ঋণ নেবার নতুন দরোজা
গত ২০ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল একটি বিল উত্থাপন করেছেন। বিলের নামটি সুন্দর। ‘সুরক্ষিত লেনদেন (অস্থাবর সম্পত্তি) বিল-২০২৩’। অস্থাবর সম্পত্তির বিনিময়ে মানে বন্ধক রেখে যে কোনো নাগরিক তার প্রয়োজন মোতাবেক ঋণ নিতে পারবেন। তবে অস্থাবর সম্পত্তি সম্পর্কে কিছু ভিত্তি বর্ণিত হয়েছে, যা বিল পড়ে ও বুঝে মনে হবে,--- না, শক্ত গেরো দেওয়ার আয়োজন আছে। অতএব এই বিল আইনে পরিণত হলে ব্যাংকগুলো ঋণ দিয়ে তা ফেরৎ পাবে বা পেতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি আগামী ১৫ দিনের মধ্যে বিলটি চেক করে রিপোর্ট দিলে তা আইনে পরিণত হবে। বিল উত্থাপনের পর জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম এই বিল উত্থাপনের আপত্তি জানালে তা কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। এই হলো পত্রিকার রিপোর্টের উপরিকাঠামো। ভেতরে আরও অনেক কথা, অনেক তর্ক ও অনেক নাখোশ হওয়ার বা আনন্দ অর্জনের ঘটনা ঘটে চলেছে। কেননা, যে কোনো আইনের ভালো দিক আর মন্দ দিক— দুটোই থাকে।
জাতীয় সংসদের এই সিনটি (দৃশ্য/ ইমেজটি) মনে রাখলে ভালো হবে। জানি না, ফজলে ইমাম সাহেব কেন সম্মিলিত কণ্ঠভোটারদের বিরুদ্ধে গিয়ে বা তার আগেই তিনি বিল উপস্থাপনের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি কি তার নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের মুখ দেখতে পেয়েছিলেন যে তারা এই বিল চায় না? আবার এটাও হতে পারে, তিনি ঋণগ্রহিতা নন। এবং অস্থাবর সম্পদ বন্ধক রেখে ঋণ নিতেও তার প্রয়োজন নেই। তাই ঋণীদের কাতারে কেউ গিয়ে যোগ হোক, তাও তিনি চান না। কিন্তু যারা সম্মিলিতভাবে কণ্ঠভোটে ফজলে ইমামের প্রতিবাদকে উড়িয়ে দিলেন, তারা কি সবাই ব্যবসায়ী এবং ভবিষ্যতে অস্থাবর সম্পত্তি জমা দিয়ে ঋণ নেওয়ার মানসিকতায় ফজলে ইমামকে বসিয়ে দিলেন? নাকি সংবিধানের বিধান মানতে তারা নিজেদের অধিকার কেটে ফেললেন ধারালো অস্ত্রে। বিলের বিরোধিতা করলে, সেই সব সংসদ সদস্য দলীয় এমপি পদ হারাবেন এবং সংসদ থেকে বিতাড়িত হবেন। এমনকি তিনি বা তারা নির্দলীয় সংসদ সদস্যও থাকতে পারবেন না।
এরকম বিধান বা প্রবিধান জাতীয় সংসদের সরকারদলীয় সংসদ সদস্যদের একান্ত বাধ্যগত সংসদ সদস্য হিসেবে সৃষ্টি করেছে। সংসদ সদস্যরা নিজের বুদ্ধি-মেধা-প্রজ্ঞা দিয়ে কোনো বিল সমর্থন ও বিরোধিতা করতে পারেন না। কারণ সেই ক্ষমতা কেটে রাখা হয়েছে সংসদ নেতার হাতে।
আমাদের জাতীয় সংসদের ৬০-৬৫% সংসদ সদস্য ব্যবসায়ী শ্রেণি থেকে এসেছেন। কেউ রাজনীতিসূত্রে ব্যবসায়ী, কেউ বা ব্যবসাসূত্রে রাজনীতিক। প্রকৃত রাজনীতিক, যারা আজীবন রাজনীতিকেই আঁকড়ে ধরে আজ সংসদ সদস্য হয়েছেন, এদের সংখ্যা নিতান্তই কম। তৃণমূল থেকে জাতীয় স্তরে উঠে আসা নেতাকর্মীর সংখ্যা কম হওয়ার কারণ, পদ আর পদবি দুটোই অর্থের কাছে পরাভূত হয়। একমাত্র ফজলে ইমামের প্রতিবাদ বা বিরোধিতাকে যখন ডুবিয়ে দেওয়া হলো তখন বোঝা গেলো বিলটি অবশ্যই অতীব জরুরি। স্থাবর সম্পত্তির বৈধ কাগজ জমা রেখে যেখানে ঋণগ্রহিতা ঋণ নিয়েও ফেরত দেয় না, সেখানে অস্থায়ী সম্পদের বিনিময়ে নেয়া ঋণ গ্রহিতারা ফেরত দেবে, এরকম যারা ভাবেন, তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন।
সংসদে ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধনী পাস হয়েছে গত ২১ জুন। সমকালের রিপোর্ট পড়ে দেখা যাকঃ
