জনগণের রায় নিতে ভয় কীসের?

মোনায়েম সরকার
মোনায়েম সরকার মোনায়েম সরকার , রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৯:১৬ এএম, ২৭ জুন ২০২৩

একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীকে যখন বলতে হয়- ‘আমি জানি, অনেক চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র চলছে’, তখন উদ্বিগ্ন হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। শুধু সরকার নিয়ে নয়, দেশ নিয়েও উদ্বিগ্ন হতে হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশে যে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে প্রায় দেড় দশকে, তার কোনো তুলনা হয় না। বাংলাদেশে কোনো সরকারের আমলেই এত উন্নয়ন সাধিত হয়নি। জনগণের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে, দেশের জন্য অঙ্গীকার না থাকলে এটা কখনোই সম্ভব নয়।

পৃথিবীতে সমস্যামুক্ত কোনো দেশ নেই। বাংলাদেশেও সমস্যা রয়েছে। তবে দেখতে হবে, সরকার সমাধানে উদ্যোগী কিনা। বর্তমান সরকার শুধু সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী নয়, নতুন নতুন সম্ভাবনা বাস্তবায়নেও এগিয়ে যাচ্ছে। একাত্তরের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সরকার দারিদ্র্যমুক্ত, ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গঠনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে শুধু তা-ই নয়, তরুণ প্রজন্মের স্বপ্ন বাস্তবায়নে ডিজিটাল ও স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনেও সে উদ্যোগী। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠে যাবে। করোনা পরিস্থিতিতে না পড়লে এরই মধ্যে সে লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হতো। এ সবকিছু যার নেতৃত্বে সম্ভব হয়েছে, তাকে কিনা দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বলতে হয়- ‘আমি জানি, অনেক চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র হচ্ছে’! এটা কি দুর্ভাগ্যজনক নয়?

সরকারের বিরুদ্ধে দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে চক্রান্ত হচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও হচ্ছে। অনেক অভিযোগ তোলা হচ্ছে, যা অযাচিত। আগামী নির্বাচন কিভাবে অনুষ্ঠিত হবে, তা নিয়ে দেশের মানুষের চেয়ে বিশেষ কিছু দেশ ও সংস্থার আগ্রহই বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটা অনাকাঙ্খিত। তবে এটা সম্ভব হচ্ছে, কারণ দেশের ভেতর থেকে একটি মহল অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য তাদের ডেকে আনছে; সুযোগ করে দিচ্ছে। ন্যায্য দাবিদাওয়া থাকলে তারা পারতো জনগণের কাছে যেতে, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে।

আওয়ামী লীগও অতীতে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে, সরকারের অন্যায় কর্মকাণ্ড, নির্বাচনে কারচুপি ইত্যাদির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। তারা যা করেছে, সেটা জনগণের কাছে গিয়ে এবং জনগণকে সঙ্গে নিয়ে। তাতে জনতার ইচ্ছার প্রকাশও ঘটেছিল। অপরদিকে বিএনপিসহ যেসব দল সরকারের বিরুদ্ধে নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে যাচ্ছে, তারা কখনো সেগুলো নিয়ে জনগণের কাছে যায়নি। জনগণও তাদের ডাকে কখনো সাড়া দেয়নি। তার একটা বড় কারণ, জনগণ তাদের চেনে। কিভাবে তাদের জন্ম হয়েছে এবং ক্ষমতায় গিয়ে তারা কী করেছিল, সে বিষয়ে জনগণ ভালোই অবহিত।

