প্রকৃতি রক্ষা করলে প্রকৃতিও আমাদের বাঁচাবে

ড. মাহবুব হাসান
ড. মাহবুব হাসান ড. মাহবুব হাসান , কবি, সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৯:৩১ এএম, ১৪ মে ২০২৩

গাছ নিয়ে সরকারের কোনো ভাবনা নেই। এই সরল সত্যই এখন আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা। যদি ভাবনা থাকতো তাহলে সবুজ বাংলাদেশ থেকে ক্রমান্বয়ে নিঃশেষ হয়ে যেতো না গাছ-গাছালি। বিজ্ঞানীরা বলেন যে সবুজ গাছ হচ্ছে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য সর চেয়ে দরকারি উপাদান-উপকরণ।

কেননা, ওই গাছই আমাদের প্রধান শস্য অক্সিজেন ফ্যাক্টরি। আমাদের জন্য প্রকৃতির ওই উপাদান অক্সিজেন উৎপাদন ও সরবরাহ করে বন-জঙ্গল আর গ্রামের বাড়িগুলোতে জন্মানো বিভিন্ন রকম গাছপালা। আমরা টের পাই না যে ওই গাছগুলোই আমাদের প্রাণ বাঁচিয়ে রেখেছে। আমাদের চলার ক্ষমতা সৃষ্টি করে দিচ্ছে। তাই প্রকৃতিকে রক্ষা মানে আমাদের নিজেদেরই রক্ষা।

আমরা কি রকম অসচেতন ও আত্মপ্রবঞ্চক জাতি তা বোঝা যায় অক্সিজেন ফ্যাক্টরিগুলো কেটে সাবাড় করে দেয়ার মাধ্যমে। এই প্রশ্ন এ-কারণেই যে গাছ কেটে, বৃক্ষশূন্য নিরেট মাটিতে ইট আর সিমেন্টে গাঁথা দালান-কোঠা তৈরি করছি। একবারও ভাবিনি যে নিঃশ্বাস নেবার উপাদান ওই নিরেট দালান-কোঠায় আসবে কোথা থেকে। আমরা বিল্ডিং তুলে মানব সমাজের উন্নয়নকে আকাশচূড়ায় তুলে দিচ্ছি, কিন্তু একবারও মনে পড়ছে না যে বিনা খরচের অক্সিজেন ফ্যাক্টরিগুলো রাখা সবচেয়ে জরুরি।

কেন আমাদের ভাবনায় এই বোধ নেই? কারণ, আমরা কেবল দালান-কোঠারই উন্নয়ন চাই, তারই স্বপ্ন দেখি। ফলে, গাছপালা, বনজঙ্গল, সবুজ প্রকৃতি আমাদের স্বপ্ন ও আশার প্রতীক হয়ে উঠেছে। তা কেবল প্রতীক, যেন বাস্তব নয়। অথচ এ দেশটির পতাকার সিংহ ভাগ সবুজ রং দিয়ে ঘেরা। মাঝখানের লালের বৃত্ত তো সূর্রর প্রতীক।

একটি দেশের জন্য মিনিমাম সবুজ বনের পরিমাণ থাকতে হবে সেই দেশের আকারের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত। এককালে এই বাংলাদেশে সেই পরিমাণ বন ছিল। বন কেটে গ্রাম ও শহর সৃষ্টি করে সভ্য হয়েছি আমরা, প্রগতির চাকায় যে গতি এনেছি, তাতে করে আমাদের ন্যাচারাল অক্সিজেন ফ্যাক্টরির সম্পদ কমে গিয়ে ৮ শতাংশে নেমেছে। এই হিসাব সরকারি কাগজে আছে, বাস্তবে আছে কি না, জানি না। আর নালা-ডোবা-খাল-বিল-নদনদী-ঝিল প্রভৃতি গ্রাস করে পানির প্রাকৃতিক উৎস নিঃশেষ করে ফেলেছি প্রায়। কিন্তু তারপরও আমাদের সামাজিক হুশ আর রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন কমেনি।