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এবারও ব্যাংকের মালিকদের আবদার পূরণ করল সরকার। ব্যাংকে পরিচালক পদে টানা ১২ বছর থাকার সুযোগ দিয়ে গতকাল ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। সংসদে উপস্থাপিত বিলে ৯ বছরের প্রস্তাব থাকলেও শেষ পর্যন্ত ১২ বছর নির্ধারণ করে আইনটি পাস হলো। কোনো ব্যক্তি বা গ্রুপের স্বার্থসংশ্লিষ্ট এক প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে অন্য প্রতিষ্ঠানকে খেলাপি দেখানো যাবে না– এমন সুযোগও রাখা হয়েছে। তাদের ঋণ পেতেও কোনো সমস্যা হবে না। ব্যবস্থা চালতেও পারবেন নির্বিঘ্নে।
সম্প্রতি ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) আইনে এ দুটি বিষয় যুক্ত করার সুপারিশ করে। এর মধ্যে গত ৮ জুন বিলটি সংসদে উঠলে এক সপ্তাহের মধ্যে পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দিতে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। বিলটি পাসের আগ মুহূর্তে সরকারি দলের সদস্য আহসানুল ইসলাম টিটোর আনা সংশোধনী গ্রহণ করা হয়।
ঋণ নেওয়ার জন্য অস্থায়ী সম্পদ গচ্ছিত রাখার বিধান আর ব্যাংকের পরিচালকরা টানা ১২ বছর থাকতে পারবেন। ব্যাংক উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা তো পরিবারের লোকজন, ফলে যারা ব্যাংকের মালিক, তারাই আবার ঋণ নেওয়ার প্রধান হোতা। এখন আর বেনামি ও কাগজপত্র জালিয়াতির প্রয়োজন পড়বে না, ডাইরেক্ট ঋণ নিয়ে চলে যাবেন নিউ ইয়র্কে বা লন্ডনে। সেখানেই থাকবেন, মাঝে মধ্যে দেশে এসে আরও কিছু লোকের নামে বেনামি বা অস্থাপর সম্পত্তির নামে ঋণ নেবেন। ঋণের টাকা ফেরৎ দেওয়ার কোনো বালাই বা ঝামেলা নেই।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) আইনে দুটি বিষয় কেন যুক্ত করতে সুপারিশ করেছিল, তা এখন পরিষ্কার। কি রকম পরিষ্কার সে কথা বলেছেন জাতীয় সংসদেএই আইন সংশোধনের বিরোধিতাকারী জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা, তাদের জবানিতেই তা শোনা যাক। : সংসদে জাতীয় পার্টির সদস্যরা পরিচালক পদের মেয়াদ বাড়ানোর কঠোর সমালোচনা করে বলেন, দেশে খেলাপি ঋণের জন্য মূলত দায়ী এ ধরনের পরিচালক। এদের পক্ষ নিয়ে সরকার কেন পরিচালকদের মেয়াদ বাড়াচ্ছে? তাঁরা বলেন, পরিচালকদের মেয়াদ আজীবন রেখে আইন পাস করে দেওয়া হোক। লুটপাট যখন করবেই; আজীবন করুক। তারা খেতে থাক; আমরা দেখতে থাকি। এর আগে সর্বশেষ ২০১৮ সালে আইনটি একবার সংশোধন করা হয়েছিল। তখন ব্যাংক মালিকদের চাপে এক পরিবার থেকে চারজন এবং টানা ৯ বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকার সুযোগ রাখা হয়েছিল। (সমকাল/২২ জুন, ২৩)
মিছামিছি কি কথাগুলো বলেছেন সাংসদরা? সে বিচার কে করবেন? আমরাও তো দেখছি খেলাপি হয়ে যাওয়া ঋণগুলো ব্যাংকে ফেরে না। ফেরানোর জন্য যে সব আইনি শক্তি আছে তা ব্যবহার করেন না ব্যাংকারগণ। কারণ, ওই খেলাপিগণ মূলত ব্যাংকগুলোর পরিচালক বা তাদেরই আত্মীয়স্বজন ও রাজনৈতিক সহকর্মীগণ নিয়েছেন। এরা ঋণ নেবেন আর তা ফেরৎ না দেওয়ার তরিকায় চলেন। আবার তারাই ব্যাংক আইন সংশোধন করার প্রস্তাব বা সুপারিশ করেছিলেন অর্থমন্ত্রীকে। অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল নিজেও একজন ব্যবসায়ী। ফলে তিনি কনভিন্স হয়েছেন কি ভেবে তা সাধারণ মানুষ বোঝে। নীতিটা হচ্ছে এই রকমঃ আসুন, নিজেরা ব্যাংক গড়ি, নিজেরাই ঋণ নিই এবং নিজেরাই খেলাপি হই। এই ধারাই চলছে। আর তাকে আরও বিস্তৃত পরিসর দিলেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল। এটা দুঃখজনক। কেন এ-কথা বললাম? কারণ, ব্যাংকগুলোতে সাধারণ মানুষই আমানত রাখে। কিন্তু তারা বলতে গেলে ঋণ পায় না, ঋণ নেয়ও না। যারা নিতে যায় তারা কাগজপত্র জোগারের জন্য যে রকম হেনস্থা হয়, তাতে সেবা উবে যায়।
