বাবাকে কখনও যে কথা বলা হয়নি

শান্তা মারিয়া
শান্তা মারিয়া শান্তা মারিয়া , কবি ও সাংবাদিক
প্রকাশিত: ১২:৩৩ পিএম, ১৮ জুন ২০২৩

যদি বলা হয় আমার দেখা সবচেয়ে ভালো মানুষটিকে বেছে নিতে, আমি বাবার কথা বলবো। আমার বাবা মুহম্মদ তকিয়ূল্লাহ। ভাষাসৈনিক, ভাষা আন্দোলনের আলোকচিত্রী, বাংলাদেশের বর্তমান বর্ষপঞ্জীর প্রণেতা এবং এ দেশের বামধারার রাজনীতির প্রথম যুগের একজন বিপ্লবী। তিনি জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পুত্র। এসব পরিচয় শুনলে মনে হতে পারে তিনি খুব গুরুগম্ভীর মানুষ। কিন্তু তা মোটেই নয়।

তাঁকে আমি কখনো কারও প্রতি অন্যায়ভাবে রাগ করতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।তাঁর অধীনস্ত কর্মচারী, গৃহকর্মী, পাড়ার রিকশাচালক ও ছোট পেশাজীবীদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার ছিল অত্যন্ত সুন্দর। ধনী-গরীব সব মানুষকেই অত্যন্ত মর্যাদা দিয়ে কথা বলতেন।

তিনি মানুষের সমঅধিকার ও মানবতাবাদে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী একজন মানুষ। তাঁর কাছ থেকেই আমি শিখেছি নারী-পুরুষ শুধু নয়, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষের মানবিক অধিকারকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে। খুব সাদাসিধে ভাবে চলতেন, ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধা নিয়ে কখনও মাথা ঘামাননি, পোশাক কিংবা খাওয়া নিয়ে কোনো বিলাসিতার ধার ধারতেন না।

মনে আছে ছোটবেলায় বাবার কাছে কার্ল মার্ক্স, অ্যাঙ্গেলস, লেনিনের গল্প শুনতাম। আমার নামটি তিনি রেখেছিলেন। নাম শুনে যেন ধর্মীয় পরিচয় বোঝা না যায় এবং বিশ্বের সব ভাষার মানুষ যেন সহজে আমার নাম উচ্চারণ করতে পারে সেটি ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। কমিউনিস্ট পার্টির একজন নেতা হিসেবে পঞ্চাশের দশকে একটানা পাঁচ বছরের বেশি তাঁকে কারাগারে রাজবন্দী হিসেবে থাকতে হয়েছিল। সেসব গল্প তাঁর মুখে শুনতাম। শুনতাম তেভাগা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, কমরেড মণি সিং, রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেনের মতো বিপ্লবীদের গল্প। তাঁর ঘনিষ্ট বন্ধু শহীদ কমরেড শহীদুল্লাহ কায়সারের কথা বলতেন গভীর আবেগের সঙ্গে।

বাবার উৎসাহে আমার লেখার শুরু। চার বছর বয়স থেকে আমার স্বভাব মুখে মুখে কবিতা বানিয়ে বলা। লিখতে শেখার পর ছোট ছোট কবিতা লিখতাম। সেই শিশুর কাকলি শুনে সবাই বেশ মজা পেত। কিন্তু বাবা সেগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। সেই কবিতাগুলো একসাথে করে আমার নয় বছর বয়সে তিনি একটি বই প্রকাশ করে দিয়েছিলেন। ‘মাধ্যাকর্ষণ’ নামে সেই বইটি এখনও আমার কাছে বাবার স্নেহের প্রতীক হয়ে আছে।

বাবা আমাকে ‘মামণি’ বলে ডাকতেন।তিনি আমাকে প্রায়ই জাদুঘরে নিয়ে যেতেন। সেসময় নীমতলীতে ছিল ঢাকার জাদুঘর।পরে শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরেও তার সঙ্গে গিয়েছি। স্টেডিয়ামে তখন স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স আর ম্যারিয়েটা বলে দুটি বইয়ের দোকান ছিল। সেখানে বাবা নিয়ে যেতেন এবং আমাকে ও আমার বড়ভাইকে অনেক বই কিনে দিতেন। বাংলা একাডেমির বই মেলাতেও বাবা-মা, ভাইবোন মিলে যেতাম। প্রচুর বই কিনতাম আমরা। বই পড়ার নেশা ও ইতিহাস-প্রীতি দুটোই বাবার কাছ থেকে পাওয়া।

শৈশবে আমার সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতি বাবার কোলে চড়ে ঘোরা। দশ-এগারো বছর বয়স পর্যন্ত আমি বাবার কোলে চড়ে ঘুরেছি।বিশেষ করে চিড়িয়াখানা বা পার্কে বেড়াতে গেলে দীর্ঘ সময় হেঁটে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়লেই তিনি আমাকে কোলে তুলে নিতেন। তিনি ছিলেন বেশ শক্তিশালী পুরুষ। সেনাবাহিনীতে অফিসার হিসেবে কমিশনড পেয়েছিলেন তবে রাজনীতির জন্য চাকরিতে যোগ দেননি। দৈহিক শক্তি ছিল প্রচণ্ড।

আমার বাবার মৃত্যু হয় ২০১৭ সালে, ৯১ বছর বয়সে। তিনি তখন বৃদ্ধ, অসহায় ও দৃষ্টিশক্তিহীন। তবু আমি যখন সকালে অফিসে যেতাম তিনি ফ্ল্যাটের সদর দরজার কাছে আসতেন। আমার মঙ্গলকামনা করে দোয়া করতেন। এই বৃদ্ধ কমরেড জীবনের শেষ দিন অবধি সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদে বিশ্বাস করতেন, শহীদ কমরেডদের স্মৃতিচারণ করতেন।

বাবার সঙ্গে বিভিন্ন প্রসঙ্গে অনেক কথা হতো। কিন্তু কখনও বলা হয়নি তাঁকে আমি কত ভালোবাসি, কত গভীরভাবে শ্রদ্ধা করি। তাঁর শিক্ষা, আদর্শ, তাঁর সাম্যবাদী স্বপ্ন আজও আমি লালন করি নিজের সত্তায়।বাবা দিবসে তাঁকে আমি বলতে চাই ‘আমি তোমার মেয়ে, চিরদিন তোমার দেখানো পথেই চলবো।’

লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/জেআইএম

বাবার সঙ্গে বিভিন্ন প্রসঙ্গে অনেক কথা হতো। কিন্তু কখনও বলা হয়নি তাঁকে আমি কত ভালোবাসি, কত গভীরভাবে শ্রদ্ধা করি। তাঁর শিক্ষা, আদর্শ, তাঁর সাম্যবাদী স্বপ্ন আজও আমি লালন করি নিজের সত্তায়।বাবা দিবসে তাঁকে আমি বলতে চাই ‘আমি তোমার মেয়ে, চিরদিন তোমার দেখানো পথেই চলবো।’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।