জনগণকে বিভ্রান্ত করা বা সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত করে তোলার সুযোগ তাদের নেই। সে কারণেও কার্যকর কোনো আন্দোলন তারা গড়ে তুলতে পারেনি দীর্ঘদিনে। ২০১৪ সালের নির্বাচন বানচাল করতে তারা যা করেছিল, সেটা আসলে কোনো আন্দোলন ছিল না। ছিল অগ্নিসন্ত্রাস। সরকার ও প্রশাসন সেটা দক্ষতার সঙ্গে প্রতিহত করে দেশকে স্বাভাবিক ধারায় রাখতে সক্ষম হয়। এতে করে কেবল গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা বজায় থেকেছে তা নয়; উন্নয়নের নতুন যুগেও দেশ প্রবেশ করতে পেরেছে। এর একটি বড় উদাহরণ প্রমত্তা পদ্মার বুকে সেতু। এরই মধ্যে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার এক বছর অতিক্রান্ত হয়েছে।

গত ক’দিনের মিডিয়ায় পদ্মা সেতু চালু হওয়ার ফলে দক্ষিণবঙ্গসহ দেশের অর্থনীতি ও সমাজে কী প্রভাব পড়েছে, তার ওপর অনেক প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। এটা এখন সবাই বিশ্বাস করে, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না থাকলে এত বাধা ও বিরূপতার মধ্যে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো না। এখানে সে বিষয়ে বিস্তারিত বলতে চাই না। কারণ পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিরুদ্ধে কী হয়েছে, তা সবারই কমবেশি জানা।

বর্তমান সরকারকে এখন যেমন দেশ ও দেশের বাইরে থেকে হওয়া চক্রান্ত মোকাবিলা করতে হচ্ছে, তেমনি বাধাবিপত্তি ও চক্রান্ত হয়েছিল পদ্মা সেতু ঘিরে। শেখ হাসিনা ও তার টিমের দৃঢ়তার কারণেই সেসব অতিক্রম করা সম্ভব হয়। এখন সেখানে রেললাইন স্থাপনের কাজও শেষ হয়ে এসেছে। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব কি পড়বে না বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলে? রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পও সরকারের আরেকটি উচ্চাভিলাষী প্রকল্প, যার বাস্তবায়ন শেষ হবে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই।

এ প্রকল্প চালু হয়ে গেলে বিদ্যুৎ সমস্যা মোকাবেলায় একটি বড় অগ্রগতি সাধিত হবে। আমরা কি জানি না, বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে বিদ্যুতের অভাবে মানুষকে কত দুর্ভোগ পোহাতে হয়? অর্থনীতির অগ্রগতিও এজন্য রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশ যে এখন বেশি হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে, তাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের সাহসী উদ্যোগকে অবশ্যই কৃতিত্ব দিতে হবে। তবে একথা ঠিক, পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নে ত্রুটি থাকতে পারে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে সরকার সচেষ্ট নয়, সেটাও কি বলা যাবে?

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে প্রশাসনের সব জায়গা থেকে পর্যাপ্ত সহায়তা পাচ্ছেন, তা বলা যাবে না। তার সহকারীদের সবাই দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছেন, সেটা বলারও সুযোগ নেই। তবে সামগ্রিক দিক থেকে দেখলে, সরকারের সাফল্যই বেশি। এর ওপর ভর করে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে একথা বলার অধিকার প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই রাখেন যে, আর কে আছে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার?

অনেক অগ্রগতির মধ্যেও বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচন প্রত্যাশা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হয়নি বা হতে পারেনি, এটা সরকারের দিক থেকেও অস্বীকার করা হচ্ছে না। আগামী নির্বাচন নতুন প্রেক্ষাপটে সুষ্ঠুভাবে হবে, এ অঙ্গীকার খোদ প্রধানমন্ত্রী করেছেন। এদেশের গণতন্ত্র ও উন্নয়নের ব্যাপারে বিশেষভাবে আগ্রহী দেশগুলোর প্রতিনিধিদের কাছেও এটা দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করা হচ্ছে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে আর কী করা যায়, সে ব্যাপারে পরামর্শ প্রদানের কথাও বলা হচ্ছে।