গরিবের আমানতেই শক্তিশালী ব্যাংকগুলো। সেই আমানতই তো ঋণগ্রহিতাদের টাকা দেওয়া হয় লাভের আশায়। কিন্তু জনগণের টাকা হরিলুট হলে ক্ষতি কী ---এই মনোভাবই প্রকাশ পেলো এইেআইন সংশোধনীতে? অর্থনীতিবিদ ও পরিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, মালিকপক্ষের আবদারে এই সংশোধনীর ফলে উদ্যোক্তা পরিচালকদের দৌরাত্ম্য বাড়বে। তিনি বলেন, এক প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে গ্রুপভুক্ত অন্য প্রতিষ্ঠানকে খেলাপি না করার বিধান বিশ্বের অন্য কোথাও আছে বলে জানা নেই। ফলে এখন অনেকে একটি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে ইচ্ছা করেই খেলাপি হবে। এতে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য চালাতে কোনো সমস্যা হবে না। ফলে খেলাপি হওয়ার সংস্কৃতি বাড়বে। এভাবে ব্যাংক খাতকে সরকার কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, বোধগম্য নয়।
বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সদস্যরা সংশোধনী উত্থাপনেরই বিরোধিতা করেছিলেন। না পেরে তারা ওয়াকআউট করেন।
অনুমান করা যায় সরকার ব্যাংকের টাকা লোপাট করার ফন্দি করেই বিএবির ইচ্ছার কাছে (ব্যাংকের মালিকরা সরকারি দলের পক্ষেরই লোক, তারা টাকার ব্যবসা করেন) নতিস্বীকার করেছে। আমরা তো জানি, সংবাদপত্রেও বহুবার ওই সব তথ্য প্রকাশ পেয়েছে যে বাজেটে সরকারের একটি বড় খাত হচ্ছে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেই বড় অংকের টাকাটা ঋণ নেয় সরকার। দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকেও মোটা দাগের ঋণ নেয়। সেই ঋণের টাকা কতটা ফেরৎ আসে বলা মুশকিল। তথ্য হচ্ছে সরকার আজও ১ লাখ ২ হাজার কোটি টাকার ঋণ বকেয়া রেখে চলেছেন। প্রতিবছর ওই ঋণের সুদ গুনতেই সরকারি বাজেটের/তহবিলের একটি বড় অংশ ব্যয় হয়। এবার আরও যোগ হবে আইএমএফ-এর ৪৭০ কোটি ডলারের আংশিক সুদ গোনা।
সরকার গত ১৫ বছরে পাচার হয়ে যাওয়া টাকা ফেরৎ আনতে পারেনি প্রণোদনার ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও। ঋণখেলাপিদের সুযোগ দেওয়ার পরও তারা ফেরৎ দেয়নি বা দিচ্ছে না। সরকারের আশেপাশেই তারা ঘোরাঘুরি করেন প্রতিদিন, কিন্তু তাদের সরকার দেখেন না। অথচ অর্থমন্ত্রী বললেন, ১৫ বছরে ৫% খেলাপি ঋণ কমেছে। তাই যদি হয়, তাহলে ঋণ নেয়া টাকা ফেরৎ দিচ্ছে না কারা, কারা? তাদের তালিকা জানানো হোক জনগণকে। ঋণ ফেরতের বিষয়টি তো হান্ড্রেড পারসেন্ট হওয়ার কথা। যিনি বা যে সব প্রতিষ্ঠান ঋণের টাকা সময়মতো ফেরৎ দেবেন না, তাদের পুনরায় ঋণ নেওয়ার সুযোগ কেন তৈরি করলেন মাননীয় অর্থমন্ত্রী? জাতীয় পার্টির নেতা কাজী ফিরোজ রশিদ বলেছেন ব্যাংক উদ্যোক্তাদের কাছে জিম্মি হয়েছেন সরকার। আর মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন পরিচালকরা ব্যাংক লুটপাটের মূল হোতা। এই অপবাদ সরকার ঢাকবেন কোন ঢাকুন দিয়ে? এটা তো জনগণের টাকা লুটে নেওয়ার একটি প্রকাশ্য ফন্দি।
লেখক: কবি, সাংবাদিক।
এইচআর/ফারুক/এএসএম