জুলিও–কুরি পদক ও শান্তিবাদী বঙ্গবন্ধু

এমএম নাজমুল হাসান
এমএম নাজমুল হাসান এমএম নাজমুল হাসান , লেখক ও সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৬:১৪ পিএম, ২৩ মে ২০২৩

বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জন্য ২৩ মে ইতিহাস সমৃদ্ধ দিন। পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালি ছাড়া এমন কোনো জাতিসত্ত্বা নেই, যাদের একজন নেতা ও তার নেতৃত্বে দেশটি বিশ্বের বুকে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে।

আজ থেকে ৫০ বছর পূর্বে ১৯৭৩ সালের ২৩ মে বিশ্ব শান্তি পরিষদ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘‘জুলিও কুরি’’ পদকে ভূষিত করেন। যা ছিল বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর কর্মের প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।

বঙ্গবন্ধুকে তাঁর কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে বিশ্ব শান্তি পদক দেওয়া হয় বেশ কিছু কারণে। তারমধ্যে অন্যতম-

মাববিকতা
বঙ্গবন্ধু ছাত্রাবস্থা থেকেই ছিলেন পরোপকারী ও মানবতাবাদী। এটা তাঁর রাজনৈতিক ও বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে ফুটে ওঠে। যখন তিনি বিদ্যালয়ের ছাত্র তখন শীত নিবারণের জন্য গায়ের চাদর সহপাঠীকে দিয়ে দেওয়া ও গরীব দুঃখীদের নিজেদের গোলা থেকে ধান বিতরণ করা। এছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মানুষের করুণ আর্তনাদ তাঁর মনকে উদ্বেলিত করেছিল। তারই প্রেক্ষিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি কলকাতায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দুঃস্থ ও অনাহারীদের মধ্যে খাদ্য ও অন্যান প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করেছিলেন।

অধিকার আদায়ে সোচ্চার
বঙ্গবন্ধু ছোটবেলা থেকেই ছিলেন অধিকার সচেতন। তাই বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ে তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর। দেশভাগের পরে কলকাতা হতে ঢাকায় চলে আসা তরুণ ছাত্রনেতা ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রথম থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এদেশের মানুষের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার প্রয়াস শুরু করে। সেসবের বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই স্বোচ্চার ছিলেন তরুণ শেখ মুজিব। পাকিস্তানি শাসকরা প্রথমেই বাঙালির ভাষার উপর আক্রমণ করে। বাংলার ছাত্র-জনতা প্রতিবাদ করে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা আন্দোলনে তিনি কারান্তরীণ হন এবং সেখানে খুব অসুস্থ হয়ে পড়লে ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান।

অন্যায়ের সাথে আপোসহীন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে ছাত্রত্ব হারান ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তখন তার সাথে আন্দোলন করা অনেকে মুচলেকা দিয়ে ছাত্রত্ব ফিরিয়ে নিলেও তিনি তা করেননি।

শান্তির বার্তা নিয়ে বিশ্ব ফোরামে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আপাদমস্তক শান্তিপ্রিয় মানুষ। তিনি ১৯৫২ সালের অক্টোবরে চীনে অনুষ্ঠিত ‘পিস কনফারেন্স অব দ্য এশিয়ান অ্যান্ড প্যাসিফিক রিজিওন্স’ যোগ দেন। এই সম্মেলনে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত ৩৭টি দেশের শান্তিকামী নেতাদের সঙ্গেও মতবিনিময় করেন।

১৯৫৬ সালের পাঁচ থেকে নয় এপ্রিল সুইডেনের স্টকহোমে বিশ্বশান্তি পরিষদের সম্মেলনেও অংশ নিয়ে তিনি বলেন, বিশ্বশান্তি আমার জীবনের মূলনীতি। নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত ও স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষ, যেকোনো স্থানেই হোক না কেন, তাঁদের সঙ্গে আমি রয়েছি। আমরা চাই বিশ্বের সর্বত্র শান্তি বজায় থাকুক, তাকে সুসংহত করা হোক।

