অসহনীয় বৈষম্য

রাষ্ট্রকে দেখতে হবে সবাই যেন সমান সুযোগ পায়

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ১০:০৩ এএম, ২০ মে ২০২৩

বাংলাদেশে নাকি দ্রুত ধনী হওয়া যায়? দেশটি কী কেবলই ধনীদের দেশ হয়ে উঠছে? কথাগুলো নতুন করে আলোচনায় এলো সরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস)-এর মাধ্যমে।

গত বুধবার, ঢাকায় বিআইডিএস রিসার্চ অ্যালমানাক ২০২৩ সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে সংস্থার মহাপরিচালক বিনায়ক সেন জানান, করোনার সময়টায় ধনীদের আয় বেড়েছে ৬৪ শতাংশ। তিনি জানান, দেড় কোটির বেশি মানুষ মহামারির ধাক্কায় অধঃপতিত হয়েছে। তিনি জানান, মোট দরিদ্রের প্রায় ৫০ শতাংশ নতুন দরিদ্র, যারা নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে নেমে গেছে।

খুবই উদ্বেগজনক খবর, তবে নতুন কিছু নয় এ কারণে যে, আমরা জানি বাংলাদেশে বৈষম্য ক্রমবর্ধমান। বৈষম্যের এই কারণটিই কাঠামোগত। একটি বড় কারণ এই যে, আমাদের কর ব্যবস্থা পরোক্ষ কর নির্ভর যেটি প্রকারান্তরে নিবর্তনমূলক এবং দরিদ্র মানুষের জন্য ক্ষতিকর।

প্রত্যক্ষ কর যদি বেশি হতো, সেটা ধনীদের কাছ থেকেই আসতো। তা করতে না পেরে জাতীয় রাস্ব বোর্ড (এনবিআর) পুরো কর কাঠামোকেই পরোক্ষ কর নির্ভর করে রেখে সাধারণ মানুষের কাছে থেকে তার অজান্তে কর কেটে নিচ্ছে।

সেই ধনীরাও আবার অন্যরকম ধনী আমাদের। এ দেশের ধনীদের আয় যে ভাবে বেড়েছে, বিনিয়োগ প্রবণতা ততখানি বাড়েনি। প্রচারণা আছে, মানুষও বিশ্বাস করনে, সরকারও অস্বীকার করেনা যে ধনীরা টাকা পাচার করেন। পরোক্ষ কর প্রথা চরিত্রে নিপীড়ক, অর্থাৎ কার আয় কম বা বেশি, এই করের হার তার উপরে নির্ভর করে না। এখানে সবচেয়ে ধনী যে মানুষটি আর সবচেয়ে গরিব যে, প্রত্যেকেই সমান হারে পরোক্ষ কর দিতে বাধ্য।

যারা ধনী, তাদের থেকে বেশি হারে প্রত্যক্ষ কর আদায় করা যায়, কিন্তু এখানেই বর্তমান আমাদের ব্যবস্থার কাঠামোগত সমস্যা। আমাদের রাষ্ট্র কর্পোরেট কর কমিয়ে, কালো টাকা সাদা করার নামে কর কমিয়ে, পাচার করা ফেরত আনতে সামান্য করারোপ করে ধনীদের তুষ্ট করতে চায়, কিন্তু তারা টাকা ফেরত আনেনা, সাদা করার চেষ্টাও করেনা।

দেশের বেশির ভাগ মানুষ এখনও আয়কর-জালের বাইরে থেকে গিয়েছেন। দেশের মাত্র ১ শতাংশ মানুষ বার্ষিক রিটার্ন জমা দিয়ে আয়কর দেন। জিডিপির তুলনায় কর আহরণে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তলানির একটি। প্রত্যক্ষ কর আদায়ের সেই ঘাটতি পরোক্ষ করের মাধ্যমে পূরণ করা হলে দরিদ্র মানুষের উপরে তার অভিঘাত স্বভাবতই বেশি হবে।

২০২০ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গত দশ বছরে ১৪.৩ শতাংশ হারে ধনী বেড়েছে। নিশ্চয়ই এই ধারা এখনও অব্যাহত আছে। এই আল্ট্রা ধনীরা আবার বিনিয়োগে ততটা আগ্রহী নন। ফলে দেশের ভেতরে সম্পদ সৃষ্টি হচ্ছে কম।

