শিক্ষক সমিতির সভাপতির প্রশাসনিক পদ গ্রহণ: মূল্যবোধের অবক্ষয়
বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মূল্যবোধের অবক্ষয় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়ে আসছে বেশ কিছুদিন ধরেই। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের বিষয়টি এই আলোচনার নতুন সংযোজন, যা ইতোমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। ক্ষমতার এই অভূতপূর্ব একীকরণ, যেখানে দরকষাকষিকারী কর্তৃপক্ষ এবং প্রশাসন একে অপরের সাথে জড়িত, শিক্ষকদের অধিকার এবং কল্যাণের বিষয়টি ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। এই ধরনের ঘটনা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আপসহীন প্রতিনিধিত্ব, সম্ভাব্য স্বার্থের দ্বন্দ্ব এবং একাডেমিক স্বাধীনতার মারাত্মক ক্ষয়ের ভয়ঙ্কর সম্ভাবনার মুখোমুখি করেছে।
উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের অধিকার ও স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করতে এবং একটি অনুকূল একাডেমিক পরিবেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শিক্ষক সমিতির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এই অ্যাসোসিয়েশনের মূল কাজ হচ্ছে সম্মিলিত দরকষাকষির জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম প্রদান করা, শিক্ষক এবং প্রশাসনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করা, শিক্ষকদের কল্যাণ রক্ষা করে এবং মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে ভূমিকা রাখা।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতির সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার ঘটনাটি শিক্ষাবিদদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এই পদক্ষেপটি স্বার্থের একটি মৌলিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে, যা সমিতির উদ্দেশ্য এবং স্বায়ত্তশাসনকে ক্ষুণ্ণ করবে। শিক্ষক সমিতি দরকষাকষি কর্তৃপক্ষ হিসেবে ঐতিহ্যগতভাবে শিক্ষকদের অধিকারের পক্ষে কাজ করে এবং কার্যকরভাবে সমিতির সদস্যদের স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রশাসনের সাথে দরকষাকষি করে।
একজন শিক্ষকের ভূমিকার এই সংমিশ্রণ থেকে যে সব বিষয় উদ্বেগের কারণ হতে পারে সেগুলোর মধ্যে একটি হলো শিক্ষকদের অধিকার রক্ষার আন্দোলনে প্রশাসনের সাথে সম্ভাব্য আপস। ক্ষমতার সুস্পষ্ট বিভাজন ছাড়া, দরকষাকষি কর্তৃপক্ষের প্রধানের পক্ষে শিক্ষাবিদদের কল্যাণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে দরকষাকষি করা সম্ভব নয়। একই ব্যক্তি দ্বৈত দায়িত্ব পালন করলে প্রয়োজনের সময় শিক্ষকদের স্বার্থের চেয়ে তিনি প্রশাসনিক উদ্দেশ্যগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে পারেন। ফলে দরকষাকষির ক্ষমতা কমে যেতে পারে, অপর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্ব এবং দীর্ঘ স্থাপিত সুরক্ষা ব্যবস্থার নষ্ট হতে পারে, যা শিক্ষকদের অধিকার এবং কাজের পরিবেশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
