মধ্যপ্রাচ্যের বদলে যাওয়া রাজনীতি এবং আমাদের প্রত্যাশা
ইউক্রেন যুদ্ধ শেষের আগেই বদলে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি। বদলে যাচ্ছে বিশ্ব দাদাগিরির আসন। ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে চমক দিয়েছে সৌদি আরব। শুধু ইরান নয়, সিরিয়ার সঙ্গেও কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ঘোষণা এসেছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বলয় থেকে বের হয়ে উপসাগরীয় প্রতিবেশীদের নিয়ে নতুন বলয় গড়ার চেষ্টা করছে সৌদি আরব। এক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে রয়েছে চীন ও রাশিয়ার মতো পরাশক্তি। সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের তালিকায় যোগ হয়েছে কাতার ও বাহরাইন। গত ১২ এপ্রিল কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে দেশ দুটি। আর এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে সৌদি আরব।
সৌদির নতুন বলয় গড়ার চেষ্টা ও চীন-রাশিয়ার মতো পরাশক্তির আগমনে মধ্যপ্রাচ্যে তাই ধীরে ধীরে কর্তৃত্ব হারাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বিবৃতিতে সৌদি- ইরান সম্পর্ককে স্বাগত জানালেও বিষয়টি যে তাদের জন্য সুখকর নয় সেটি দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। ২০১৮ সালে সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যা নিয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে চিড় ধরে। এরপর চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি ও ইরান সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে এগিয়ে আসায় মধ্যপ্রাচ্যে একরকম কোণঠাসাই হয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে প্রধান মিত্র ইসরায়েলের প্রভাব প্রতিপত্তিও কমে আসবে। এমনিতেই ইসরায়েল অভ্যন্তরীণ নানা ইস্যুতে চাপে রয়েছে। সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ক্রমেই জোরাল হচ্ছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে নতুন সমীকরণ দানা বাঁধছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আপাতদৃষ্টিতে সবচেয়ে স্বস্তির বিষয়টি হলো, নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ায় রক্তপাত কমার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে এই ঐক্যপ্রচেষ্টা ইয়েমেন ও সিরিয়ায় যুদ্ধ বন্ধে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তার নিয়ে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধ। ২০১৬ সালে ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে সৌদি আরব। আঞ্চলিক নানা ইস্যুতে দেশ দুটির মধ্যে দ্বন্দ্ব সবার জানা। সৌদি-ইরানের বৈরিতা অবসানে দূতিয়ালী করেছে চীন। বেইজিংয়ে গত ১০ মার্চ বৈঠকের পর সৌদি-ইরান পুনরায় দূতাবাস চালুর বিষয়ে একমত হয়। এটি নিঃসন্দেহে চীনের কূটনৈতিক বিজয়।
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে চীন একধাপ এগিয়ে। একদিকে তারা মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে খর্ব করতে পেরেছে, অন্যদিকে এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে বাণিজ্য সম্প্রসারণের পরিকল্পনা শুরু হয়েছে। একটি পরিসংখ্যানেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে ১৯৯০ সালে সৌদি আরবের সঙ্গে চীনের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৪১৭ মিলিয়ন ডলার, ২০২০ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৬৫ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে। সে হিসাবে ২০২০ সালে সৌদিতে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি বাণিজ্য করেছে চীন।
এদিকে সৌদি আরব চীনা নেতৃত্বাধীন নিরাপত্তা জোট সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনে যোগ দিতে সম্মত হয়েছে। এটি চীনের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক আরও নিবিড় করার বড় ইঙ্গিত। পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিযোগী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সংগঠন হিসেবে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০১ সালে। চীন ছাড়াও এ সংগঠনে রয়েছে ভারত, পাকিস্তান, রাশিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তান।
