রোটারির জয়ধ্বনি কর!
১৯৭৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ফিলিপিন্সের রাজধানী ম্যানিলার ম্যাকার্টিতে রোটারি ইন্টারন্যাশনালের সে সময়কার প্রেসিডেন্ট রোটারিয়ান জেমস এল বোমার জুনিয়ার প্রথম একটি ফিলিপিনো শিশুকে পোলিও টিকা খাইয়ে ফিলিপিন থেকে পোলিও নির্মূলের যে যুদ্ধের সূচনা করেছিলেন, তার ৪৩ বছরের মাথায় এসে ফিলিপিনের সব শিশুতো বটেই, পৃথিবীজুড়ে প্রায় আড়াই বিলিয়ন শিশু রোটারির উদ্যোগে পোলিও টিকা খেয়ে পোলিওমুক্ত সুস্থজীবনের গ্যারান্টি পেয়েছে। ফিলিপিন্সে পোলিও টিকা কর্মসূচির সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে রোটারি ইন্টারন্যাশনাল ১৯৮৫ সালে রোটারি পোলিও প্লাস প্রোগ্রামটি যাত্রা করে। তারপর ১৯৮৮ সালে বিশ্বব্যাপী যে গ্লোবাল পোলিও ইরেডিকেশন ইনিশিয়েটিভ, তারও প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য রোটারি ইন্টারন্যাশনাল।
ফিলিপিন্সে রোটারির সেই উদ্যোগ আজ রোটারিকে সারাবিশ্বে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। রোটারি আর পোলিও এখন একে অপরের পরিপূরক। সারা পৃথিবীতে পোলিও নির্মূলে তহবিলের অন্যতম জোগানদার রোটারি ইন্টারনাশনাল। একটা সময় ছিল যখন পৃথিবীতে প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ মানুষ পোলিওতে আক্রান্ত হতেন। সফল টিকাদান কর্মসূচির অবর্তমানে পৃথিবী এখন যেখানে কয়েক কোটি পোলিও আক্রান্ত বিকলাঙ্গ মানুষের আবাসভূমি হওয়ার কথা, সেখানে বাংলাদেশের রোটারি ন্যাশনাল পোলিও প্লাস কমিটির সূত্রে জানা যাচ্ছে, পৃথিবীতে বর্তমানে পোলিও আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা মাত্র পাঁচজন। এদের মধ্যে চারজন আফগানিস্তানে আর একজন পাকিস্তানে। তাও হয়তো থাকতো না যদি এই দুটি দেশের মৌলবাদীরা পোলিওর টিকা খাওয়ানোকে হারাম ঘোষণা করে এর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা না করতো।
পোলিও টিকা খাওয়ানোর অপরাধে এ দুটি দেশে যেখানে মৌলবাদীর গুলি খেতে হয় টিকাকর্মীকে, সেখানেও যে এখনও পোলিও রোগীর সংখ্যা মাত্র পাঁচজন এটাওতো রোটারিরই সাফল্য। আজ যখন আমরা গর্ব করে বলি যে পৃথিবী থেকে আমরা পোলিওকে প্রায় নির্মূল করতে চলেছি, তখন পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রত্যেক রোটারিয়ান সেই গর্বিত সাফল্যের অংশীদারত্ব দাবি করতেই পারেন। কারণ রোটারি ফাউন্ডেশনে আমাদের প্রত্যেক রোটারিয়ানের যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কন্ট্রিবিউশন তারই কিউমিলেটিভ ফলাফল হচ্ছে পৃথিবী থেকে পোলিওর এই প্রায় বিলুপ্তি।
এখন যখন পোলিও প্রায় ইতিহাসের অংশ, পৃথিবীব্যাপী রোটারিয়ানরা নিশ্চই তখন হাতগুটিয়ে বসে থাকতে পারেন না। তারা তা থাকবেনও না, কারণ এটা রোটারিয়ানদের ধারের মধ্যে নেই।
সঙ্গত কারণেই হাতগুটিয়ে বসে নেই বাংলাদেশের রোটারিয়ানরাও। আমাদের লক্ষ্য এখন হেপাটাইটিস বি। প্রতিবছর শুধু বাংলাদেশেই লিভার রোগে মারা যাচ্ছেন প্রায় সাড়ে ২২ হাজার মানুষ। এদেশে ক্যানসারে ভুগে যে মানুষগুলো মৃত্যুবরণ করেন তাদের মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ লিভারের ক্যানসার। আর এই যে এতসব লিভার রোগ আর এসবের এত এত ভয়াবহতা, এসব কিছুর মূলেই আছে হেপাটাইটিস বি। কারণ আমাদের দেশে ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ লিভার সিরোসিস আর লিভার ক্যানসারের জন্য এককভাবে দায়ী এই ভাইরাসটি।
আর শুধু বাংলাদেশই বা বলছি কেন? পৃথিবীজুড়েই তো এই একই হাল, বিশেষ করে আমাদের এই এশীয় মহাসাগরীয় অঞ্চলে। ইউরোপ-আমেরিকায় হেপাটাইটিস সি ও অ্যালকোহলজনিত লিভার রোগী খুঁজে পাওয়া গেলেও, এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, যেখানে বাস করে পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষ, সেখানে লিভার রোগের আর লিভার রোগীর মূল কারণই তো হেপাটাইটিস বি। অথচ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত বড়জোড় পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ মানুষের জানা আছে যে তারা এরকম একটি কঠিন রোগে আক্রান্ত। এদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই হয়তো স্বাভাবিক নিয়মে মৃত্যুবরণ করবেন, কিন্তু এও তো সত্যি যে তাদের মধ্যে এমন আরও অনেক মানুষই আছেন যাদের মাথার ওপর একদিন বিনামেঘে বজ্রপাত হবে। কারণ তারা সহসাই জানতে পারবেন যে তারা হেপাটাইটিস বি’র কারণে লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন, অথচ টেরও পাননি কখন কীভাবে এতবড় ক্ষতিটা হয়ে গেলো।
এই যখন বাস্তবতা, তখন সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল ৩.৩ অর্জন করেই ছাড়বো, অর্থাৎ পৃথিবী থেকে আমরা ঝেটিয়ে বিদায় করবো হেপাটাইটিস বি আর বি-ভাইরাসজনিত খারাপ যত অসুখ-বিসুখ। কাজটা এমনিতেই কঠিন এবং জটিল, কারণ আমাদের প্রথম কাজটাই হবে মানুষকে বোঝানো যে তাদের পরীক্ষা করে জেনে নিতে হবে যে তারা হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত কি না, তা তাদের কোনো লক্ষণ থাকুক, চাই না-ই থাকুক। আরও লক্ষ্যণীয় হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত সিংহভাগ মানুষেরই যেহেতু কোনো লক্ষণ থাকে না, কাজেই মানুষকে এ ব্যাপারে সচেতন করাটাও খুব কঠিন।
তাছাড়া হেপাটাইটিস বি নিয়ে আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে নানা কুসংস্কারও। অনেকেরই ধারণা হেপাটাইটিস বি আছে এটি জানা গেলে তাদের পারিবারিক এবং সামাজিক অবস্থান ক্ষুণ্ন হবে। সমস্যা আছে আরও। বেশিরভাগ মানুষই তার হেপাটাইটিস বি ইনফেকশনের কথা জানতে পারেন অনেক দেরিতে যখন রোগের লক্ষণগুলো দেখা দেয়, অর্থাৎ রক্তবমি থেকে শুরু করে পেটে পানি আসা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, লিভারে ক্যানসার আর এমনি হাজারো সমস্যায় জর্জরিত হয় জীবন। কাজেই মানুষের মধ্যে হেপাটাইটিস বি নিয়ে এক ধরনের ভীতি কাজ করে। মানুষ হেপাটাইটিস বি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়। তারা জানতেই চায় না তাদের হেপাটাইটিস বি আছে কি নেই!
