দেখে এলাম সিনচিয়াংয়ের কাশগর
কোভিড মহামারি এবং অন্যান্য কারণে, বিগত ছয় বছর বেইজিংয়ের বাইরে যাইনি বা যেতে পারিনি আমি। বাইরে যাওয়ার সুযোগ আসেনি, তা নয়; এসেছিল, কিন্তু সেসব সুযোগ আবার অনিবার্য কারণে হাতছাড়াও হয়েছিল। আমি এমনিতে ঘরকুণো টাইপের মানুষ; বিশেষ একটা ঘোরাঘুরি করি না। কিন্তু টানা ছয় বছর একটি শহরে কাটিয়ে দেওয়া, এমনকি আমার জন্যও খানিকটা বাড়াবাড়িই ছিল। বাইরে যেতে মনটা আঁকু-পাঁকু করছিল।
শেষ পর্যন্ত আরেকটি সুযোগ এলো। গত মে মাসের শুরুর দিকে চীনা সহকর্মী মুক্তা (এটি তার বাংলা নাম, চীনা নাম ‘ছাই’) আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি তার সাথে অফিসিয়াল ট্যুরে সিনচিয়াং যাবো কি না। মুক্তার সাথে সেই ট্যুরে আমার আরেক বাঙালি সহকর্মীর যাওয়ার কথা ছিল। জানলাম, পারিবারিক সমস্যার কারণে তিনি যেতে পারবেন না। একজনের পথ বন্ধ হওয়ায়, আরেকজনের পথ খুললো!
না যেতে চাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না! বেইজিংয়ের বাইরে যে কোনো জায়গায় যেতে আমি রাজি; আর সেটি যদি হয় সিনচিয়াং, তাহলে তো কথাই নেই! চীনের যে দুটি জায়গায় আমি সবচেয়ে বেশি করে যেতে চাই, সে দুটি জায়গা হচ্ছে সিনচিয়াং ও তিব্বত। বিগত ১১ বছরে চীনের একাধিক সুন্দর জায়গা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, তবে এ দুটি জায়গায় যাওয়া হয়নি। আমি সিনচিয়াং যেতে একবাক্যে রাজি হয়ে গেলাম। মুক্তা আমাকে বললেন, ‘আমরা যাবো কাশগর। কাশগর হচ্ছে সিনচিয়াংয়ের হার্ট বা হৃদয়।’
সিনচিয়াংয়ের সরকারি নাম ‘সিনচিয়াং উইগুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল’। চীনের সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক সম্পদে পূর্ণ প্রদেশ পর্যায়ের অঞ্চল এটি। এর মোট আয়তন ১৬ লাখ বর্গকিলোমিটার বা ৬ লাখ ২০ হাজার বর্গমাইল। অন্যভাবে বললে, সিনচিয়াং প্রায় ১২টি বাংলাদেশের সমান! কিন্তু লোকসংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম, ২ কোটি ৫৮ লাখ ৯০ হাজার। আয়তনে অনেক বড় হলেও, সিনচিয়াংয়ের মাত্র ৯.৭ শতাংশ এলাকা মানুষের বসবাসের উপযোগী। বাকি এলাকা মরুভূমি ও পাহাড়ি অঞ্চল।
স্বাভাবিকভাবেই সিনচিয়াংয়ে উইগুরদের সংখ্যা বেশি। উইগুররা মুসলিম। সিনচিয়াংয়ের ৪৪.৯৬ শতাংশ উইগুর; ৪২.২৪ শতাংশ হান (গোটা চীনের জনসংখ্যার ৯১ শতাংশের বেশি হচ্ছে হান); বাকি ১২.৮০ শতাংশ কাজাখ, কিরগিজ, তিব্বতি, হুই, তাজিক, মঙ্গোল, রুশ, সিপে, ইত্যাদি সংখ্যালঘু জাতির মানুষ। সিনচিয়াংয়ের আড়াই হাজার বছরের রেকর্ডকৃত ইতিহাস রয়েছে।
এই সিনচিয়াংয়ের হার্ট বা হৃদয় বলে চিহ্নিত কাশগর অঞ্চলের আয়তন ৬৩ হাজার বর্গমাইল (বাংলাদেশের চেয়ে খানিকটা বড়)। লোকসংখ্যা সাড়ে ৬ লাখের মতো। এর মধ্যে উইগুর ৮০ শতাংশের বেশি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনগোষ্ঠী হচ্ছে হান, প্রায় ১৮ শতাংশ। কাশগর অঞ্চলের রাজধানী বলা যেতে পারে ‘কাশগর শহর’-কে। এটি আসলে কাশগর অঞ্চলের বৃহত্তম কাউন্টি। আর, ‘কাশগর প্রাচীন নগর’ অবস্থিত কাশগর শহরের কেন্দ্রস্থলে।
চীনে একটি কথা প্রচলিত আছে। কথাটি এমন: ‘আপনি কাশগরে যাননি মানে সিনচিয়াং যাননি; আপনি কাশগর প্রাচীন নগরে যাননি মানে কাশগরে যাননি’। আমি এখন বলতে পারি যে, আমি সিনচিয়াংয়ে গিয়েছি। কারণ, আমি কাশগর গিয়েছি, কাশগর প্রাচীন নগরে গিয়েছি। গত ১৩ মে থেকে ১৮ মে পর্যন্ত স্থায়ী সিনচিয়াং সফরে আমার সঙ্গী ছিলেন চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বিভিন্ন বিভাগের মোট ১৭ জন বিদেশি ও চীনা সহকর্মী। বিদেশিদের মধ্যে ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, ইরান ও তাঞ্জানিয়ার ৫ জন। বাকিরা চীনা। বলাই বাহুল্য, বাংলা বিভাগের মুক্তাও তাদের একজন।
‘কাশগর’ উইগুর শব্দ। চীনা ভাষায় একে ডাকা হয় ‘কাশী’ (Kashi)। চীনারা উচ্চারণ করে ‘খাস্রি’। ১৩ মে দুপুর ১টার দিকে যখন আমাদের বহনকারী এয়ার চায়নার বিমানটি সিনচিয়াংয়ের মাটি স্পর্শ করল, তখন বিমানের জানালা দিয়ে দেখলাম বিমানবন্দর টার্মিনালের মাথায় বড় বড় হরফে উইগুর ভাষায় লেখা ‘কাশগর’ এবং পাশেই চীনা ভাষায় লেখা ‘কাশী’।
বিমানবন্দর থেকে দুটি মিনিবাসে আমরা হোটেলে যাচ্ছি। মাত্র ১০ মিনিটের পথ। আমি আগ্রহ নিয়ে জানালা দিয়ে কাশগর দেখছি। সুন্দর ছিমছাম, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শহর; প্রচুর গাছপালা; ট্রাফিক জ্যাম নেই। রাস্তার দু’পাশে দোকানপাট। একসময় মুক্তা আমাকে বললেন: ‘দেখুন, সব দোকানের সাইনবোর্ডে উইগুর ভাষায় নাম লেখা; তার পর চীনা ভাষা। চীনের সরকার উইগুরদের ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করেছে ও করছে। স্কুলগুলোতে উইগুর ভাষায় বাচ্চারা লেখাপড়া করে। অথচ পশ্চিমারা সবসময় অপপ্রচার চালিয়ে আসছে যে, চীন সরকার উইগুর জাতির সংস্কৃতি ধ্বংস করে দিচ্ছে।’
আমি দোকানপাটের সাইনবোর্ডে উইগুর ভাষার ব্যবহার আগেই লক্ষ্য করেছি। মুক্তার কথায় আবার দেখলাম। আগে থেকে জানা না-থাকলে আমি মনে করতাম এটা উইগুর ভাষা নয়, বরং আরবি ভাষা। উইগুর ভাষা লেখা হয় আরবি হরফে, উর্দুর মতো। পার্থক্য হচ্ছে, উর্দু লেখা হয় একটা বিশেষ স্টাইলে, যা দেখলে একে উর্দু বলে বুঝতে অসুবিধা হয় না। অন্যদিকে, উইগুর ভাষা লেখা হয় একেবারে আরবি স্টাইলে। আগে থেকে জানা না থাকলে, যে কোনো অনারব একে আরবি ভাষা বলে ভুল করবেন। একবার একজন সাবেক বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত এমন ভুল করেছিলেন।
আমরা বছরের যে সময়টায় কাশগরে গিয়েছি, সেসময় সেখানে সূর্য ওঠে সকাল ৮টার দিকে, অস্ত যায় রাত ১০টায়! এমন অভিজ্ঞতা আমার প্রথম হয়েছিল প্যারিসে। দিন যেন আর শেষ হতে চায় না! ঘড়িতে যখন রাত ৮টা বাজে, তখনও সূর্য আকাশে গনগন করে। বাইরে থেকে আসা মানুষের জন্য এ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা বটে। কাশগরে আমার আরেকটি নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে। বাংলাদেশে, এমনকি বেইজিংয়েও মক্কা তথা কেবলা পশ্চিম দিকে। কিন্তু কাশগরে কেবলা, যতদূর মনে পড়ে, উত্তর-পূর্ব দিকে!
যাই হোক, সফরের প্রথম দিন বিকেলেই আমরা গেলাম কাশগর প্রাচীন নগর দেখতে। এ নগরের আয়তন ৩.৬ বর্গকিলোমিটার। ২১০০ বছর আগে থেকে এ নগরে মানবসভ্যতার অস্তিত্ব বিদ্যমান। বলা হয়, পৃথিবীতে যেকয়েকটি হাতেগোনা প্রাচীন জায়গায় দীর্ঘ সময় ধরে টানা মানুষ বসবাস করে আসছে, কাশগর প্রাচীন নগর সেগুলোর একটি। আরও বলা হয়, এটি তিনটি প্রধান ধর্ম ও চারটি সভ্যতার মিলনস্থল। ‘খাদ্যের শহর’, ‘তরমুজ ও ফলের শহর’, ‘নাচ ও গানের শহর’, ‘বাজারের শহর’, ‘সৌন্দর্যের শহর’ ইত্যাদি নামেও এটি সুপরিচিত।
প্রাচীন এই নগরের বাড়িঘর ছিল মাটির তৈরি। আধুনিক কোনো সুযোগ-সুবিধা ছিল না। সামান্য বৃষ্টিতে নগরের অলিগলিতে সৃষ্টি হতো জলাবদ্ধতা। একটু বেশি বৃষ্টি বা ঝড়ে ধসে পড়তো কোনো কোনো মাটির ঘর। এখানকার লোকজনের জীবনমান ছিল অনুন্নত। অধিকাংশই ছিলেন হতদরিদ্র। এটা খুব বেশি কাল আগের কথা নয়। ২০০৯ সালে কাশগর সফর করেছিলেন তাঞ্জানিয়ার ফাদিরি। এবারের সফরে তিনি আমার সফরসঙ্গী। তিনি জানালেন, বিগত কয়েক বছরে আকাশ-পাতাল পরিবর্তন ঘটেছে কাশগরে। তিনি আরও জানালেন, তখনকার কাশগর প্রাচীন নগর ছিল অনুন্নত ও অনেকটা ভুতুরে। বাইরের লোকজন সেখানে যেতে ভয় পেতো। এখন গোটা কাশগর প্রাচীন নগর বদলে গেছে আমূল।
কাশগর প্রাচীন নগরের বদলে যাওয়ার কাহিনি শুরু হয় ২০০৮ সালের ১২ মে। সেদিন চীনের সিচুয়ান প্রদেশের ওয়েনছুয়ানে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প আঘাত হানে। জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সিনচিয়াং উইগুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয়, তেমন ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে কাশগর প্রাচীন নগরকে বাঁচাতে এর সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। কেন্দ্রীয় সরকারও এগিয়ে আসে। শুরু হয় প্রাচীন কাশগর নগরকে নতুন করে গড়ে তোলার মাল্টি বিলিয়ন ইউয়ানের প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ। ২০১৩ সালের ২০ জুলাই প্রাচীন কাশগর নগরকে ৫এ গ্রেডের জাতীয় পর্যটনকেন্দ্র ঘোষণা করে চীনের সরকার।
এই বদলে যাওয়া কাশগর প্রাচীন নগর আমরা দেখেছি। তাঞ্জানিয়ার ফাদিরি যত ভালোভাবে এই পরিবর্তনকে উপলব্ধি করেছেন, আমার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। তবে, ভালো করে খেয়াল করলে পরিবর্তনটা বোঝা যায়। সংস্কারের কাজটা করা হয়েছে যথাসম্ভব আদি চরিত্র বজায় রেখে। উদাহরণ হিসেবে একটা বাড়ির কথা ধরুন। বাড়িটির দেওয়াল মাটির তৈরি ছিল। বাড়িটি এমনভাবে সংস্কার করা হয়েছে, যাতে সেটি শক্তপোক্তও হয়, আবার এর আদি চেহারাও বজায় থাকে।
বদলে যাওয়া কাশগর প্রাচীন নগরে এখন আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা আছে। এখানকার আদি বাসিন্দাদের জীবনমান উন্নত হয়েছে, আয় বেড়েছে। তাদের জীবনধারা ও সংস্কৃতিই এখন তাদের আয়ের মূল উত্স। উইগুর সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ লোকসঙ্গীত ‘বারো মুকাম’। এ লোকসঙ্গীতের সাথে জড়িয়ে আছে বেশ কয়েকটি স্থানীয় বাদ্যযন্ত্র। প্রাচীন নগরের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে সর্বত্র যেমন ‘বারো মুকামের’ প্রভাব দেখা যাবে, তেমনি দেখা যাবে বিভিন্ন দোকানে স্থানীয় বাদ্যযন্ত্রের কেনাবেচা। উইগুর জাতির পোশাক, টুপি, খাবার—সবই এখানে পর্যটনপণ্য হয়ে উঠেছে।
কাশগর প্রাচীন নগরে পারিবারিক হোটেলের একটি গলি আছে। এখানকার প্রায় প্রতিটি পরিবার এ ব্যবসার সাথে জড়িত। বাড়িতে তারা নিজেরা থাকেন, আবার পর্যটকদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা কক্ষ ভাড়া দেন। তাদের বাড়িঘর এভাবে রূপান্তরের জন্য সরকার ভর্তুকি দিয়েছে। আবার কোনো কোনো বাড়ি স্রেফ প্রাচীনত্বের ও অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। এমন অনেক বাড়ি সেগুলোর আদি বৈশিষ্ট্যসহ সংরক্ষণ করা হয়েছে। তেমন একটি বাড়ির নাম ‘মুহাম্মাদের বাড়ি’। এটি নগরের সবচেয়ে প্রাচীন বাড়ি হিসেবে খ্যাত। গোটা বাড়ি এমনভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে, যাতে দর্শকরা বুঝতে পারেন, প্রাচীনকালে এর অবস্থা কেমন ছিল। বাড়ির বর্তমান কর্তারও বয়স হয়েছে। পরনে উইগুর পোশাক, মাথায় উইগুরদের প্রিয় পাঁচ বা ছয় কোণা টুপি। তাঁর এখন কাজ হাসিমুখে পর্যটকদের স্বাগত জানানো ও আগ্রহীদের সঙ্গে ছবি তোলা। তাঁর দাদা বা পরদাদার বা তাঁর পরদাদার নাম ছিল মুহাম্মাদ।
প্রতিদিন সকাল ১০টায় কাশগর প্রাচীন নগরের প্রবেশদ্বারের সামনে ‘বারো মুকাম’ গেয়ে ও গানের তালে তালে নেচে পর্যটকদের স্বাগত জানানো হয়। রীতিমতো রাজকীয় অভ্যর্থনা। প্রবেশদ্বারের উপরে চার ‘সৈনিক’ বল্লম হাতে ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকেন। পাশের একটি উঁচু মঞ্চ থেকে বিশাল আকৃতির ড্রাম ও করতাল বাজিয়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়া হয়। তারপর শুরু হয় নাচ-গান। যারা নাচ-গান পরিবেশন করেন, তাদের পরনে থাকে উইগুরদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক।
এসব পোশাক শালীন ও সুন্দর। তাদের সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠান শেষে পর্যটকরা প্রাচীন নগরে প্রবেশ করেন, ঘুরে দেখেন, উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন প্রাচীন নগরের হৃদয়ের স্পন্দন। নগরের ভিতরে ঘুরে বেড়াতে ভাড়ায় ট্যুরিস্ট মিনিবাস পাওয়া যায়। উইগুরদের খাবারের স্বাদ যারা নিতে চান, তারা ফুড স্ট্রিটে ঢুঁ মারতে পারেন। এখানে বলে রাখি, কাশগর তথা সিনচিয়াংয়ের খাবার খুবই মজাদার।
সিনচিয়াংয়ের খাবারের প্রসঙ্গ এলে নান নিয়ে দুটি কথা বলতেই হবে। প্রাচীন নগরের বিভিন্ন দোকানে নান তৈরি হয়। ফ্রেস নান খেতে বেশ মজা। সিনচিয়াংয়ের নান খেতে খেতে সেখানকার প্রাচীন নগর ঘুরে দেখার মজাই আলাদা। নানের অনেক দোকানের মধ্যে একটাকে আলাদা করে মনে আছে। সাত পুরুষ ধরে এই দোকানে নান তৈরি হচ্ছে। সদাহাস্যময় এক ইউগুর যুবক দক্ষ হাতে নান তৈরি করছেন। শত বছর আগে এই জায়গায় যিনি এই দোকান চালু করেছিলেন, তাঁর সাদাকালো ছবি শোভা পাচ্ছে দোকানের মাথায়।
দোকানের সামনে দলছুট আমি ও পাকিস্তানের এতেশাম; সঙ্গে এতেশামের উর্দু বিভাগের চীনা সহকর্মী। যুবক চীনা ভাষা তেমন একটা বোঝেন না। দোভাষীর কাজ করলো দোকানের কিশোর বয়সী একটি ছেলে। সে উইগুর ও চীনা—দুটি ভাষাই জানে। এতেশাম পাকিস্তানের শুনে যুবক তাকে বিশাল বিশাল চারটি নান ফ্রিতে দিতে চাইলেন। কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘কারণ, তুমি মুসলিম!’
শুধু কাশগর প্রাচীন নগরের সব কথা বলতে গেলে অন্তত কুড়ি ফর্মার বই হয়ে যাবে। এখানে তাই সব কথা বলার সুযোগ নেই। তবে, ঈদ গা (Id Kah) মসজিদের কথা না বললেই নয়। শুনেছি, এটি চীনের প্রাচীনতম মসজিদগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়। মসজিদটিও যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। তবে, এর দেওয়াল সেই মাটিরই রয়ে গেছে। জানলাম, মসজিদে এখনও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হয়। পাকিস্তানের এতেশাম মসজিদে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়লেন। নামাজের ওয়াক্তের বাইরে, মসজিদটি ঘুরে দেখতে পারেন পর্যটকরা। তবে, সেজন্য তাদের টিকিট কাটতে হবে। ধারণা করি, মসজিদটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের অন্তত একটা অংশ উঠে আসে এভাবে।
কাশগর প্রাচীন নগর ঘুরে দেখতে দেখতে আমি ভাবছিলাম আমার দেশের প্রিয় শহর ঢাকার কথা। কাশগর প্রাচীন নগরকে কেন্দ্র করে যেমন গড়ে উঠেছে একটি নতুন কাশগর শহর, তেমনি পুরান ঢাকাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি নতুন ঢাকা শহর। পুরান ঢাকার একটা নিজস্ব সংস্কৃতি আছে, বৈশিষ্ট্য আছে। আবার, এই শহরের দালান-কোঠাগুলোর বেশিরভাগই বিপজ্জনকভাবে টিকে আছে। আশঙ্কা করা হয়, মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানলে, পুরান ঢাকার প্রায় সব বাড়িঘর ধসে পড়বে। আল্লাহ না-করুন, তেমনটি হলে, ঢাকার প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মূল ধারকটিই ধ্বংস হয়ে যাবে। একে সংরক্ষণ করার জন্য কি উদ্যোগ নেওয়া যায় না? বাংলাদেশের সরকার সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের একটি দলকে চীনের কাশগর প্রাচীন নগরে পাঠাতে পারে। তাঁরা এসে দেখে যাবেন, জেনে যাবেন, কীভাবে একটি প্রাচীন নগরকে সংরক্ষণ করা যায়।
বস্তুত, কাশগর প্রাচীন নগর সংরক্ষণের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে, পুরান ঢাকা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া যেতেই পারে। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের প্রাচীন পানাম নগরের কথাও এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য। এটি একটি সংরক্ষিত এলাকা। তবে, পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট অনুসারে, এই সংরক্ষণের কাজটি ঠিকমতো হচ্ছে না। কাশগর প্রাচীন নগর সংরক্ষণের অভিজ্ঞতা পানাম নগর সংরক্ষণের কাজেও লাগানো যেতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি।
আগেই বলেছি, শুধু কাশগর প্রাচীন নগর নিয়ে লিখতে গেলে বই হয়ে যাবে। অথচ, আমাদের সফরে আমরা কাশগর অঞ্চলের আরও দুটি কাউন্টিতে গেছি; দেখেছি কীভাবে মরুভূমির বুকে শত শত কিলোমিটারের সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। কাজটা করতে শত শত কিলোমিটার এলাকাজুড়ে মরুশাসন করতে হয়েছে। এই সড়ক আবার ‘চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর’র অংশবিশেষ।
আগে এতদঞ্চলে খুব ঘন ঘন বালুঝড় হতো। এর নেতিবাচক ফল ভোগ করতে হতো কাশগর শহরের বাসিন্দাদেরকেও। এ সমস্যা সমাধানে কাশগর শহর থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে মরুভূমির বুকে গড়ে তোলা হলো বিশাল কৃত্রিম বনাঞ্চল। এলাকার একজন কর্মকর্তা বললেন, ‘এখানে এ ধরনের একটি বন গড়ে তোলা ছিল প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। কিন্তু আমরা এই আপত অসম্ভব কাজটি মাত্র ১০ বছরে সম্ভব করেছি।’
কাশগরে পাঁচদিনের সফরে দেখেছি অনেক, উপলব্ধি করেছি তারচেয়ে বেশি। কাশগরে আমার পরিচয় হয়েছে ইউসুফ নামের এক কিশোরের সাথে, যে স্কুল ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় তাঁর দাদিকে নিয়ে বাজার করতে এসেছিল। কাশগরে আমি ফুটবল খেলেছি আবদুল্লাহর সাথে, যে বড় হয়ে একজন দুর্দান্ত স্ট্রাইকার হবে বলে আমার বিশ্বাস। এমনকি, খেলার মাঠে আমার পরিচয় হয়েছে ‘আলিমুল’ নামের এক কিশোর ফুটবলারের সাথে! বারো মুকামের তালে তালে আমাকে অনেকটা জোর করে নাচতে বাধ্য করা সেই নাম-না-জানা মধ্যবয়সী উইগুর লোকটির কথাও তো কোনোদিন ভুলবো না!
ভবিষ্যতে তাদের নিয়ে বিস্তারিত লিখবার ইচ্ছা রইল।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)।
[email protected]
এইচআর/ফারুক/এমএস