ভূ-স্বর্গ কাশ্মীরে মুগ্ধ জি-২০ দেশগুলো

ফারাজী আজমল হোসেন
ফারাজী আজমল হোসেন ফারাজী আজমল হোসেন
প্রকাশিত: ০৯:৫১ এএম, ০৪ জুন ২০২৩

ভূ-স্বর্গ কাশ্মীরে জি-২০ সম্মেলন আয়োজনকে কেন্দ্র করে কম সমালোচনা সহ্য করতে হয়নি ভারতকে। কিন্তু সম্মেলন শেষে নিন্দুকদের সমালোচনার বদলে গুরুত্ব পেয়েছে জি-২০ দেশগুলোর ভারতের কাশ্মীর নিয়ে করা ইতিবাচক সকল আলোচনা। কাশ্মীর উপত্যকার সৌন্দর্যের পাশাপাশি উন্নয়নে মুগ্ধ তারা।

জি-২০ সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত প্রতিনিধিরা ভূ-স্বর্গ বলে পরিচিত কাশ্মীরের উন্নয়নে ভারত সরকারের গৃহীত প্রকল্পগুলোরও ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। জঙ্গিদের হুমকি উপেক্ষা করে নির্বিঘ্নেই সম্মেলন শেষ হয় উপত্যকায়। পর্যটনের বিকাশে এই সম্মেলনকে বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দেয় ভারত সরকার। কাশ্মীরের সাধারণ মানুষও মুখিয়ে ছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত অতিথিদের স্বাগত জানাতে। অতিথিদের বরণ করতে ছিলো না কোন কার্পণ্য। অতিথিরাও স্থানীয়দের আতিথেয়তায় নিজেদের খুশির কথাই শুনিয়েছেন। সবমিলিয়ে উৎসবে মেতে উঠেছিল ভারতের গোটা কাশ্মীর উপত্যকা।

বিশ্বের ২০টি অর্থনৈতিক দিক থেকে উন্নত দেশ মিলে গঠিত হয় জি-২০ বা গ্রুপ অফ টুয়েন্টি। বিশ্বের ২০টি দেশের অর্থমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নররা এই গোষ্ঠীর সদস্য। ১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক আর্থিক স্থিতিশীলতা উন্নয়ন সম্পর্কিত নীতি নিয়ে আলোচনার লক্ষ্যেই এই জি-২০ গঠিত হয়। বিশ্বের ১৯টি ধনী দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত এই গোষ্ঠীর সদস্যরা হলো আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, জাপান, মেক্সিকো, রাশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র।

২২ থেকে ২৪ মে পর্যন্ত অনুষ্ঠিত প্রস্তুতি বৈঠকে ১৬টি দেশের ৬০ জন প্রতিনিধি সম্মেলনে যোগ দেন। তবে সৌদি আরব, তুরস্ক, মিশর ও চীন এই সম্মেলন বয়কট করে। কিন্তু তাদের বয়কটও সম্মেলনে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারেনি। বরং কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, জঙ্গিবাদীদের পাকিস্তানি মদদের বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে ধরা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক দুনিয়ার সামনে খুলে গিয়েছে পাকিস্তানের মুখোশ। চীনও কূটনৈতিক ভাবে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে এই সম্মেলনে যোগ না দিয়ে।

জি-২০ গোষ্ঠীর সদস্য নয় বাংলাদেশ। তবে আয়োজক দেশ ভারতের আমন্ত্রণে এই সম্মেলনে অতিথি সদস্য হিসাবে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশও। সম্মেলনের ফাঁকে বিভিন্ন আলোচনায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপক প্রশংসা হয়। জি-২০ বৈঠক বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশেও বড় ভূমিকা রাখতে পারে। ভারতীয় কূটনীতিকদের মতে, দিল্লি চিরকালই ঢাকাকে পরম বন্ধু হিসাবে বিবেচনা করে। তাই জি-২০ সম্মেলনের আয়োজনেও বাংলাদেশকে বিশেষ আমন্ত্রিত দেশ হিসাবে যুক্ত করেছে। বাংলাদেশও সেই সুযোগ হাতছাড়া করেনি।

এই সম্মেলনের আয়োজন প্রসঙ্গে ভারতের পর্যটন সচিব অরবিন্দ সিং বলেন, জম্মু-কাশ্মীরকে দুনিয়ার পর্যটন মানচিত্রে নতুন করে তুলে ধরার ক্ষেত্রে এই সম্মেলন কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে। সেইদিক থেকে দেখতে গেলে সম্মেলন দারুণ সফল। পর্যটন বিকাশে অবকাঠামো ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সেদিক থেকে ভারত কাশ্মীরের বর্তমান উন্নততর অবকাঠামো এবং উপত্যকায় জঙ্গিবাদকে পরাস্ত করে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়টি তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে ভারত। সব দেশের প্রতিনিধিদের মুখে তাই কাশ্মীরের প্রশংসা শোনা যাচ্ছে এখন। পশ্চিমা দেশগুলোও বুঝতে পারছে, সীমান্তের ওপার থেকে চীনের বন্ধু দেশ পাকিস্তান ভারতীয় নাগরিকদের ওপর কীভাবে প্রাণঘাতী হামলা চালিয়েছে। মুসলিম দেশ হয়েও কাশ্মীরের নিরীহ মুসলিমদের ওপর ক্রমাগত আঘাত হানার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক স্তরে জঙ্গিবাদীদের মদদদাতা ইসলামাবাদ।

শ্রীনগরে সম্মেলনের মূল বিষয়ছিল, ‘কাশ্মীর ও সিনেমা শিল্প’। কাশ্মীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে বহু ভালো সিনেমা তৈরি হয়েছে। তবে সেখানে কিছুদিনের জন্য জঙ্গিবাদীদের অপতৎপরতায় সিনেমা শিল্পে ভাটা আসে। পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গিয়েছে এখন। আবারও লেন্সবন্দি হচ্ছে ভূ-স্বর্গের সৌন্দর্য। তাই ভারতের কেন্দ্রীয় পর্যটন প্রতিমন্ত্রী তথা জম্মুর ভূমিপুত্র, জিতেন্দ্র সিং বলেছেন, গত কয়েক বছরে কতটা বদল এসেছে আবহাওয়ায় এই বৈঠকের আয়োজনই হচ্ছে তার বড় প্রমাণ। নির্বিঘ্নে সম্মেলন শেষ হওয়ার জন্য তিনি পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি স্থানীয় নাগরিকদেরও ধন্যবাদ জানান। উধমপুর থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদের সদস্য জীতেন্দ্র সিং বলেন, কাশ্মীরের মানুষই উপত্যকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে।

ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কাশ্মীরের অবদান বলে শেষ করা যাবেনা বলে মনে করেন ভারতের পর্যটন প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, বহু ছবির শুটিং হয়েছে এখানে। কিন্তু বিদেশী শক্তির মদদে আচমকা ১৯৯০ সাল থেকে সিনেমা শিল্প থমকে যায়। তবে বর্তমান সরকারের চেষ্টায় আবার সেই সময় ফিরে এসেছে। সিনেমার মধ্য দিয়ে এখানকার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের পাশাপাশি বিদেশিদেরও কাশ্মীরের সৌন্দর্যকে সেলুলয়েড বন্দি করার আমন্ত্রণ জানান তিনি। ভারতের পর্যটন প্রতিমন্ত্রী জীতেন্দ্র সিং আরও জানান, কাশ্মীরে নতুন করে কেউ সিনেমা করতে চাইলে সরকার সবরকম সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।

৩৭০ ধারা বাতিলের পর জম্মু ও কাশ্মীর এখন উন্নয়নের শিখরে রয়েছে। ভারত সরকার সরাসরি মন দিয়েছে কাশ্মীরের উন্নয়নে। বেকারদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগে অবকাঠামোর উন্নয়নকে দেওয়া হয়েছে সর্বাধিক গুরুত্ব। শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ঢেলে সাজানো হয়েছে কাশ্মীরের পর্যটন শিল্পকেও। স্থানীয় হস্তশিল্পের পাশাপাশি বিশ্ববিখ্যাত আপেল বাগানেও এখন খুশির হাওয়া বইছে।

জঙ্গিবাদকে পরাস্ত করে আসলে কাশ্মীরের মানুষ এখন ভারত সরকারের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছেন। রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে যোগাযোগ ব্যবস্থারও ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বেড়েছে মানুষের জীবনযাত্রার মানও। বিদেশিরা কাশ্মীরের পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখে অভিভূত। আরও বেশি করে পর্যটক আসবে কাশ্মীরে, এই সম্ভাবনা তৈরি হওয়াতে খুব খুশি সাধারণ হোটেল ব্যবসায়ীরাও। সবমিলিয়ে কাশ্মীরে জি-২০ সম্মেলনকে ঘিরে রয়েছে বাড়তি এক উন্মাদনা।

সেপ্টেম্বরেই ভারতে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন। রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মেলনের আগে কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলন আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাছে ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর ভূখণ্ডের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরার প্রয়াস ১০০ শতাংশ সফল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পশ্চিমাদের মনে কাশ্মীর নিয়ে কিছুটা সন্দেহ থাকলেও, এখন তা পরিষ্কার হয়েছে বলেই অনেকে মনে করছেন। কারণ তাঁরা পাকিস্তানের জঙ্গিবাদকে মদদ দেওয়ার বিষয়টি যেমন বুঝতে পেরেছেন, তেমনি চীনের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবও টের পেয়েছেন। তাই সবদিক থেকেই শ্রীনগরের সম্মেলন সফল।

সেপ্টেম্বরে ভারতে অনুষ্ঠিতব্য জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিশা দিতে পারবে বলেও কূটনৈতিক মহলের অনুমান। ভারতের সভাপতিত্বে জি-২০ ইতিমধ্যেই সদস্য দেশগুলোর মনে আলাদা দাগ কাটতে শুরু করেছে।

ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরকে ঘিরে বারবার অপতৎপরতা চালানোর চেষ্টা করেছে পাকিস্তান। এই অঞ্চলে ধর্মের নামে তারা যেই জঙ্গিবাদ চালায় তা তিরস্কারের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে এই অঞ্চলের স্থানীয়রা। বিশেষত ৩৭০ ধারা বাতিলের পর থেকে এই অঞ্চলে সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতার পথ সহজ হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে কাশ্মীরের সঙ্গে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রবর্তনের টানেল পথ থেকে শুরু করেই এই অঞ্চলকে স্বাবলম্বী করতে হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি অন্যান্য সেবা কার্যক্রম নিশ্চিত করেছে ভারত।

সেই সঙ্গে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ব্যবসা ও চাকরির সুযোগের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি পর্যটকদের সাদরে আমন্ত্রণ জানাতে সক্ষম হয়েছে জম্মু ও কাশ্মীরের অধিবাসীরা। এক সময় শীতে কাশ্মীরে প্রবেশ করা ছিল বেশ দুর্গম ও অসম্ভব। কিন্তু এখন আপনিও আমি চাইলে বছরের যে কোনো সময় যেতে পারবো কাশ্মীরে। সেই সঙ্গে এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ পাকিস্তান ও তার জঙ্গিবাদকে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করায়, এই অঞ্চলে বিরাজমান রয়েছে এক শান্তিময় অবস্থা।

ভারতীয় উপমহাদেশে ভূ-স্বর্গ খ্যাত কাশ্মীর জি-২০ সম্মেলন শেষে আরও একবার বিশ্বের বুকে পরিচিত হয়ে উঠছে ভূ-স্বর্গ হিসেবে। আশা করা হচ্ছে এই সম্মেলনের মাধ্যমে আবারো পর্যটন ও সিনেমা খাতে পূর্বের জৌলুস ফিরে পাবে জম্মু ও কাশ্মীর।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

এইচআর/এমএস

ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ব্যবসা ও চাকরির সুযোগের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি পর্যটকদের সাদরে আমন্ত্রণ জানাতে সক্ষম হয়েছে জম্মু ও কাশ্মীরের অধিবাসীরা। এক সময় শীতে কাশ্মীরে প্রবেশ করা ছিল বেশ দুর্গম ও অসম্ভব। কিন্তু এখন আপনিও আমি চাইলে বছরের যে কোনো সময় যেতে পারবো কাশ্মীরে। সেই সঙ্গে এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ পাকিস্তান ও তার জঙ্গিবাদকে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করায়, এই অঞ্চলে বিরাজমান রয়েছে এক শান্তিময় অবস্থা।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।