শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন
তিনি দেশে ফিরেছিলেন গণতন্ত্রের আলোকবর্তিকা হয়ে!
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলেও বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা প্রহসনের মামলায় বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসির কাষ্টে ঝুলানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তারা সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার সাহস পায়নি। পরে পাকিস্তানি সামরিক শাসক বাধ্য হয় ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে মুক্ত করে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং ভারতের নয়াদিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
দেশে ফিরে এসে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি, অবকাঠামো এবং সার্বিকভাবে সামাজিক নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার কাজে লিপ্ত হন বঙ্গবন্ধু। তাঁর আজন্ম লালিত স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য যে সব কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন ছিল, তিনি তা নেওয়া শুরু করেছিলেন খুব অল্প সময়ের মধ্যেই। তবে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে অনেক ধরনের সমস্যা ছিল। সেই সমস্যাগুলো সঙ্গে নিয়ে তাঁকে সামনে এগিয়ে যেতে হয়েছিল। তাঁর শাসনামলের ঠিক সাড়ে তিন বছরের মাথায় পাকিস্তানি হানাদারদের দোসর কিছু বাঙালি রাজনীতিবিদ এবং সামরিক বাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে নৃশংসভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা সেদিন বেঁচে যান দেশের বাইরে অবস্থান করার জন্য।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে খন্দকার মোশতাক ক্ষমতা গ্রহণ করলেও পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছে সামরিক বাহিনী। ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতা পরিবর্তনের এক পর্যায়ে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি হ্যাঁ/না ভোটের আয়োজনের মাধ্যমে ক্ষমতা জায়েজ করার চেষ্টা করেছিলেন। সেই সময় সামরিক সরকার আওয়ামী লীগসহ অন্য বিরোধী দল যেন রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন না করতে পারে তার জন্য যা যা কার্যক্রম হাতে নেওয়ার দরকার ছিল তার সবগুলো হাতে নিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগকে বিভিন্ন উপ-দলে বিভক্ত করার প্রয়াস অব্যাহত ছিল।
এমন একটা অবস্থা তৈরি হয়েছিল যে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব একেবারে বিলীন প্রায়। ঠিক সেই সময় সামরিক জান্তার সব রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফিরে এসে ভঙ্গুর আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে সেই সময় সুসংগঠিত করা অত সহজ ছিল না। এছাড়া রাজনীতিতে তিনি ছিলেন একেবারেই নবীন। বিভিন্ন দল এবং উপ-দল এর মধ্যে সমন্বয় সাধন করে ভঙ্গুর প্রায় রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার প্রচেষ্টা তিনি অব্যাহত রেখেছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন।
তিনি আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করার পরে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। ইতোমধ্যেই রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে জিয়াউর রহমানের জায়গায় জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করে নিজেকে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে ঘোষণা করেন। প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে তিনিও তার ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। পরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অন্য রাজনৈতিক দলের সাথে যুগপৎ আন্দোলন করে স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এরশাদকে ক্ষমতা থেকে বিতরণ করার মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের দ্বিতীয় যাত্রা শুরু হয় ১৯৯১ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে।
১৯৮১ সালের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে ১৭ মে এর রাজনৈতিক গুরুত্ব বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে অপরিসীম। সেদিন যদি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসে আওয়ামী লীগের হাল না ধরতেন তাহলে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব একেবারে হুমকির সম্মুখীন হতে পারতো- এ কথা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়।
তাছাড়া আওয়ামী লীগ এতটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে সেই সময় সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। দলের মধ্যে ছিল নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব। বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দলের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার ফলে সব পক্ষের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। তিনি নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে দলকে সুসংগঠিত করতে থাকেন।
এরশাদ সরকারের পতনের পরে তাঁর মূল লক্ষ্যই ছিল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি। তিনি পুনরায় চেষ্টা করেছেন দলকে আরও শক্তিশালী করার। তাঁর প্রচেষ্টার ফলে ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিজয় অর্জন করে দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় তাঁরই নেতৃত্বে।
১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে তিনি এক দিকে যেমন সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে কাজ শুরু করেন, ঠিক তেমনি ভাবে বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় চার নেতার খুনিদের বিচারের কার্যক্রম শুরু করেন। কিন্তু তিনি সেই কাজ সমাপ্ত করতে পারেননি। ২০০১ সালের ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সাথে সাথে তাঁর সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৬ সালের শেষের দিকে তৎকালীন সরকারের বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয় বিশেষত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনকে কেন্দ্র করে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অভিপ্রায়ে তৎকালীন বিএনপি সরকার বিচারকদের চাকরির মেয়াদ বয়স ৬৫ থেকে ৬৭ বছরে উন্নীত করে এবং তৎপরবর্তী সময়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের বিভিন্ন ধরনের বিতর্কিত কার্যক্রমের ফলে সামরিক বাহিনী সমর্থিত এক ব্যতিক্রমী সরকার ব্যবস্থা চালু হয় দেশে। সে সরকার পরে চেষ্টা করেছিল দেশে বিরাজনীতিকরণ নীতি বাস্তবায়নের। ২০০৭ সালের প্রথম দিকে শেখ হাসিনা যখন তাঁর অসুস্থ বৌমাকে দেখতে যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন, তখন দেশে ফেরার সময় তাঁকে বিভিন্ন ভাবে বাধা দেওয়া হয়েছিল। তিনি সব রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ২০০৭ সালের ৭ মে দেশে ফিরে এসে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করেন এবং নির্বাচনের দাবির পক্ষে তাঁর মতামত তুলে ধরেন।
পরে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। সেই সময় থেকে শুরু হয়ে বর্তমান কাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার দেশ পরিচালনা করছে। বর্তমানে বাংলাদেশ যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে আজ থেকে ১৪ বছর আগে কেউ তা কল্পনাও করতে পারেনি।
তিনি শুধু আওয়ামী লীগকে সংগঠিতই করেননি, তাঁর কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের আস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন। যারা এক সময় বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে তকমা দিয়েছিল তারাই আজ বাংলাদেশকে এশিয়ান টাইগার কিংবা উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে তকমা দিচ্ছে। গত ১৪ বছরে বাংলাদেশের যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে তা পৃথিবীর অন্য দেশের কাছে বিস্ময়ের ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। তবে এই উন্নয়ন এমনিতেই হয়নি। এটি শুধু সম্ভব হয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্বের কারণে।
পৃথিবীতে কোনো সৃষ্টিই পূর্ণাঙ্গ নয়। অতএব শেখ হাসিনার সব কাজে সবাই একই রকম ভাবে খুশি হবে সেটিও কাম্য নয়। চলার পথে হয়তো তাঁর কাজের ভুল থাকতেই পারে। কিন্তু সেই ভুল খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। তিনি তাঁর বাবার আজন্ম লালিত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে হৃদয়ে ধারণ করে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন। তবে ১৯৮১ সালের ১৭ মে তিনি যদি দেশে না ফিরতেন তাহলে হয়তো বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যভাবে রচিত হতো।
এখনও হয়তো বাংলাদেশের জনগণ সামরিক বাহিনীর নিষ্পেষণে নিষ্পেষিত হতো এবং গণতান্ত্রিক যাত্রা আরও প্রলম্বিত হতে পারতো। তিনি সেই দিন দেশে ফিরে এসে দলকে যেমন শক্তিশালী করে দলকে ক্ষমতায় নিয়ে গেছেন, ঠিক একইভাবে জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের সব জনগণের আস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন। ২০২৩ সালে দাঁড়িয়ে আমরা এটাই প্রত্যাশা করি যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ২০৪১ সালে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম