উৎসব আসুক ওদের জীবনেও

ড. হারুন রশীদ
ড. হারুন রশীদ ড. হারুন রশীদ , ডেপুটি এডিটর (জাগো নিউজ)
প্রকাশিত: ০৯:৪৪ এএম, ০২ জুলাই ২০২৩

পবিত্র ঈদুল আজহা পালিত হলো নানা উৎসব মুখরতায়। মুসলিম সম্প্রদায়ের দুই বড় ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে ঈদুল আজহা অন্যতম। ঈদুল আজহা ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর। আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য এই ত্যাগ। পশু কোরবানির মধ্য দিয়ে এই ত্যাগের রীতিটি পালন করা হয়। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর আমল থেকেই এই রেওয়াজ চালু হয়ে আসছে।

মহান আল্লাহর নির্দেশে তিনি তার প্রাণপ্রিয় পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি দিতে সম্মত হন এবং প্রস্তুতিও নেন। মহান আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট ও সদয় হন। হজরত ইসমাইল (আ.)-এর পরিবর্তে একটি দুম্বা কোরবানি হয়ে যায়। এ কারণেই কোরবানি হচ্ছে ত্যাগের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তাকে সন্তুষ্ট করা। এটা ত্যাগের চূড়ান্ত নিদর্শন। ত্যাগের মধ্যেই এর সার্থকতা।

পবিত্র ঈদুল আজহা আমাদের ত্যাগের শিক্ষাই দেয়। ঈদুল আজহা একই সঙ্গে ত্যাগ এবং আনন্দের। পরিবার-পরিজন মিলে একসঙ্গে ঈদ উদযাপন করার মধ্য দিয়ে এ আনন্দের ধারা বইয়ে যায়। বিশেষ করে শিশু-কিশোররা এক নির্মল আনন্দে মেতে ওঠে।

পবিত্র ঈদুল আজহায় পশু কোরবানি মানুষের মধ্যে ত্যাগের আবহ নিয়ে আসে। কোরবানির মাংস গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়েও অপার আনন্দ ও সওয়াব পাওয়া যায়। ধর্মীয় বিধানও এমনই। ঈদুল আজহাকে কেবল পশু জবাই আর মাংস খাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। কোরবানির ত্যাগের যে মহান আদর্শ সেটি ছড়িয়ে দিতে হবে সর্বত্র। মনের পশুকে পরাস্ত করে মানবিকতার উন্মেষ ঘটানোই হচ্ছে মূলকথা। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে ঐক্য এবং সংহতির পরিবেশ গড়ে তোলাটা জরুরি। কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘কোরবানি’ কবিতায় যেমনটি বলেছেন- “ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদবোধন!/ দুর্বল! ভীরু! চুপ রহো, ওহো খামখা ক্ষুব্ধ মন!/ ধ্বনি উঠে রণি’ দূর বাণীর, -/ আজিকার এ খুন কোরবানির!”

জীবনের নানা টানাপোড়েন এবং সংকট উজিয়ে ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল ও মহিমান্বিত হোক ঈদুল আজহা-এমন প্রত্যাশা থাকে বরাবরই। কিন্তু সবার জীবনের ঈদ আসে না-এটাও এক নিমর্ম বাস্তবতা।

যে পিতা-মাতা এক সময় সন্তানের ভরসাস্থল সেই পিতামাতাকেই কি না বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিতে হয়। একবিংশ শতাব্দীতে এসে এও এক নিষ্ঠুর অমানবিক বাস্তবতা। বিশেষ করে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় যেখানে পিতা-মাতা ভাইবোন সন্তানসন্তুতি মিলে যৌথ পরিবারে সবাই মিলে মিশে বাস করে সেখানে পিতামাতাকে বয়স হলেই বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেওয়া হবে-এ কেমন কথা!

মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে পিতামাতা সন্তানদের মানুষ করেন তারাই কি না বড় হয়ে পিতামাতাকে ছুড়ে ফেলেন। নিরুপদ্রব এবং স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাপনের আশায়। তখন এসব পিতামাতার দুঃখের কোনো অন্ত থাকে না। বিশেষ করে উৎসবের দিনগুলোতে তারা অপেক্ষায় থাকেন স্বজনের।

বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রসহ (বৃদ্ধাশ্রম) বেসরকারি পর্যায়েও রয়েছে বৃদ্ধাশ্রম। সাধারণ দরিদ্র পরিবারের বয়স্করা যেমন আছেন এসব বৃদ্ধাশ্রমে তেমনি ধনাঢ্য পরিবারের অনেক প্রবীণ ব্যক্তিরাও আছেন। কিন্তু সবার অবস্থা আজ এক। সবাই অসহায়। বয়সের ভারে ন্যুব্জ। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে একদিন সবাই বৃদ্ধ হবেন। আজ যে টগবগে তরুণ বয়সের ভারে সেও এক সময় ন্যুব্জ হবে। কিন্তু নির্মম পরিহাস হচ্ছে এই কথাটি কেউ মনে রাখে না। আজ বৃদ্ধ পিতামাতাকে যে সন্তান বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিচ্ছে কাল সেও যে তার সন্তান দ্বারা একই আচরণের শিকার হবে না তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে।

প্রবীণরা তাদের সমগ্র কর্মময় জীবন নিজ নিজ পরিবার গঠনে ও উন্নয়নে এবং সমাজ জাতির সার্বিক কল্যাণে ব্যয় করে বার্ধক্যে উপনীত হন। কিন্তু এই সমাজ তাদের কথা মনে রাখে না। ফলে শেষ বয়সে তাদের আশ্রয় হয় বৃদ্ধাশ্রমে। স্বাভাবিক নিয়মেই সন্তান সন্ততিরা তাদের পিতামাতার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন করার কথা। বাঙালি একান্নবর্তী পরিবারের সংস্কৃতি এটাই। কিন্তু সময়ের অভিঘাতে পাল্টে যাচ্ছে সমাজ ব্যবস্থা। সেই সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে মূল্যবোধও।

নানা বাস্তবিক কারণে একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে। তাই পিতামাতার স্থান হচ্ছে না সেখানে। অনেক পরিবারেই পিতামাতার ভরণ-পোষণকে কেন্দ্র করে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া বিবাদ লেগেই আছে। এ কারণেই ঝুট-ঝামেলা এড়াতে পিতামাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে তাদের জীবন কীভাবে কাটে সে ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়াটাও অনেকে প্রয়োজন মনে করে না। এই নিষ্ঠুর অমানবিকতা মনুষ্যত্বের পরিচয় বহন করে না।

এছাড়া আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধও তা সমর্থন করে না। এমনকি ঈদ কিংবা অন্যান্য বিশেষ দিনেও যদি পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের কোনো খোঁজ নেওয়া না হয় এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে। এক্ষেত্রে সরকারেরও কি করণীয় কিছু নেই? সিনিয়র সিটিজেনদের অধিকার রক্ষায় সরকারি তৎপরতা বাড়াতে হবে। এছাড়া মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, সমাজে ধর্মীয় অনুশাসন এবং নৈতিক, সামাজিক মূল্যবোধের অনুশীলন এক্ষেত্রে একান্ত অপরিহার্য। সমাজের একজন প্রবীণও যেন অবহেলা অনাদরে জীবন যাপন না করে সেটি নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট। ডেপুটি এডিটর, জাগো নিউজ।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/এমএস

সিনিয়র সিটিজেনদের অধিকার রক্ষায় সরকারি তৎপরতা বাড়াতে হবে। এছাড়া মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, সমাজে ধর্মীয় অনুশাসন এবং নৈতিক, সামাজিক মূল্যবোধের অনুশীলন এক্ষেত্রে একান্ত অপরিহার্য। সমাজের একজন প্রবীণও যেন অবহেলা অনাদরে জীবন যাপন না করে সেটি নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।