এতসব ঝুট-ঝামেলা পেরিয়ে মানুষকে সচেতন করলেই হবে না, যাদের হেপাটাইটিস বি আছে তাদের যেমন একদিকে চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসতে হবে, তেমনি তার চেয়ে বড় কাজটি হলো যাদের হেপাটাইটিস বি নেই তাদের টিকার আওতায় আনা। এটি কোনো সাধারণ কাজ নয়। কাজটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ সাকা হাপাংয়ের মতোই চ্যালেঞ্জিং। মাঝে কোভিড এসে কাজকে আরও জটিল করে তুলেছে। এখন চ্যালেঞ্জটা আরও বড়- এভারেস্টতুল্য। তবে কথায় আছে না একের জন্য যা বোঝাসম, দশের জন্য তাই লাঠিতুল্য। আশাকরি এই পাহাড়সম চ্যালেঞ্জটিও আমরা সফলভাবে উতরে যাবো, কারণ বাংলাদেশের রোটারির ভিশনারি নেতৃত্ব এখন হেপাটাইটিস বি-ও নির্মূলের যুদ্ধে সামিল হয়েছেন।
রোটারি ডিস্ট্রিক্ট ৩২৮১-এর পাস্ট ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর রোটারিয়ান খায়রুল ভাইয়ের হাত ধরে যে উদ্যোগটির হাঁটি হাঁটি পা পা, তাই জোড়কদমে হাঁটতে শুরু করে তারপরের ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর রোটারিয়ান ইঞ্জিনিয়াার ওহাব ভাইয়ের সময়। আর এখন সদ্যদায়িত্ব নেওয়া ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর রোটারিয়ান নান্নু ভাই দায়িত্ব নিতে না নিতেই তো এটি উড়তে শুরু করেছে! আমার দফায় দফায় বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে এ নিয়ে রোটারিয়ান নান্নু ভাইয়ের সঙ্গে। অদম্য স্প্রীহা আমার ক্লাব, রোটারি ক্লাব অব ঢাকা জেনারেশন নেক্সটের ইমিডিয়েট পাস্ট প্রেসিডেন্ট রোটারিয়ান পর্না সাহারও। আমি হাঁটলে তিনি ছুটতে থাকেন। রোটারির ইয়ার লঞ্চিং র্যালিতেই ছিল হেপাটাইটিস বি স্ক্রিনিংয়ের বিশাল আয়োজন।
পুরো ডিস্ট্রিকজুড়েই এখন চলছে সাজসাজ রব। পুরো বছরজুড়ে আয়োজিত হতে থাকবে অসংখ্য-অজস্র স্ক্রিনিং, ভ্যাকসিনেশন আর বিশেষায়িত লিভার ক্যাম্প। আর আমি নিশ্চিত যে এসব অব্যাহত থাকবে সামনের দিনগুলোতেও। এরই মাঝে কথা হয়েছে ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর ইলেক্ট রোটারিয়ান পিনাক ভাই আর ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর নমিনি রোটারিয়ান শাহিদুল ভাইদের সঙ্গেও। প্রত্যেকে কথা দিয়েছেন তারা এই ধারা টেনে নিয়ে সামনে ছুটবেন। ভালোই বুঝেছি তারা শুধু কথার কথা দেননি, কথাগুলো বলেছেন অন্তর থেকে। অতএব আমি নিশ্চিন্ত।
ডিস্ট্রিক্টে গঠন করা হয়েছে হেপাটাইটিসের বিশেষ কমিটিও। চেয়ারম্যানের দায়িত্বটা পেয়েছি আমি। সঙ্গে আছেন একদল উদ্যমী তরুণ হেপাটোলজিস্ট আর নিবেদিতপ্রাণ রোটারিয়ান। নতুর রোটারি বছরের শুরুতে যে র্যালি সেখানে ডিস্ট্রিক্ট গভর্নরের উদ্যোগে প্রায় ৫০০ রোটারিয়ানের হেপাটাইটিস বি স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা ছিল। যাকে বলে কথার সঙ্গে কাজের দারুণ মিল আর কী। ডিস্ট্রিক্ট গভর্নরের স্বপ্ন আগামী রোটারি বছরে এক লাখ মানুষকে হেপাটাইটিস বি’র জন্য স্ক্রিনিং করা, আর পাশাপাশি ১০ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে ভ্যাকিনেশনের আওতায় নিয়ে আসা। এরই মধ্যে ডিস্ট্রিক্টের অনেক সচ্ছল ব্যক্তিই এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছেন। একদিন ফিলিপিনের সীমানা ছাপিয়ে সাড়া পৃথিবী থেকে পোলিও নির্মূলে রোটারির যে জয়গাথা তার পুনরাবৃত্তি যে হেপাটাইটিস বি’কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রোটারিয়ানরা ঘটাতে যাচ্ছেন তার ইঙ্গিতগুলো এরই মধ্যে স্পষ্ট। অতএব আমরা তো রোটারির জয়ধ্বনি করতেই পারি!
লেখক: ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
এইচআর/বিএ/এএসএম