চক্র ভয়ঙ্কর: অজ্ঞানপার্টি মলমপার্টি

ইয়াহিয়া নয়ন
ইয়াহিয়া নয়ন ইয়াহিয়া নয়ন , সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৯:৪৯ এএম, ২৭ জুন ২০২৩

ঈদ এলেই রাজধানীসহ সারাদেশে বেপরোয়া হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর অজ্ঞানপার্টি চক্র। তা সামাজিক ও জাতীয় উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এমন অপরাধ। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন জানায়, রাজধানীতে গত এক মাসে এসব চক্রের কবলে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন তিনজন।

এই তিন প্রাণহানি ছাড়াও গত ৩০ দিনে অজ্ঞানপার্টির কবলে পড়ে ঢাকা মেডিকেল ও মিটফোর্ড হাসপাতালসহ রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে অন্তত ৭২ জন পুরুষ ও নারীকে। সর্বশেষ হিসাবে ঢাকা মেডিকেল ও মিটফোর্ডে এখনো ভর্তি আছেন অন্তত ২০ জন। তাদের কারও কারও অবস্থা সংকটাপন্ন। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক।

এই অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা তিন ধাপে কাজ করে। প্রথম ধাপে থাকে হকাররা। নির্ধারিত হকার ডাব, শরবত বা কোমল পানীয়ের সঙ্গে অজ্ঞান করার ট্যাবলেট সুকৌশলে মিশিয়ে টার্গেট করা ব্যক্তিকে খাইয়ে দেয়। খাওয়ার পর থেকেই তাকে অনুসরণ করতে থাকে অজ্ঞান পার্টির দ্বিতীয় ধাপের সদস্যরা। আর তৃতীয় ধাপের সদস্যরা টার্গেট করা ব্যক্তি অচেতন হয়ে পড়লে, তার সঙ্গে থাকা টাকা-পয়সা ও মূল্যবান মালামাল নিয়ে পালিয়ে যায়। হাতিয়ে নেওয়া টাকা-পয়সা ও মূল্যবান সামগ্রী জমা হয় পার্টির প্রধানের কাছে। পরে সেগুলো ভাগ-বাটোয়ারা হয়।

অজ্ঞান করার কাজে ব্যবহৃত হয় আমদানি নিষিদ্ধ চেতনানাশক ওষুধ। চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি নিষিদ্ধ চেতনানাশক ওষুধে সয়লাব পুরো মিডফোর্টের ওষুধ মার্কেট। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা ওইসব বিক্রি করছেন অপরাধীদের কাছে। অনেক সময় অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা দ্রুত টার্গেট করা ব্যক্তিকে অজ্ঞান করতে অতিমাত্রায় চেতনানাশক ওষুধ ব্যবহার করে, যা অত্যন্ত ক্ষতিকর। অনেক সময় দেখা যায় অজ্ঞানপার্টির কবলে পড়া ব্যক্তি আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। তার আচার-আচরণ ও চলাফেরা অস্বাভাবিক হয়ে গেছে। কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার, ভাবতেই গা শিউরে ওঠে।

যাত্রীবাহী বাস, ট্রেন, লঞ্চ, ফেরি-ফেরিঘাট, বাস টার্মিনাল রেলস্টেশন কোথাও নিরাপদ নয় লোকজন। শুধু সাধারণ মানুষই নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও এদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। হকার কিংবা সহযাত্রী-বন্ধু সেজে সাধারণ মানুষের সব কিছু কেড়ে নিচ্ছে এই অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা।

রাজধানীতে সম্প্রতি এ ধরনের কয়েকটি ঘটনা ঘটে। আর পুলিশ বলছে, এদের দৌরাত্ম্য থামাতে পুলিশের একটি বিশেষ দল মাঠে কাজ করছে। অনেককে ধরে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তবে তাদের কোনোভাবেই নির্মূল করা যাচ্ছে না। এজন্য পথচারী বা যাত্রী সবাইকে সতর্ক হতে হবে। আমরা সবাই সচেতন হলে কিন্তু ওদের তৎপরতা কমে আসবে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের কারণে অজ্ঞানপার্টির অপকর্মে কিছুদিন ভাটা পড়েছিল। এখন ফের বেপরোয়া হয়ে উঠেছে তারা। বিশেষ করে বাস ও লঞ্চ টার্মিনাল এবং রেলস্টেশনসহ অর্ধশত স্পটে তৎপর তাদের বিশেষ ট্রেনিং পাওয়া সদস্যরা। পথে-ঘাটে টার্গেট করা ব্যক্তিকে বাগে আনতে কখনো যাত্রী, কখনো হকার, কখনো বা সাধারণ ক্রেতা কিংবা বিক্রেতার বেশ ধরে তারা।