বিআইডিএস প্রধান বলেন, তাদের সমীক্ষায় দেখা গেছে, চরম দরিদ্র পরিবারের ২৩.৫ শতাংশ জানিয়েছে, মহামারি চলার সময় তাদের সন্তানদের শিক্ষা বন্ধ করতে হয়েছে। শিক্ষা ও মানবিক পুঁজির বিকাশের ক্ষেত্রে শহরের দরিদ্র শ্রেণি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও দরিদ্রদের কাছ থেকে সরে গেছে আনেকখানি। এসব নতুন দরিদ্র মানুষকে আবার দারিদ্র্যসীমার ওপরে তুলতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ রাখেন বিনায়ক। বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনতে বিশেষ কর্মসূচি নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

বৈষম্য অর্থব্যবস্থার পক্ষে ভয়ংকর ক্ষতিকর। বিশেষত আর্থিক গতিভঙ্গের সময়, তীব্র অর্থনৈতিক বৈষম্য গভীর বিপদ ডেকে আনতে পারে। তার একটি দিক হল, জীবনধারণের ন্যূনতম উপাদানগুলি নাগরিকদের একটা বড় অংশের নাগালের বাইরে চলে যায়, যার কারণে সামগ্রিক জীবন মান কমে যায়। তার মধ্যে যেমন অন্ন-বস্ত্র রয়েছে, তেমনই রয়েছে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য যেমনটা বিআইডিএস বলছে।

বৈষম্য জিনিসটা এমন যে, এক প্রজন্মের আর্থিক বৈষম্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিকাশ-সম্ভাবনাকে খর্ব করে রাখে। যুগ যুগ ধরে সেই পরিবার বৈষম্যের মধ্যে ঘুরপাক খায়। সম্পদ যদি অতিধনীদের কুক্ষিগত হয়, তবে সার্বিক ভোগব্যয়ে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। আমরা প্রবৃদ্ধি নিয়ে বড় সন্তুষ্টির কথা বলি সেই আর্থিক বৃদ্ধিও ক্ষতির শিকার হয়।

বৈষম্য কমানোর কথা ভাবতেই হবে। প্রথম ভাবনা হলো সর্বজনীন উন্নয়ন যাকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন ইনক্লুসিভ গ্রোথ। এর মানে হল, সমাজের প্রত্যেক মানুষ একটি ন্যূনতম জীবনধারণের মান অর্জন করবে, যেমন কেউ দারিদ্ররেখার নিচে থাকবে না। সেটা করতে গেলে, আয়ের সমতা না থাকলেও স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিকাঠামো, আইনশৃঙ্খলা, আর্থিক সম্পদ, বিপণনের ব্যবস্থা, তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় সকলের নাগালে থাকা দরকার।

দেশে বৈষম্য কমুক, এটা সকলেই চায়। কিন্তু সেটা কীভাবে করা হবে সেই কৌশলটা অনুপস্থিত এবং সেই সুশাসনটাও নেই। একটা বিষয় পরিষ্কার হতে হবে যে আমাদের দরকার সুযোগের সাম্য, আয়ের সাম্য নয়। আয় বা সম্পদ সমান করার দাবি বাস্তব নয়। যখনই উন্নয়ন হয়, তার সাথে বাড়ে বৈষম্য। এই বৈষম্যকে জোর করে আটকানো যায় না। রাষ্ট্রকে দেখতে হবে সবাই যেন সমান সুযোগ পায় মৌলিক বিষয়গুলোতে।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।

এইচআর/এমএস

দেশে বৈষম্য কমুক, এটা সকলেই চায়। কিন্তু সেটা কীভাবে করা হবে সেই কৌশলটা অনুপস্থিত এবং সেই সুশাসনটাও নেই। একটা বিষয় পরিষ্কার হতে হবে যে আমাদের দরকার সুযোগের সাম্য, আয়ের সাম্য নয়। আয় বা সম্পদ সমান করার দাবি বাস্তব নয়। যখনই উন্নয়ন হয়, তার সাথে বাড়ে বৈষম্য। এই বৈষম্যকে জোর করে আটকানো যায় না। রাষ্ট্রকে দেখতে হবে সবাই যেন সমান সুযোগ পায় মৌলিক বিষয়গুলোতে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।