সংবিধানের আওতায় কোনো গ্রহণযোগ্য সংস্কারের প্রস্তাব থাকলে তা নিয়ে আলোচনাও কি হতে পারে না? কিন্তু এসবের মধ্যে না গিয়ে যে নির্বাচনকালীন ব্যবস্থা আদালতের মাধ্যমেই বাতিল হয়ে গেছে, তা ফিরিয়ে আনতে চাওয়া কেন? আমরা কি জানি না, ওই ব্যবস্থাকে বিএনপি কিভাবে নষ্ট করেছিল এবং তা ব্যবহার করে কিভাবে ক্ষমতা ধরে রাখতে চেয়েছিল? সেই সুযোগ যাতে আর কেউ না পায়, সেজন্যই নির্বাচনকালীন ওই ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে। এখন যা করার- সংবিধানের আওতায়ই করতে হবে।

দেশের বাইরে থেকে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন যারা সুষ্ঠু দেখতে চায়, তারাও কিন্তু বলেনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার কথা। তারা জোর দিচ্ছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে- যাতে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে। সম্প্রতি যে পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়ে গেল, সেগুলোয় কি জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেনি? এসব নির্বাচনের কোথাও গুরুতর অনিয়ম হয়েছে, এটা কেউ বলতে পারবে না। নির্বাচনে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি অংশ না নিলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা কম হয়নি।

ঢাকার অদূরে গাজীপুর সিটির নির্বাচনে তো আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কৃত ব্যক্তির মনোনীত প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। তাকে পরাজিত করার কোনো চেষ্টা সরকার বা প্রশাসনের তরফ থেকে করা হয়নি। এসব নির্বাচনে দলের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অগ্রাহ্য করেও বিএনপির কিছু স্থানীয় নেতা কাউন্সিলর পদে দাঁড়িয়ে জয়ী হয়েছেন। এসব ঘটনা কি এ প্রত্যয় জাগিয়ে তোলে না যে, আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবেই হবে? বিএনপিসহ সব প্রধান রাজনৈতিক দল নির্বাচন করতে এগিয়ে এলে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও শুরু থেকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে নিবিড়ভাবে থাকলে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অবশ্যই সম্ভব।

দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন এদেশে সম্ভব নয়, এটি বহুল উচ্চারিত আপ্তবাক্য এবং একে ভুল প্রমাণের সুযোগ আমাদের সামনে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবারই বলছেন, তিনি দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি নিশ্চিত করেছেন বলে নির্বাচনকে ভয় পান না। জনগণের রায় নিতে ভয় কীসের? এত কিছুর পরও জনগণ যদি আওয়ামী লীগের বদলে অন্য কোনো দলকে বেছে নেয়, তবে তাকে স্বাগত জানাতে প্রধানমন্ত্রী প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন।

এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও উচিত বিভিন্নভাবে অযাচিত চাপ সৃষ্টি না করে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে সহায়তা করা। প্রধানমন্ত্রী সংসদে অর্থবিল পাসের দিন বলেছেন, একটি কঠিন পরিস্থিতিতে আগামী অর্থবছরের বাজেট দিয়েছেন তারা। আরও অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও অর্থনীতি পরিচালনা করতে বেশ কষ্ট স্বীকার করতে হচ্ছে সরকারকে। সে কাজেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত আন্তরিক সহায়তা দেওয়া।

লেখক: রাজনীতিক, লেখক; মহাপরিচালক, বিএফডিআর।

এইচআর/এমএস

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত বিভিন্নভাবে অযাচিত চাপ সৃষ্টি না করে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে সহায়তা করা। প্রধানমন্ত্রী সংসদে অর্থবিল পাসের দিন বলেছেন, একটি কঠিন পরিস্থিতিতে আগামী অর্থবছরের বাজেট দিয়েছেন তারা। আরও অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও অর্থনীতি পরিচালনা করতে বেশ কষ্ট স্বীকার করতে হচ্ছে সরকারকে। সে কাজেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত আন্তরিক সহায়তা দেওয়া।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।