তাঁবেদারী রাজনীতিবিমুখ
বঙ্গবন্ধু তাঁবেদারী রাজনীতি পচ্ছন্দ করতেন না। স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পদচারণা ছিল জাতির পিতার। ১৯৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুকে বিদেশনীতি নিয়ে প্রশ্ন করেন মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড। তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি ভারতপন্থী নই, আমেরিকাপন্থী কিংবা চীনপন্থী নই, আমি আমার জনগণপন্থী। কতটা স্বাধীনচেতা আর দেশের জনগণের প্রতি ভালবাসা থাকলে এমন শব্দ উচ্চারণ করা সম্ভব।

নেতৃত্ববান ও কৌশলী
মানুষকে কাছে টানার সম্মোহনী শক্তি ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের। তাঁর এক ডাকেই ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পরিণত হয় জনসমুদ্রে। যেখান থেকে তাঁর অঙ্গুলি হেলুনিতে দেশ স্বাধীনের নির্দেশনা পায় দিকহারা বাঙালি জাতি। মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়মাস পাকিস্তানের করাগারে বন্দী থাকলেও বাঙালির মানসপটে আঁকা শেখ মুজিবকে চেতনায় রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন স্বাধীনতা প্রিয় বাঙালি জাতি।

দেশ পুনর্গঠন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কন্নোয়ন
দেশ স্বাধীনের পরে পাকিস্তানের বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়ে বাঙালি জাতির আলোর দিশারী হয়ে ফিরে আসা বঙ্গবন্ধু দেশকে ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত ও অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন । এবং ১৯৭২ সালের মার্চে ভারতীয় সৈন্য নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে মৈত্রী চুক্তি করেন। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সংঘাতময় পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যেগ নেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে সেভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থন দেওয়ায় সোভিয়েত নেতা ব্রেজনভের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সেদেশের জনগণকে ধন্যবাদ দিয়ে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন।

ফিরে দেখা
১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রেসিডেন্সিয়াল কমিটির সভায় বিশ্বের ১৪০টি দেশের ২০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুকে সারাবিশ্বের নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের নেতা হিসেবে জুলিও কুরি শান্তি পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এবং পরের বছর ১৯৭৩ সালের ২৩ মে বিশ্বশান্তি পরিষদের উদ্যোগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশীয় শান্তি সম্মেলনে পরিষদের মহাসচিব জেনারেল রমেশ চন্দ্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জুলিও কুরি পদক প্রদান করেন। যা ছিল বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের প্রথম কোন আন্তর্জাতিক সম্মান।

নোবেল বিজয়ী ফরাসি বিজ্ঞানী ম্যারি কুরি ও পিয়েরে কুরি দম্পতি বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় যে অবদান রেখেছেন তা স্মরণীয় করে রাখতে বিশ্ব শান্তি পরিষদ ১৯৫০ সাল থেকে শান্তি পদক প্রদান করে আসছে। কিন্তু ১৯৫৮ সালে থেকে এটা জুলিও- কুরি শান্তি পদক হিসেবে নাম প্রবর্তিত হয়।

জুলিও–কুরি শান্তি পদক অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ । পৃথিবীর নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করে যাওয়া ব্যক্তিবর্গকে এই পদক প্রদান করা হতো। তেমনি একজন মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে আজ থেকে ৫০ বছর পূর্বে এমন স্বীকৃতি দিয়ে বাঙালি জাতিকে করেছিল সম্মানিত। শান্তিবাদী বঙ্গবন্ধু জুলিও-কুরি শান্তি পদক পাওয়ার ৫০ বছর পূর্তিতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: প্রতিবেদক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)।

এইচআর/এএসএম

জুলিও–কুরি শান্তি পদক অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ । পৃথিবীর নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করে যাওয়া ব্যক্তিবর্গকে এই পদক প্রদান করা হতো। তেমনি একজন মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে আজ থেকে ৫০ বছর পূর্বে এমন স্বীকৃতি দিয়ে বাঙালি জাতিকে করেছিল সম্মানিত। শান্তিবাদী বঙ্গবন্ধু জুলিও-কুরি শান্তি পদক পাওয়ার ৫০ বছর পূর্তিতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।