প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধ করুন, পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে আসুন
আজ থেকে পাঁচ দশক আগে পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে মানুষ এতো সচেতন ছিল না। দিন যতোই বাড়ছে পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতাও বাড়ছে। প্রতি বছরের ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয়। ১৯৭৩ সাল থেকেই দিবসটি পালন করা হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
তবে একথাও ঠিক, পরিবেশ নিয়ে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আলোচনা যতোটা হচ্ছে জাতীয় পরিসরে সেই হারে জনসচেতনতা বাড়ছে না। ফলে পরিবেশ ও জলবায়ু উন্নয়নে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ তেমন চোখে পড়ে না।
গত কয়েক বছরে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় আমাদের সক্ষমতা কিছুটা বেড়েছে। সক্ষমতা বাড়ার যে দাবি আমরা করছি তার ভিত্তি হচ্ছে বিগত কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি কম হওয়া। কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি কম হওয়া মানেই সক্ষতা বাড়া নয়। মনে রাখতে হবে, সময়ের সাথে সাথে জলবায়ুর গতি-প্রকৃতিরও পরিবর্তন হয়েছে। এর ভয়াবহতার রূপও পাল্টেছে।
ঋতুর পরিবর্তন চক্রেও পরিবর্তন এসেছে। কাজেই এসবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে টিকে থাকার জন্য সক্ষমতা বেড়েছে কি না সেটা ভেবে দেখা দরকার। শুধু উঁচু সাইক্লোন আশ্রয়কেন্দ্র ও ঝড় পূর্বাভাস পৌঁছে দেওয়ার নামই জলবায়ু সক্ষমতা নয়। খড়া, অতি বৃষ্টি, বন্যা এমনকি অতি শীত মোকাবিলায় আমাদের সক্ষমতা বেড়েছে কি না সেটা ভেবে দেখতে হবে।
এরকম একটি পরিস্থিতেই এ বছর পরিবেশ দিবস পালিত হয়েছে। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল- প্লাস্টিক দূষণ এড়ানো (Beat Plastic Pollution)। পরিবেশ দূষণের জন্য যে পদার্থ বা জিনিসটি এককভাবে অনেক বেশি দায়ী তা হচ্ছে এই প্লাস্টিক। বিশ্বব্যাপীই এটি বহুল ব্যবহৃত একটি পণ্য।
আমাদের প্রতিদিনের যাপিত জীবনে প্লাস্টিকের ব্যবহার দিনকে দিন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। দামে সস্তা ও সহজে ব্যবহারযোগ্য হওয়ায় এর ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। ঘর-বাড়ি, অফিস-আদালত, দোকানপাঠ সব কিছুই প্লাস্টিকের দখলে চলে যাচ্ছে। এর ভালো মন্দ দুটি দিকই আছে। দাম ও ব্যবহার উপযোগিতার কথা তো বললামই। পরিবেশ রক্ষাকারী বৃক্ষ নিধন রোধে প্লাস্টিক ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে একথাও স্বীকার করতে হবে। প্লাস্টিক আসায় দেশের অনেক গাছ রক্ষা পেয়েছে একথা যেমন সত্যি তেমনি প্লাস্টিক আজ আমাদের পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য এক মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে।
প্লাস্টিকের অতিব্যবহার সার্বিকভাবে আমাদের জীবন ও পরিবেশের ক্ষতি করছে। এসব প্লাস্টিক পণ্য অধিকাংশই পুনঃচক্রায়ন হয় না। ব্যবহার শেষে এগুলো পরিবেশে বর্জ্য হিসেবেই থেকে যায় বছরের পর বছর। পচেও না, গলেও না। মাটি, পানি ও বায়ুর সঙ্গে মিশেও যায় না।
আমাদের এই ঢাকা শহরেই প্রতিদিন গড়ে ৬৪৬ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। তবে, এই প্লাস্টিকের অতি ব্যবহার কেবল আমাদের দেশেই নয়, অন্য দেশেও প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়ে যাচ্ছে। আমেরিকায় প্রতি বছর ৫ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদন হয়। এর মাত্র ২৪ শতাংশ পুনঃচক্রায়ন হয়। বাকি (৩.৮ মিলিয়ন টন) প্লাস্টিক বর্জ্য আকারে পরিবেশে পরিত্যক্ত হয়। পরিবেশের সঙ্গে বিলীন হয়ে এসব প্লাস্টিক পরিবেশের প্রতিটি উপাদানের ক্ষতি করে। মাটি, পানি ও বায়ু সব কিছু্ই প্লাস্টিক দূষণের শিকার হয়। সাগরে পতিত হলে এগুলো সাগরের জলরাশি ও প্রাণীকূলের প্রতিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
প্লাস্টিক একটি অপচ্য পদার্থ। এটি পুনঃচক্রায়ন না হওয়া পর্যন্ত পরিবেশেই অবস্থান করে। ক্ষেত্রবিশেষে এসব প্লাস্টিক এই পরিবেশেই ৪০০ বছর থেকে ১০০০ বছর পর্যন্তও থেকে যায়। মাটি, পানি বা সাগর- যেখানেই ফেলা হোক না কেন- প্লাস্টিক পরিবেশের ক্ষতি করবেই।
সাগরে বা পানিতে পতিত হলে এগুলোর ক্ষুদ্র কণা মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর খাদ্যকণার মাধ্যমে তাদের শরীরে প্রবেশ করে। এভাবে ধীরে ধীরে ওইসব প্রাণীকূলের স্বাভাবিক স্বাস্থ্য, বংশবিস্তার ও প্রজনন চক্রেও পরিবর্তন সাধন করে।
এছাড়া মাটিতে পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা বিভিন্ন গবাদিপশু ও অন্য পশু-পাখির খাদ্যমূলের সঙ্গে মিশে ওইসব প্রাণীর স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি করে। এভাবে জলজ ও স্থলজ প্রাণীর মাধ্যমে মানুষের শরীরেও এসব প্লাস্টিক অতি ক্ষুদ্ররূপে ধীরে ধীরে প্রবেশ করে। ফলে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে মানুষ ও অন্য প্রাণীর স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করে। কিন্তু এসব ক্ষতি ধীরে ধীরে প্রতীয়মান হয়। ফলে অধিকাংশ সময়ই এসব ক্ষতির কারণ অগোচরেই রয়ে যায়। প্লাস্টিক এভাবেই পরিবেশ ও অন্যান্য যাবতীয় প্রাণীরই ক্ষতি করে। সব প্রাণীর স্বাস্থ্য ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাই হ্রাস করে। এর ক্ষতির তালিকা অনেক দীর্ঘ।
কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় কয়েকটি দেশ প্লাস্টিক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। কিছু দেশ প্লাস্টিক দূষণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিধি নিষেধ আরোপ করেছে। অনেক দেশ প্লাস্টিক বর্জ্যের ওপর কর আরোপ করেছে। কিছু দেশ প্লাস্টিক বর্জ্যকে পুনঃচক্রায়নের ওপর জোর দিচ্ছে।
ভারত প্লাস্টিক বোতলের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে নীতি প্রণয়ন করেছে। সিকিম রাজ্য বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠান ও সভায় প্লাস্টিক বোতলের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। বিহার রাজ্যেও সরকারি সভায় প্লাস্টিক বোতলের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিছু কিছু রাজ্য শূন্য বর্জ্য ক্রীড়াস্থান এর লক্ষ্যে কাজ করে। আমাদের দেশেও এরকম কার্যক্রম হাতে নেওয়া জরুরি।
কিন্তু আমাদের দেশে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিশেষ কোনো আইন বা বিধি নেই। পরিবেশ দূষণ রোধে যদিও একাধিক পরিবেশ বিষয়ক আইন ও বিধি আছে। তবে, প্লাস্টিক জাতীয় পণ্য ব্যবহার ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বিশেষ আইন ও বিধি থাকা জরুরি। সরকার এক সময় পলিথিন নিষিদ্ধ করেছিল। এর সুফলও আমরা পেয়েছিলাম। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে পলিথিনের ব্যবহার আবার ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছে। কাজেই পলিথিন ও প্লাস্টিকের এরকম যত্রতত্র ব্যবহার রোধ করতে হবে।
দেশে প্লাস্টিক উৎপাদন, বিপণন ও এর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনার অভাব রয়েছে। বৃহৎ পরিসরে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কোনো শ্রেণিভিত্তিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই। এখানে সব ধরনের বর্জ্যই একই পদ্ধতিতে সংগৃহীত ও পরিশোধিত হয়, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
কাজেই প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার হ্রাস করতে হবে। বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব পাট বা অন্যান্য ব্যবহার্য সামগ্রী তৈরি করতে হবে। ব্যবহার রোধে প্রয়োজনে পুলিশংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এর উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহারে আইন প্রণয়ন ও এর কঠোর বাস্তবায়ন জরুরি। গণমাধ্যমে এর বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। এছাড়া প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে সহজে পচনশীল (বায়োডিগ্রেডেবল) প্লাস্টিকের ব্যবহারকে উৎসাহিত করতে হবে। পাটজাত দ্রব্যকে প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে।
সর্বোপরি দেশের মানুষকে সম্পৃক্ত করে পরিবেশ আন্দোলন বেগবান করতে হবে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক স্তরে পরিবেশ রক্ষায় মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। পরিবেশ এমন একটি বিষয় যেখানে দেশের প্রতিটি নাগরিককে ইতিবাচকভাবে অংশগ্রহণ করতে হয়। সবার অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রয়াসই পরিবেশ রক্ষার মূল চালিকাশক্তি। সময় হয়েছে আজ প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখার, পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে আসার।
লেখক: আইনজীবী, কলাম লেখক।
এইচআর/ফারুক/এএসএম