দিন কয়েক আগেই, ঢাকা মহানগরের দক্ষিণের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস বললেন, উন্নয়নের জন্য গাছ কাটতেই হয়। আমরা কেটেছি। কিন্তু গাছ লাগিয়েও দেবো। অর্থাৎ সিটি করপোরেশনই ‘প্রয়োজনে’ গাছ কেটেছে। হ্যা, এটাই তো সত্য, প্রয়োজনেই তো গাছ কেটেছে অনেকে। সেটা সরকারি তরফ থেকে, কখনো মহানগরের অভিভাবক সিটি করপোরেশনের তরফে, কখনো বাড়ি নির্মাণের প্রয়োজনে বাড়ি নির্মাতারা, পুকুর দখল করে, নালা ভরে, খাল বন্ধ করে ভূমিখোর দস্যুদের হাতে, খালের ওপর ‘সেতুভবন’ নির্মাণ করে শত শত প্রাকৃতিক জলাধারের ওপর তৈরি হয়েছে বিশাল বিশাল কংক্রিটের ভবন। এই সত্য সরকার লুকাবে কেমন করে?

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তরফ থেকে বলবেন, এই সেতুভবন আমরা বানাইনি। আমরাও সেটা বলছি না। যে সরকারই তা বানিয়ে থাকুন না কেন, তারা তো তখন ক্ষমতার মগডালেই বসেছিলেন এবং প্রাকৃতিক খাল যা খাস জমি, তার ওপর তা প্রাকৃতিক প্রবাহ, তার ওপর সেতুভবন তৈরি করেছেন। খাস জমি কিন্তু জনগণের, সরকারের নয়। সরকার ওই ভূমি রক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণ করার অধিকারী মাত্র, গ্রাস করার জন্য নয়। এ-রকম অনেক খাস জমিই সরকারি তরফে গ্রাস হয়েছে, যেন খাস ভূমি তাদের নিজস্ব সম্পত্তি। সরকারের হৃদয় থেকে এই মাইন্ডসেট শেকড়শুদ্ধ উপড়ে ফেলতে হবে, তা নাহলে খাস জমি, খাল-বিল- ঝিল সবই দখল হয়ে যাবেই।

২.
দিন কয়েক আগে, এপ্রিলের শেষ দিকে উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম ২ কোটি গাছ লাগানোর ঘোষণা দিয়েছেন তার এরিয়ায়। তার মুখ থেকেই সেটা শুনেছি টিভি সংবাদে। খুশিতে করতালি দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল, কিন্তু তা করা গেলো না। খবরেই শুনলাম, যে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানটিকে গাছ লাগানোর কাজটি আতিক সাহেব দিয়েছেন, তারাই প্রধান হিট ম্যানেজমেন্ট কর্মকর্তা হিসেবে তারই কন্যাকে নিয়োগ দিয়েছে।

এ-বিষয়ে মেয়েটি যথেষ্ট উপযুক্ত হলেও কথা উঠেছে যে, মেয়র আতিক তাদের কাজটি দেওয়ায় তারা তার কন্যাকে ওই পদে নিয়োগ দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে পড়াশোনো করে সেখানকারই ওই অফিসে তিনি নিয়োগ পেয়েছেন। তার কাজ করার এলাকা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার উত্তরের মেয়রের অফিসে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ কথা হচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন এটাতো বৈশাখী গুমোট আবহাওয়াকে দূর করার মতোই এক নিউজ। যাতে সাধারণ মানুষ স্বস্তি পেতে পারে।

যে প্রতিষ্ঠানই লাগাক না কেন, ঢাকা মহানগর যে ২ কোটি গাছ পেতে যাচ্ছে এটাই তো সুখের খবর। কিন্তু কথা হচ্ছে ওই গাছগুলো, মানে গাছের চারাগুলো কোথায় রোপণ করা হবে? সেই জায়গা কোথায়? বিশাল বিশাল বিল্ডিংয়ের বাইরে তো মহানগরের বসতি এলাকা ও অফিস এলাকায় গাছ নেই। ধরুন, মতিঝিলের অফিস পাড়া, দিলকুশার অফিস পাড়া, পল্টন, নয়াপল্টনসহ গোটা দক্ষিণ ও উত্তর সিটির বসতি এলাকাকে বৃক্ষশূন্য করা হয়েছে, ধীরে ধীরে উন্নত বসবাসের নামে। আর ভরে ফেলা হয়েছে যত সব জলাধার ও নাব্য উৎস।

এখনো পানির উৎস পুকুর বা খাল দখল চলছে। সেই দখলের পাশাপাশি চলছে গাছশূন্যকরণ মহানগর প্রকল্প। প্রয়োজনের কথা বলে ওই কাজ চলছে। কিন্তু প্রয়োজনের কথা বলে তো খাস জমিতে পুকুর কেটে পানির উৎস সৃজন করার কোনো প্রকল্প আমাদের চোখে পড়ছে না। কেবল গাছ কেটে, পুকুর বা ডোবা-নালা ভরাট করে উন্নয়নের কংক্রিট স্তম্ভ কি আমাদের ডেভেলপমেন্ট যজ্ঞ চলতেই থাকবে? নাকি সরকার এ-নিয়ে ভাবিত হবেন?
৩.
উত্তর সিটি করপোরেশন যদি গাছ লাগানোর প্রকল্প নিয়ে থাকে, শুধু গাল-ভরা কথার কথা না হয়, তাই আমরা দেখতে চাই। কারণ এর আগে আমরা উত্তরের মেয়রকে দেখেছি, মহানগরের খাল উদ্ধারের কথা বলতে। তিনি কোনো বাধাই মানবেন না বলে আমাদের জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই খালের পূর্বপাশে এসে তার নৌকাভ্রমণ বা যাত্রা ঠেকেছিলো সেতুভবনের সামনে।

তিনি বলেছিলেন যে ওই ভবনটি খাল ভরাট করে নির্মিত হয়েছে। সেটা আওয়ামী সরকারের সময় হয়েছে নাকি বিএনপি বা জাতীয় পার্টির সময় হয়েছে, সেটা তিনি পরিস্কার করেননি। কেন করেননি, সে দায় তার। যে সরকারিই সেটা করুন, খাল উদ্ধারে নেমে ওইখানে থেমে গেলে তো তা হবে কথামালার রাজনীতি। একজন জনপ্রতিনিধির কাছে কি আমরা কেবল বাগাড়ম্বর শুনবো? নাকি সত্যিকার কাজ দেখবো?

সেই সূত্র ধরেই আজকে আবারো বলতে চাই মহানগরে অক্সিজেন ফ্যাক্টরি গাছ রোপণ প্রকল্প সত্যিই কি গাল-ভরা কথার কথা নয়। সত্য সত্যই ওই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য মেয়র সাহেব হন্যে হচ্ছেন। কিন্তু বিদেশি কোম্পানিটি কি কি গাছ মানে বাংলাদেশের আবহাওয়ার উপযোগী গাছ লাগাবে নাকি ইউক্যালিপটাসজাতীয় প্রায় পত্রহীন, ছায়া দিতে না পারা গাছ লাগাবে?

আমরা চাই ছায়া দেয় এমন বৃক্ষ। আমরা চাই ফলদ ও ঔষধি বৃক্ষ। আমরা চাই ছায়া দেবে পথিককে, গরমে প্রশান্তি দেবে এবং অক্সিজেন দেবে। মহানগরকে গরমের তাপদাহ থেকে অনেকটাই রক্ষা করবে। আমরা যে বৃক্ষশূন্য কংক্রিটের মহানগর গড়ে তুলেছি, সেই নির্মম পরিবেশ থেকে এখানকার বসতিদের রক্ষার আয়োজন হোক।

বৃক্ষ রোপণের পাশাপাশি করতে হবে পানির আধার সৃষ্টি করা। সে-রকম জায়গা কি আছে সরকারের খাস ভূমি এলাকায়। আর সেটা হতে হবে মহানগরের মধ্যিখানে এবং প্রান্তিক এলাকায়। আর হাতিরঝিলের মতো জলাধার ও সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য বৃক্ষময় নান্দনিক বাগান প্রকল্প নিতে হবে মহানগরের বিভিন্ন এলাকায়।

এবং সেই পরিকল্পনা যে ভালো একটি নান্দনিক পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়, সেটাও আমাদের চাওয়ার একটি প্রধান দাবি। ঢাকা মহানগর এখনো তার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের কাজ সম্পন্ন করে ওঠেনি। ক্রমবর্ধমান এই মহানগরকে সত্যিকার একটি কসমোপলিটান মহানগরে পরিণত করতে হলে, জলাধার ও বৃক্ষ এবং নান্দনিক ফলের বাগানে সাজাতে হবে।

নগর পরিকল্পনাবিদরা, আমি যতোটা দেখেছি গত ৫২ বছরে, সেইরকম পরিকল্পনাই করেছেন, কিন্তু রাজনৈতিক সরকারের ক্ষমতালোভী লোকেরা সেই সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে দেয়নি। তারা রাজনৈতিক ভূমিখোর ও দস্যুদের সুহৃদে পরিণত হয়েছেন এবং পরিকল্পনাগুলোর ‘পরি’ ছিনিয়ে নিয়ে কেবল ‘কল্পনা’কে রাজনৈতিক ময়দানে ঘুড়ির মতো উড়িয়ে চলেছেন।

এখনো সময় শেষ হয়ে যায়নি। নতুন করে, নব উদ্যোগে সেই কাজ করা যেতে পারে। তবে সেই পরিকল্পনায় কেবল দলীয় রাজনীতিক ও সহযোগীদের লোভের জিহ্বাকে সামলে রাখতে হবে। নিশ্চয় আপনাদের মনে আছে যে বঙ্গবাজারে আগুন লাগার পর সিভিল ডিফেন্সের অগ্নিনির্বাপক গাড়িগুলো পানির কি রকম সংকটে পড়েছিল। তারা বুড়িগঙ্গা আর হাতিরঝিল থেকে পানি নিয়েছে।

পানি সংকটের জন্যও যে বিপুল সম্পদ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, সেটা মানবেন আশা করি। পুলিশ হেড কোয়ার্টারের সামনে যে পার্কটি রয়েছে সেখানে নান্দনিক জলাধার নির্মাণ করা যেতে পারে। পুরো ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অনেক পুকুর দেখেছি, সেগুলো যদি দখল হয়ে গিয়ে না থাকে তাহলে, সেই সব জলাধার সংস্কার ও সম্প্রসারণ করা যেতে পারে।

পানির অন্য নাম কেবল জীবনই নয়, ডেভেলপমেন্টের প্রধান সহায়ক উপাদানও বটে। আমরা সে কথা মনে রাখি না। উত্তর সিটির মেয়র আতিক সাহেব দেশের অনেক এনজিও বা সমাজকল্যাণের কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানকে গাছ রোপণের দায়িত্ব দিতে পারতেন। এবং জলাধার সৃজনের দায়িত্ব কোন অফিস পাবে? আমরা জানি না। তারা কি প্রাক্কলিত সময়ের মধ্যে জলাধার সৃজন ও খাল উদ্ধারের কাজ সম্পন্ন করতে পারবেন?

লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/এমএস

আমরা চাই ছায়া দেয় এমন বৃক্ষ। আমরা চাই ফলদ ও ঔষধি বৃক্ষ। আমরা চাই ছায়া দেবে পথিককে, গরমে প্রশান্তি দেবে এবং অক্সিজেন দেবে। মহানগরকে গরমের তাপদাহ থেকে অনেকটাই রক্ষা করবে। আমরা যে বৃক্ষশূন্য কংক্রিটের মহানগর গড়ে তুলেছি, সেই নির্মম পরিবেশ থেকে এখানকার বসতিদের রক্ষার আয়োজন হোক।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।