এক দশক ধরে আমরা মিডিয়ায় নিয়মিত সংবাদ পেয়ে আসছি, মধ্যপ্রাচ্যের রক্তক্ষয়। এমন একটা দিন নেই যেদিন ইয়েমেন কিংবা সিরিয়ায় মানুষ নিহত আহত হয়নি। এক দশকে লাখো মানুষের মৃত্যু হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ গৃহহারা দেশ ছাড়া হয়েছে। এসবের অবসান হতে চলেছে, এটা আমাদের জন্য স্বস্তির খবর।
চলতি বছরের মার্চে ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ঘোষণা আসার কিছুদিন পরই সিরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের বিষয়টি সামনে আসে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ মস্কো সফর করেন। সে সময় সৌদি-সিরিয়া সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে মধ্যস্থতা করে রাশিয়া। গত ১২ এপ্রিল সৌদি আরব ও সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক হয়। বৈঠকে সিরিয়াকে আরব ছাতার নিচে ফিরে আসায় সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছে সৌদি আরব। সিরিয়ার সঙ্গে সৌদির কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের পদক্ষেপকে অবশ্য ভালো চোখে দেখছে না যুক্তরাষ্ট্র।
প্রায় ১১ বছর ধরে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদবিরোধী বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে ২০১১ সালে এই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এক দশকের বেশি সময় ধরে চলা এই গৃহযুদ্ধে এখন পর্যন্ত অন্তত ৩ লাখ ৮০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে অন্তত ৬০ লাখ। সেই গৃহযুদ্ধ বন্ধের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
গৃহযুদ্ধের শুরুতে সৌদি আরব, কাতার, যুক্তরাষ্ট্র ও তার বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক মিত্র সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে সমর্থন দেয়। প্রেসিডেন্ট আসাদ অবশ্য ইরান ও রাশিয়ার সহায়তা নিয়ে বেশির ভাগ বিদ্রোহী গ্রুপকে পরাস্ত করেছেন। সৌদি-সিরিয়া সম্পর্ক নতুন মাত্রা পাওয়ায় এবার দেশটিতে সংঘাত থামবে বলে আশা প্রকাশ করা হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, আগামী ১৯ মে আরব লিগের শীর্ষ সম্মেলন, যেটা অনুষ্ঠিত হবে সৌদি আরবে, আসাদকে সেই সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানোর পরিকল্পনা করছে সৌদি আরব। এ পদক্ষেপ আনুষ্ঠানিকভাবে সিরিয়ার আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটাবে।
ইয়েমেনের দিকেও মীমাংসার হাত বাড়িয়েছে সৌদি আরব। স্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছানোর লক্ষ্যে তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। হুতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনা করছে। এমনকি হুতিদের সঙ্গে আলোচনা করতে সৌদি আরবের একটি দল রাজধানী সানায় গিয়েছিল গত সপ্তাহে। ২০১৫ সাল থেকে ইয়েমেন সরকারকে হটিয়ে রাজধানী সানার নিয়ন্ত্রণ নেয় হুতি বিদ্রোহীরা। এরপর থেকেই হুতিদের সঙ্গে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের যুদ্ধ শুরু হয়। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের পক্ষ নিয়ে হুতিদের বিরুদ্ধে হামলা শুরু করে সৌদি আরব।
এদিকে হুতিদের আশ্রয় দিয়ে আসছিল ইরান। সৌদি-ইরান সম্পর্ক নতুন মোড় পাওয়ায় এখন যুদ্ধ থামার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এরই মধ্যে উভয়পক্ষে প্রায় ৯০০ বন্দি বিনিময় করেছে, এসময় তাদের বিমানগুলো ইয়েমেন ও সৌদি আরবের ছয়টি শহরের মধ্যে মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দিদের নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
আমরা শান্তিপ্রিয় বাংলাদেশিরা বিশ্বের কোথাও রক্তক্ষয় দেখতে চাই না। ইয়েমেন আর সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ বন্ধ হলেই বদলে যাবে মধ্যপ্রাচ্য। বদলে যাবে বিশ্ব রাজনীতির দাদাগিরির আসন। শান্তিপ্রিয় বিশ্ববাসী সেই দিনটির অপেক্ষায়।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম