বিপদে আমি না যেন করি ভয়
সভ্যতা যত এগিয়েছে, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানেরও তত উন্নতি হয়েছে। আকাশ থেকে পাতাল- সবকিছুই এখন মানুষের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু প্রকৃতির কাছে মানুষ এখনও অনেকটাই অসহায়। বাঁধ দিয়ে বন্যার ক্ষতি কিছুটা কমানো যায়। ভূমিকম্প বা বজ্রপাত আসে কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই, আচমকা, একেবারে বিনা মেঘে বজ্রপাত যাকে বলে।
তবে আমার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর লাগে ঘূর্ণিঝড়। যদিও এখন ঘূর্ণিঝড়ের প্রায় নিখুঁত পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব। মিনিটে মিনিটে এর গতিপথ, ভয়াবহতা মনিটর করা যায়। তাও প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের সামনে মানুষ আসলে অসহায়। কোনো কিছুতেই ঘূর্ণিঝড় আটকানো যায় না। ঘূর্ণিঝড় তার ইচ্ছামত শক্তি সঞ্চয় করে, ইচ্ছামত গতিপথ বদলায়। প্রযুক্তির অনেক অগ্রগতি সত্ত্বেও অনেক সময় ঘূর্ণিঝড়ের নিখুঁত পূর্বাভাস দেওয়া যায় না।
এই যেমন অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ কয়েকদিন ধরে অতি প্রবল আতঙ্কে কেটেছে বাংলাদেশের মানুষের দিনরাত। সৃষ্টিকর্তার অসীম রহমত, মোখা যতটা ভয়ঙ্কর হওয়ার কথা ছিল, ততটা হয়নি। পূর্ভাবাস অনুযায়ী মোখা তার পূর্ণ শক্তি নিয়ে বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন, টেকনাফ, কক্সবাজারের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার কথা ছিল। ১০ নম্বর মহা বিপৎসংকেত নিয়ে নির্ঘুম কেটেছে এসব এলাকার মানুষের রাত।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে প্রতিবছরই বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে থাকে বাংলাদেশ। ’৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতার কথা মনে করে এখনও প্রবীণরা আঁতকে ওঠেন। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতাও টাটকা। ’৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ে মারা গিয়েছিল ৫ লাখ মানুষ। ’৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ও কেড়ে নিয়েছিল ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষের প্রাণ।
২০০৪ সালের আগে ঘূর্ণিঝড়ের কোনো নাম ছিল না। নামকরণ শুরুর পর ২০০৭ সালের সিডর বা ২০০৯ সালের আইলার ক্ষতও এখনও পুরোপুরি শুকায়নি। সিডর কেড়ে নিয়েছিল ৬ হাজার মানুষের প্রাণ। তবে এরপর বেশ কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় এলেও তা ততটা ভয়াবহ হয়নি। মহাসেন, ফনী, বুলবুল, আম্পান বা সিত্রাংয়ের আঘাত তত তীব্র হতে পারেনি।
অনেকদিন পর একটা অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা, বাংলাদেশকে কাঁপিয়ে দিয়ে গেছে। তবে ঝড়ের আগে কম্পনটা যত বেশি ছিল, ঝড়ের পর ততটা নয়। আশঙ্কা করা হচ্ছিল মোখার প্রভাবে ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসে সেন্ মার্টিনের প্রায় পুরোটাই ডুবে যাবে। তছনছ হয়ে যেতে পারতো টেকনাফ এবং কক্সবাজার। উপকূলীয় অন্য এলাকায়ও জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা ছিল। ভাগ্যিস মোখা যতটা গর্জেছে, ততটা বর্ষেনি।
নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয় বলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাটাও আমাদের নিয়মিত করতে হয়। নিয়মিত করতে করতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমরা দক্ষতা অর্জন করেছি। বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এখন বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত। ‘মোখা’ মোকাবিলায়ও ব্যাপক প্রস্তুতি ছিল সরকারের। দুর্গত এলাকার মানুষদের আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া, মাছধরার ট্রলারগুলো যথাসময়ে ফিরিয়ে আনা থেকে শুরু করে জানমাল রক্ষায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়া ছিল।
উদ্ধার ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায়ও ছিল ব্যাপক প্রস্তুতি। এটা মানতেই হবে সরকারের নেয়া নানা পদক্ষপের কারণে ক্ষয়ক্ষতি এখন অনেক কমে এসেছে। বিশেষ করে মানুষের জান বাঁচাতে আমাদের চেষ্টার কোনো কমতি নেই। এখন সময় এসেছে সম্পদ রক্ষার দিকেও মনোযোগী হওয়ার। একটা বড় ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে তাৎক্ষণিক ক্ষতির চেয়ে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবটা অনেক বেশি।
তাৎক্ষণিক ক্ষতি মোকাবিলায় আমাদের দক্ষতা উৎকর্ষের চূড়ায়, এখন ভাবতে হবে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব মোকাবিলার উপায়। বিভিন্ন ঝড়ে উপকূলীয় এলাকায় ঘরবাড়ি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উপকূলীয় এলাকায় কম খরচে টেকসই বাসস্থান নির্মাণের কথা ভাবতে হবে। ঘূর্ণিঝড়ে ফসলহানিও কৃষকদের নিঃস্ব করে দেয়। এখন যেহেতু অন্তত দুই সপ্তাহ আগে ঘূর্ণিঝড়ের পূর্ভাবাস পাওয়া সম্ভব, তাই আগে থেকেই ফসল রক্ষা বা ফসল তুলে ফেলার উপায় বের করতে হবে।
জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় মাছের ঘের। তাতেও ক্ষতিগ্রস্ত হন চাষীরা। আগে থেকে জানা থাকলে মাছের ঘেরগুলোতে উঁচু জাল বা অন্য কোনো উপায়ে সুরক্ষা দেওয়া যায় কি না, তারও একটা উপায় বের করতে হবে। তবে জলোচ্ছ্বাসে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয় উপদ্রুত এলাকার চাষীদের। লোনা পানি ঢুকে পড়ে বিস্তীর্ণ এলাকায়। আর সে পানি সহজে যায়ও না। পাম্প করে হলেও লোনা পানি দ্রুত সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে সেসব জমির উর্বরা শক্তি দীর্ঘমেয়াদে নষ্ট হয়ে যায়।
এই যে এত কিছু বললাম, উপকূলীয় এলাকার মানুষের কাছে কিন্তু ঘূর্ণিঝড় ডালভাত। ঢাকায় বসে আমরা ঘূর্ণিঝড় নিয়ে যতটা শঙ্কিত, উপকূলীয় এলাকার মানুষ কিন্তু ততটা নয়। পুরো সেন্টমার্টিন ডুবে যেতে পারে, এসন আশঙ্কা সত্ত্বেও কিন্তু সেখানকার অধিকাংশ মানুষ রয়ে গিয়েছিলেন। শনিবার মধ্যরাত পর্যন্তও টেকনাফের অনেক মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে যাননি। বাতাস শুরু হলে যাবেন বলে অপেক্ষা করছিলেন।
সম্ভবত ১৯৯৪ সালে পেশাগত কাজে একবার নোয়াখালীর একটি চরে গিয়েছিলাম। তখনই একটা ঝড় আসার খবর পাই। সিগনাল ধীরে ধীরে বাড়ছিল। আমরা দ্রুত মূল ভূখণ্ডে ফেরার জন্য অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেই চরের মানুষ লাল পতাকার নিচে বসে চুটিয়ে আড্ডা মারছিলেন। উল্টো তারা আমাদের সাহস দিচ্ছিলেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে লড়তে লড়তে বাংলাদেশের মানুষ একধরনের সাহস অর্জন করেছে। এই সাহসটা তাদের অন্তর্নিহিত।
এই যে বারবার বন্যায়, ঘূর্ণিঝড়ে তারা নিঃস্ব হয়, ঘরবাড়ি হারায়, ফসল হারায়; আমরা ভাবি এই মানুষগুলো কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু আমাদের শঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে তারা আবার ঘুরে দাঁড়ায়। আবার নিঃস্ব হয়, আবার ঘুরে দাঁড়ায়। বাংলার মানুষ বিপৎকে আর ভয় পায় না। তারা ভয়কে জয় করে আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। তাদের জন্যই বোধহয় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘ঝড়কে আমি করবো মিতে, ডরবো না তার ভ্রুকুটিতে’।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রাকৃতিক কিছু রক্ষাকবচ আছে। সিডর আর আইলায় আমাদের ক্ষতি আরও বেশি হতে পারতো। সুন্দরবন ঝড়কে বুকে আগলে আমাদের আরও বেশি বিপৎ থেকে রক্ষা করেছে। কিন্তু যেভাবে আমরা গাছ কাটার প্রতিযোগিতায় নেমেছি, একদিন হয়তো সামান্য ঝড়ই আমাদের কাবু করে দেবে। প্রাকৃতিক সুরক্ষার চেষ্টাটা আমরাই নষ্ট করে দেই। শুরুতেই বলেছি, ঘূর্ণিঝড় ঠেকানোর কোনো উপায় কারোই জানা নেই। আমাদের শুধু আরও সতর্ক থাকতে হবে, আরও প্রস্তুত থাকতে হবে। আর প্রকৃতিকে প্রকৃতি দিয়েই মোকাবিলায় আরও বেশি করে গাছ লাগাতে হবে।
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম