরুত্ব শেখানো উচিত। তাদের ডিজিটাল অভ্যাস, চিন্তাভাবনা এবং আবেগ সম্পর্কে সচেতন হতে উৎসাহিত করতে হবে। প্রযুক্তির ব্যবহার উদ্দেশ্যমূলক, ইচ্ছাকৃত এবং মননশীল হওয়া উচিত। অনলাইনে অপ্রয়োজনীয় স্ক্রোলিং এবং মাল্টিটাস্কিং এড়ানো উচিত।

পর্যায়ক্রমিক ডিজিটাল ডিটক্স প্রচার করা যেখানে শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল ডিভাইস থেকে বিরতি নেয়। আউটডোর কার্যক্রম যেমন, খেলাধুলা, বই পড়া বা পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে মানসম্পন্ন সময় কাটানোর মতো কার্যকলাপগুলোকে উৎসাহিত করা। ডিজিটাল ডিটক্স শিক্ষার্থীদের রিচার্জ করতে, স্ট্রেস কমাতে এবং প্রযুক্তির সাথে স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে।

ডিজিটাল সুস্থতা প্রচার করে এমন ডিভাইস এবং অ্যাপে উপলব্ধ সরঞ্জাম এবং বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সচেতন করা। উদাহরণস্বরূপ, অনেক ডিভাইস এবং অ্যাপ স্ক্রিন টাইম ট্র্যাকিং, অ্যাপ ব্যবহারের সীমা এবং নোটিফিকেশনের মতো বৈশিষ্ট্যগুলো অফার করে। শিক্ষার্থীদের তাদের ডিজিটাল ব্যবহার কার্যকরভাবে নিরীক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ করতে এই সরঞ্জামগুলো ব্যবহার করতে উৎসাহিত করা।

শিক্ষার্থীদের অনলাইন নিরাপত্তা এবং তাদের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষিত রাখার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করা। নিরাপদ পাসওয়ার্ড, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্ল্যাটফর্মে গোপনীয়তা সেটিংস এবং অনলাইনে সংবেদনশীল তথ্য শেয়ার করার সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে তাদের শেখানো প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের দায়িত্বশীল ডিজিটাল নাগরিক হতে এবং অনলাইনে আলাপচারিতার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে সক্ষম করতে হবে।

ইতিবাচক অনলাইন সম্পর্ক গড়ে তুলতে এবং ডিজিটাল উদারতা প্রচার করতে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা। সম্মানজনক যোগাযোগ, সহানুভূতি এবং ডিজিটাল স্পেসে তাদের কথা ও কাজের প্রভাব সম্পর্কে শেখান প্রয়োজন। অনলাইনে ভালো বক্তব্য প্রচার করা এবং সাইবার বুলিং ও অনলাইন হয়রানিকে নিরুৎসাহিত করা।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডিজিটাল সাক্ষরতার দক্ষতা এবং সমালোচনামূলক চিন্তা করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। তাদের শেখানো কীভাবে অনলাইন তথ্য, ফ্যাক্ট-চেক সোর্স মূল্যায়ন করতে হয় এবং নির্ভরযোগ্য এবং অবিশ্বস্ত কন্টেন্টের মধ্যে পার্থক্য করতে হয়। ডিজিটাল ল্যান্ডস্কেপ নেভিগেট করতে এবং অনলাইনে জ্ঞাত সিদ্ধান্ত নিতে তাদের একটি সমালোচনামূলক মানসিকতা বিকাশে সহায়তা করা।

শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি মিথস্ক্রিয়া এবং অফলাইন সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিতে উৎসাহিত করা। এমন ক্রিয়াকলাপগুলোর প্রচার করা যা সামাজিক সংযোগগুলোকে উৎসাহিত করে, যেমন দলগত আলোচনা, দলগত প্রকল্প এবং সামাজিক কার্যক্রমে যুক্ত হওয়া। অনলাইন ক্রিয়াকলাপের পাশাপাশি বাস্তব জগতের সাথে সংযোগ গড়ে তোলার গুরুত্বের ওপর জোর দেওয়া।

পাঠ্যক্রমে ডিজিটাল সুস্থতা এবং মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করা। মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর অত্যধিক ডিজিটাল ব্যবহারের সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সচেতন করা এবং চাপ, উদ্বেগ এবং ডিজিটাল-সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার কৌশল সম্পর্কে অবহিত করা।

ডিজিটাল সুস্থতার প্রচারে পিতামাতা এবং অভিভাবকদের সম্পৃক্ত করা। বিভিন্ন সময়ে কর্মশালার আয়োজন করে তাদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান প্রদান করা, যা তাদের প্রযুক্তির সুষম ব্যবহারের গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে এবং বাড়িতে একটি স্বাস্থ্যকর ডিজিটাল পরিবেশ গড়ে তোলার কৌশল সম্পর্কে উদ্বুদ্ধ করে।

এ কৌশলগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পিতামাতা, সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এবং সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডিজিটাল সুস্থতার প্রচারের জন্য একসাথে কাজ করতে পারে। শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিয়ে ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথ্যপ্রযুক্তির সাথে একটি স্বাস্থ্যকর এবং ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সহায়তা করতে পারে।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম

ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করার সময় শিক্ষার্থীদের সচেতন হওয়ার গুরুত্ব শেখানো উচিত। তাদের ডিজিটাল অভ্যাস, চিন্তাভাবনা এবং আবেগ সম্পর্কে সচেতন হতে উৎসাহিত করতে হবে। প্রযুক্তির ব্যবহার উদ্দেশ্যমূলক, ইচ্ছাকৃত এবং মননশীল হওয়া উচিত। অনলাইনে অপ্রয়োজনীয় স্ক্রোলিং এবং মাল্টিটাস্কিং এড়ানো উচিত।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।