একাডেমিক স্বাধীনতা যাকে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয় তা ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে এই ধরনের পরিস্থিতিতে। জ্ঞান এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার জন্য শিক্ষকদের তাদের মতামত প্রকাশ করার, সমালোচনামূলক আলোচনায় অংশগ্রহণ করার এবং বিদ্যমান দৃষ্টান্তগুলো চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা থাকা অপরিহার্য। যাই হোক, যখন দরকষাকষি কর্তৃপক্ষ প্রশাসনের সাথে একীভূত হয়, তখন এই বিষয়গুলো চর্চার বিষয়ে উদ্বেগ দেখা দিতে পারে। সমিতির সদস্যরা ভিন্নমত প্রকাশ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হতে পারেন বা অর্থপূর্ণ সমালোচনায় অংশগ্রহণের আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারেন, যা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে দমিয়ে রাখে এবং শ্রেষ্ঠত্বের অন্বেষণে বাধা দেয়।
তাছাড়া, দায়িত্বের আন্তঃসংযোগ সম্ভাব্য স্বার্থের দ্বন্দ্বকে ঘিরে নৈতিকতার উদ্বেগ উত্থাপন করেছে। শিক্ষক সমিতির সভাপতি দরকষাকষি এবং প্রশাসনিক উভয় পদে অধিষ্ঠিত থাকলে তিনি পরস্পরবিরোধী আনুগত্য এবং বাধ্যবাধকতার সম্মুখীন হতে পারেন। একই সাথে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করার সময় শিক্ষকদের স্বার্থের ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে একটি অনুভূত পক্ষপাত তৈরি করতে পারে, যা দরকষাকষির প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষুণ্ণ করে এবং সমিতির সদস্যদের মধ্যে আস্থা নষ্ট করতে পারে।
ক্ষমতার এই একীকরণের প্রভাব শিক্ষকদের তাৎক্ষণিক উদ্বেগের চেয়েও ব্যাপক। একটি মানসম্পন্ন শিক্ষার প্রাথমিক সুবিধাভোগী হিসেবে শিক্ষার্থীরাও এ ঘটনার নেতিবাচক পরিণতি ভোগ করতে পারে। একটি আপসমূলক শিক্ষক সমিতি শিক্ষকদের মধ্যে কাজের সন্তুষ্টি হ্রাস করতে পারে এবং শিক্ষার সামগ্রিক গুণমান ও শিক্ষার্থীদের শেখার অভিজ্ঞতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। তদ্ব্যতীত, অ্যাসোসিয়েশনের দরকষাকষির ক্ষমতা হ্রাস পেলে, এটি উন্নত অবকাঠামো, সংস্থান এবং একটি সহায়ক শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হতে পারে।
শিক্ষকদের অধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সততা বজায় রাখতে এ ধরনের ঘটনাগুলো উৎসাহিত না করে এর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। যে ব্যক্তি সমিতির সভাপতি হওয়া সত্ত্বেও প্রশাসনিক পদ গ্রহণ করেছেন তার সম্ভাব্য স্বার্থের সংঘাতের সমস্যা কাটিয়ে উঠতে যে কোনো একটি পদ থেকে তার পদত্যাগ করা উচিত। সমিতির সদস্যদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সময় এ ধরনের ব্যক্তিদের সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। এমনকি উপাচার্য মহোদয়ের উচিত হয়নি দরকষাকষিকারী সংস্থার প্রধান কাউকে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদের নিয়োগ দেওয়া। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দরকষাকষি কর্তৃপক্ষ এবং প্রশাসনিক অবস্থানের মধ্যে একটি স্পষ্ট পার্থক্যের জরুরি প্রয়োজনকে সব স্টেকহোল্ডারকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে।
তাছাড়া, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা শিক্ষকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য পরিকল্পিত যে কোনো সিস্টেমের কেন্দ্রীয় নীতি হওয়া উচিত। দরকষাকষি কর্তৃপক্ষ নির্বাচনের প্রক্রিয়া উন্মুক্ত, ন্যায্য এবং যোগ্যতাভিত্তিক হওয়া উচিত। শিক্ষকদের অধিকারের পক্ষে ওকালতি করার প্রমাণিত ট্র্যাক রেকর্ড থাকা ব্যক্তিদের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া উচিত, যিনি একাডেমিক সততার নীতিকে সমুন্নত রাখতে পারবেন এবং এই পদের বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখতে পারবেন।
তদ্ব্যতীত, এ ধরনের পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সংলাপ এবং অন্তর্ভুক্তির সংস্কৃতিকে লালন করা অপরিহার্য। প্রশাসন, অনুষদ সদস্য এবং শিক্ষক সমিতির মধ্যে যোগাযোগের সুবিধার্থে নিয়মিত আলোচনা এবং উন্মুক্ত ফোরামের আয়োজন করা উচিত। এই ধরনের আলোচনা এই উদ্বেগগুলো সমাধান করতে, এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য সহযোগিতা জোরদার করতে সহায়তা করবে৷
শিক্ষকদের অধিকার রক্ষায় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অখণ্ডতা বজায় রাখার ক্ষেত্রেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। একই সাথে দরকষাকষি কর্তৃপক্ষ এবং প্রশাসনিক পদে দায়িত্ব পালন করা যাবে না মর্মে বিদ্যমান নীতি ও বিধিগুলো পর্যালোচনা এবং সংশোধন করার জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। ভবিষ্যতে স্বার্থের সংঘাত প্রতিরোধ করতে এবং শিক্ষক সমিতিগুলোর স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে এই নির্দেশিকাগুলো কঠোরভাবে প্রয়োগ করা উচিত।
শিক্ষকদের মধ্যে পেশাগত উন্নয়ন এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির সংস্কৃতির প্রচার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্রমাগত শেখার, গবেষণা এবং সহযোগিতার সুযোগ শিক্ষার গুণমানকে উন্নত করতে পারে এবং শিক্ষাবিদদের তাদের অধিকারের জন্য কার্যকরভাবে সমর্থন করার ক্ষমতা দিতে পারে। শিক্ষকদের পেশাগত উন্নতিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে, সরকার একটি দক্ষ এবং অনুপ্রাণিত শিক্ষক সম্প্রদায় গড়ে তুলতে পারে, যা দেশের শিক্ষা খাতের অগ্রগতিতে অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
তাছাড়া, সুশীল সমাজের সংগঠন এবং মিডিয়াসহ বৃহত্তর সম্প্রদায়ের এ ধরনের বিষয়গুলোতে সোচ্চার থাকা প্রয়োজন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ক্ষমতা একত্রীকরণের সম্ভাব্য পরিণতি তুলে ধরে, এই স্টেকহোল্ডাররা সচেতনতা বাড়াতে পারে, পরিবর্তনের পক্ষে সমর্থন করতে পারে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে চাপ দিতে পারে।
উপসংহারে, বাংলাদেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতির সভাপতির প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন শিক্ষকদের অধিকার রক্ষা এবং একাডেমিক স্বাধীনতা সংরক্ষণের বিষয়ে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে। স্বার্থের সম্ভাব্য দ্বন্দ্ব, আপসমূলক প্রতিনিধিত্ব এবং স্বায়ত্তশাসনের অপব্যবহার শিক্ষা সম্প্রদায়ের জন্য উল্লেখযোগ্য হুমকি সৃষ্টি করেছে। এ ধরনের দৃষ্টান্তের মাধ্যমে সেই মূল্যবোধের অবক্ষয়ের চিত্র ফুটে উঠেছে।
দরকষাকষিকারী কর্তৃপক্ষ এবং প্রশাসনিক অবস্থানের মধ্যে একটি স্পষ্ট পার্থক্য থাকা বাঞ্ছনীয় কারণ একি ব্যক্তির দুই ধরনের দায়িত্ব পালনের ঘটনাটি শিক্ষকদের অধিকার এবং কল্যাণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অন্তরায় হতে পারে। ফলে, শিক্ষাক্ষেত্রের সব অনুঘটকদের উচিত নিজেদের নৈতিকতার মানের অনুশীলনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়কে উন্মুক্ত জ্ঞান চর্চার স্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। দরকষাকষিকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে একটি লাভজনক গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনের বিষয়টি শিক্ষকদের স্বাধীনতাকে যেমন বাধাগ্রস্ত করতে পারে, তেমনি ব্যক্তিগতভাবে সেই শিক্ষকের সম্মানহানি করতে পারে।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম