ভিসানীতি
মার্কিন ধমকের নতুন ভাষা

যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত নতুন ভিসানীতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অঙ্গন গরম করে তুলেছে। এই ভিসানীতি সারা বিশ্বের সব নাগরিকের জন্য নয়। এটা নাইজেরিয়া, উগান্ডা, সোমালিয়া, বাংলাদেশ ইত্যাদিসহ শুধু কয়েকটি দেশের জন্য প্রযোজ্য। তবে এ নীতি বাংলাদেশের সব নাগরিকের জন্য বলবৎ করা হয়নি। কতিপয় মানুষ যারা দেশে সুষ্ঠু ভোট অনুষ্ঠানে বাধা প্রদান করবে শুধু তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ সবাই সবসময় মার্কিন ভিসা নিয়ে মাথা ঘামায় না। ডিভি লটারির সময় তাদের ভিসা প্রাপ্তির আশা কিছুটা শিক্ষিত ও সচেতন মহলে কৌতূহলের সৃষ্টি করেছিল। তখন তাদের ভিসাপ্রাপ্তির আবেদন জমা দেওয়ার জন্য একটা সাড়া পড়ে গিয়েছিল। তারপর সব আগের মতোই রয়ে গেছে।
তবে এদেশের অনেক পেশাজীবী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ঘুসখোর, বড় আমলা, মুদ্রাপাচারকারী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা এবং কিছু উচ্চশিক্ষান্বেষী শিক্ষক ও ভাগ্যান্বেষী শিক্ষার্থী-যুবশ্রেণি, খেলোয়াড়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গমনের জন্য উন্মুখ। এদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। এরা নিয়মিত মার্কিন নতুন ভিসাপ্রাপ্তি ও পুরাতন ভিসা নবায়নের জন্য দূতাবাসের দরজায় লাইন দিয়ে থাকেন।
দেশের ষোল কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র ৫০-৬০ লাখ মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজনে মার্কিন ভিসাপ্রাপ্তির প্রচেষ্টা করেন। এদের কেউ ভাবেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীতে একটি স্বর্গরাজ্য আবার কেউ বলেন সারা দুনিয়ায় যুদ্ধের ফলে রিফুজি হয়ে বা প্রতিহিংসার শিকার হয়ে বা বিভিন্ন রাজনৈতিক অপরাধ করে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয়ের নিরাপদ ঠিকানা হলো সেখানেই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীতে সবকিছুতে প্রথম হওয়ার চেষ্টা করে, তাই হয়ে বা থেকেও যায়। কারণ, সারা দুনিয়ায় মেধাগুলো তারা তাদের মাটিতে যাওয়ার জন্য আহ্বান করে। যারা তাদের দেশের কাজে লাগতে পারবে বলে উপযুক্ত মনে হয় তাদের বিভিন্ন সুযোগের হাতছানি দিয়ে মোহাবিষ্ট করে রাখা হয়। এমন প্রার্থীরা এক সপ্তাহ বা তিনমাসের ভিসার জন্য আবেদন করলে তাদের পরিবারসহ একই সঙ্গে পাঁচ বছরের জন্য অগ্রিম ভিসা দেওয়ার নজির রয়েছে। এই লেখকের এধরনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। এটাও তাদের ভিসানীতির অংশ।
একদিন টিভিতে রান্নাবান্নার অনুষ্ঠান দেখে এক বন্ধু কৌতুক করে বলেছিল, রাঁধুনি দামি উপকরণ যেমন, ঘি, মধু, ডিম, বাদাম, জাফরান দিয়ে এতক্ষণ বয়ান করে যে মিষ্টান্ন রান্না করেছে সেটা ওভাবে না করে শুধু একসঙ্গে সব জিনিস মেখে দিলে এমনিতে স্বাদ হয়ে যেত। আর রান্নার প্রয়োজন পড়তো না। রান্নার সেই ভালো উপকরণের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কিছু দেশ পৃথিবীর সব দেশ থেকে মেধাবান মানুষ, বিত্তশালীদের অবৈধ অর্থসম্পদ ইত্যাদি টেনে নেওয়ার নীতির সঙ্গে ভিসাকে যুক্ত করেছে। সকল ভালো মানুষ যদি সেখানে জড়ো হয়ে সেখানে কিছু সময়ের জন্য তাদের মেধাকে ভালো কাজে লাগায় তাহলে অবশ্যই ভালো কিছু তৈরি করা সম্ভব। এসব ভালো অভিবাসীর সহায়তায় তারা সেখানে একটি ভালো কর্মপরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।
পর্যাপ্ত আয় ও উপযুক্ত জীবনমানের নিশ্চয়তা দানের জন্য সামাজিক সেবা ও সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়েছে। ফলে একটি নির্দিষ্ট ছন্দের মধ্যে তাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠোমোতে কাজ ও বসবাস করার সুবিধা দেখে আমরা আপ্লুত হয়ে যাই। ওসব দেশে বেকার খুঁজে পাওয়া মুশকিল এবং ভিক্ষা পেতে মানুষ লজ্জা করে। শুধু মার্কিন কেন- কানাডা, ইউরোপের কয়েকটি দেশ, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া ইত্যাদিতেও বর্তমানে মানুষের মৌলিক অধিকার ও সামাজিক নিরাপত্তা অনেকটা ব্যবস্থা নিশ্চিত হওয়ায় সেদিকেও মানুষ ঝুঁকে পড়েছে। এনিয়ে সেসব দেশ কোনো বড়াই করে না। বরং তারা আরও পরিচ্ছন্ন হওয়ার চেষ্টায় রত রয়েছে।
অন্যদিকে আমরা ওদের মতো মাথাপিছু আয় বা সামাজিক সুবিধার ধারে-কাছেও না যেতেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করে দিই। নিজের হীন অবস্থা ঢেকে রেখে নিজের গুণগান করার জন্য দিন-রাত অবিরাম গলাবাজির কোনো বিরাম নেই। সেদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের একজন সাবেক রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ‘আমরা নিজেদের যেভাবে দেখি ওরা আমাদের সেভাবে দেখে না। আমাদের গণতান্ত্রিক ধারণা বৈশ্বিক মূল্যবোধের সাথে সাহায্যপূর্ণ হতে হবে।’
একসময় আমাদের ফ্যাকাল্টির প্রথম আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে সেই সাবেক রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, আমাদের বাইরের বিশ্বের মানুষ এখনও যেভাবে মূল্যায়ন করে অতীতের থেকে তার কোনো পরিবর্তন হয়নি। এত উন্নয়ন করার পরেও আরবরা মধ্যপ্রাচ্যে এখনও আমাদের মিস্কিন বলে। কুয়েতের কারাগারে দুর্নীতির দায়ে আমাদের এমপিকে জেলে বন্দি থাকতে হয়। এত বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরও কোথায় যেন সে বার বার লোডশেডিং হয়ে চলে যায়।
কনফারেন্সে আসা ইউনেস্কোর এক প্রতিনিধি রাখঢাক না করে বলেই ফেলেছিলেন- তোমাদের রাস্তার গাড়িগুলো সবসময় ভয়ংকরভাবে হর্ন বাজায়। ব্যস্ত কর্মসময়ে শহরের রাস্তায় গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে এবং সেখানে কালো কাচের জানালায় টোকা দিয়ে ভিক্ষার জন্য হাত পাতে অভাবী মানুষ। শহরগুলোতে সব জায়গায় মশা কামড়ায়, ডেঙ্গু হয়। ঢাকার মতো একটি শহরে গাদাগাদি করে এত মানুষ বাস করে কেন?
এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব সহজ নয়। কনফারেন্সে আসা ইউনেস্কোর যে প্রতিনিধি এসব পর্যবেক্ষণ করে গল্প করছিলেন তার জাপানিজ বন্ধুর ল্যাপটটি বুয়েটের এক সেমিনার কক্ষ থেকে কে বা কারা সটকিয়েছিল! সেটা অনেক চেষ্টা করেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেজন্য চোরের ভয়ে সেই জাপানিজ প্রফেসর আর বাংলাদেশে আসতে চান না। এসব ঘটনা তাদের দেশে সতর্কবার্তা হয়ে প্রচার পায় ফলে আমরা বিদেশি পর্যটক হারাই। ফলে ইতোপূর্বে আমাদের সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে তাদের দেশের নিযুক্ত হাইকমিশনারও কটাক্ষ করতে ছাড়েনি।
এবছর নির্বাচনের এত কাছে এসেও এখনো সব দলের সাথে ঐকমত্য তৈরি হয়নি। পরস্পরের একগুঁয়েমিতে দেশের বিরোধ বিদেশের মাটিতেও শুরু হয়েছে। এসব কথা বিদেশের মানুষের কানে কানে পৌঁছানোর আয়োজন আমরাই করে দিয়েছি।