কয়েক বছরধরে রাজধানীতে প্রতিনিয়ত মানুষ অজ্ঞানপার্টির শিকার হচ্ছে। দুঃখের বিষয় হলো, অপহরণকাণ্ডে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানানো হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুরাহা হচ্ছে না। আবার অজ্ঞানপার্টি ও অপরাধীদের হুমকি-ধমকির কারণে অনেক ভুক্তভোগী বা তাদের স্বজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের কাছে অভিযোগ জানাতেই সাহস পাচ্ছেন না। অনেক স্বজন র‌্যাব-পুলিশকে না জানিয়ে অজ্ঞানপার্টি ও অপহরণকারীদের হাতে মুক্তিপণের টাকা তুলে দিচ্ছেন। সরকারি খাতায় এসব ঘটনা লিপিবদ্ধ হচ্ছে না। এজন্য অধিকাংশ চক্রের সদস্যরা থেকে যাচ্ছে অধরা। কোনো কোনো ঘটনা ঘটছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে।

সাধারণ মানুষের মধ্যে জেঁকে বসছে অপহরণ আতঙ্ক। অন্যদিকে বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও ভাবিয়ে তুলেছে। তাদের পক্ষে বলা হচ্ছে যে, অজ্ঞানপার্টি সদস্যদের বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু তারা জামিন পেয়ে বেরিয়ে এসে আবারও অপহরণের মতো অপরাধে ফিরে যাচ্ছে। অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত না করা গেলে এমন ঘটনা বারবার ঘটতেই থাকবে। এটুকু আমরা সবাই বুঝি, বোঝে না যথাযথ কর্তৃপক্ষ। তাই আমাদের আরও সচেতন হয়ে এসবের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।

ভুক্তভোগী অনেকেরই অভিযোগ, অপহরণের পর পুলিশ ও র‌্যাবের কাছে অভিযোগ করে অনেক সময় কার্যকর সহায়তা পাওয়া যায় না। এজন্য অজ্ঞানপার্টির খপ্পরে পড়া বেশিরভাগ ঘটনায় ভুক্তভোগী বা তার স্বজনরা মামলা করা দূরে থাকেন। আবার কখনো কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে না জানিয়ে অপহরণকারীদের দাবিকৃত অর্থ পরিশোধ করে স্বজনকে ছাড়িয়ে আনেন তারা। আমার মতে এটা খুবই অসুস্থ মস্তিষ্কের কাজ। দেশটা এখনও এতোটা রসাতলে যায়নি যে, ওইসব চক্রের হাতে অর্থ তুলে দিতে হবে। র‌্যাব-পুলিশের অনেকগুলো শাখা আছে, যারা চৌকস সাহসী। তাদের হাতে অনেক আধুনিক ব্যবস্থা আছে, যা ওইসব অপরাধীদের শায়েস্তা করতে পারে। এমন অনেক নজীরও রয়েছে।

অজ্ঞানপার্টির দৌরাত্ম্য আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এতে সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি হচ্ছে। এ রকম পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও সক্রিয় হতে হবে। অপহরণকারী চক্রের সদস্যদের শনাক্ত ও আইনের আওতায় আনতে না পারলে এ অপরাধ আরও বাড়বে এবং আতঙ্ক ছড়াবে জনমনে। তা কখনো উচিত নয়। তাই বলব, অজ্ঞানপার্টির চক্রকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ কারণে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। আমাদেরও সহযোগিতা করতে হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/ফারুক/এমএস

অজ্ঞানপার্টির দৌরাত্ম্য আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এতে সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি হচ্ছে। এ রকম পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও সক্রিয় হতে হবে। অপহরণকারী চক্রের সদস্যদের শনাক্ত ও আইনের আওতায় আনতে না পারলে এ অপরাধ আরও বাড়বে এবং আতঙ্ক ছড়াবে জনমনে। তা কখনো উচিত নয়।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।