সম্প্রতি বিদেশ সফরে গিয়ে সেখানেও দুই দল বাংলাদেশি মানুষের পাল্টাপাল্টি রাজনৈতিক কর্মসূচি, ধাক্কাধাক্কি, হুড়োহুড়ি, মারামারি, রাজপথে মাইক বাজিয়ে চিৎকার ইত্যাদি এ সভ্যযুগে কার কাছে ভালো ঠেকেছে? এই নাজুক অবস্থা তৈরির জন্য কে দায়ী? এর উত্তর আপনারা সবাই হয়তো আমার চেয়ে ভালো দিতে পারবেন। একটি-দুটি নয়, কয়েকটি দেশে এ ধরনের কদর্যতা বাংলাদেশের আসল চেহারাকে বিদেশের মাটিতে প্রদর্শন করিয়েছে কে বার কারা? ঘরের বাইরে এমন নাজুক পরিবেশ সৃষ্টি করে হলঘরের মধ্যে নিজেদের উন্নয়নের ফুলঝুড়ি দিয়ে বক্তব্য দিত থাকলে সেটা বুমেরাং হওয়ারই কথা। সেখানে সেটাই হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের ওয়েস্টমিনিস্টারের আদলে আমাদের দেশে ভোট করা হবে বলে কেউ কথা বলেছেন। যুক্তরাজ্যে কোনো লিখিত সংবিধান নেই। আমরা লিখিত সংবিধানে বার বার নিজেদের মতো করে পরিবর্তন আনয়নের মাধ্যমে ঝামেলা বাড়িয়ে চলেছি। সেখানে ডাকযোগে ভোট দেওয়া যায়, কেউ সেটা চুরি করে নিজের ব্যাগে ভরায় না। আমরা তার বিপরীত বলে অভিযোগ নিয়ে বদনাম কুড়িয়েছি এবং সেসব অভিযোগ নিয়ে কখনো গা করি না। সুতরাং আমাদের ভোটের জন্য বিদেশি আদল নিয়ে চিন্তা করা অমূলক। বরং আমাদের নিরীহ ভোটারদের নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে আসা-যাওয়ার পরিবেশ দিতে হবে। ভোট গ্রহণের পর কারসাজি করে পক্ষপাতিত্ব করা যাবে না। এই নিশ্চয়তা কি তৈরি হয়েছে দেশের ভোটাঙ্গনে?
এখনও নিজে পরীক্ষার্থী হয়ে নিজের নির্বাচনী পরীক্ষা নিজে নেওয়ার ফন্দি থেকে লজ্জাও পাই না কেন? যে কোনো পাবলিক পরীক্ষায় কোনো প্রার্থী অসদুপায় অবলম্বন করলে তাকে বহিষ্কার করার নিয়ম। পরীক্ষার্থী নিজেই যদি কেন্দ্র সচিব হন, নিজেই প্রশ্নকর্তা ও প্রশ্ন পাহারার দায়িত্বে থাকতে চান তাহলে কেউ কি সেটা মানবে? তাহলে উপায় কি? ব্রিটিশদের ভোট চুরির কথা শোনা যায় না। সেখানে দ্রব্যমূল্য বাড়লে বা কোনো অভিযোগ পেলে মন্ত্রীরাই নয়-প্রধানমন্ত্রীও দ্রুত পদত্যাগ করে থাকেন। এমন নজির অনেক আছে। আর আমাদের নেতাদের কি সে রূপ কোনো নৈতিকতা ও আত্মধিক্কার আছে? তা-না হলে বিদেশি ভোটের মডেল আমাদের দেশে অচল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক শুধু বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষিত হয়েছে তার প্রধান কারণ আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু করার তাগিদে। গণতন্ত্রমঞ্চসহ অনেকে বলেছেন এই নতুন ভিসানীতি বাংলাদেশের জন্য চরম অবমানাকর ও লজ্জাজনক। কিছু রাজনীতিবিদ ও আমলার কারণে বাংলাদেশের জনগণকে জিম্মি করে এই ভিসানীতি দেওয়া হয়েছে। কারণ এদেশে বেড়ায় ধান খায়, রক্ষক ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পড়ে। তাই আমাদের দুর্বলতার সুযোগ পেলে মার্কিনিরা দাদাগিরি করতে চেষ্টা করবে। তবুও তারা খুব সতর্ক থাকে নিজেদের কথাবার্তায়। সেদিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, ‘মার্কিনিরা যা বলে তা করে না, আর যা করে তা সহজে বলতে চায় না।’
তবে বিদেশি রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদের নিরাপত্তা এসকর্ট তুলে নেওয়ার পর ওরা মনে হয় কিছুটা অসন্তুষ্ট হয়েছে বা ক্ষেপে গেছে। তাই কি করবে, কীভাবে প্রতিশোধ নেবে তার সুরাহা করতে আপাতত: নতুন ভিসানীতির ঘোষণা দিয়ে মার্কিন ধমকের নতুন কায়দা বা ভাষা জানিয়ে দিয়েছে। কয়েকদিন যেতে না যেতেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে সেটা পুনর্বহালের দাবি করে কূটনৈতিক অঙ্গনকেও সরগরম করে তুলেছে।
নতুন ভিসানীতির ভালো-মন্দ নিয়ে যে যতটাই ভাবুক, এটা আমাদের দেশের জনগণকে হেয় করার জন্য একটি খারাপ বার্তা। যে বার্তা আমরা নিজেদের দুর্বলতা ও হঠকারিতা থেকে আমরাই আসার সুযোগ করে দিয়েছি। এটার দ্রুত সুরাহা হওয়া উচিত।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
[email protected]
এইচআর/ফারুক/এএসএম