চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও মহান মে দিবসের শিক্ষা

নাসরীন মুস্তাফা
নাসরীন মুস্তাফা নাসরীন মুস্তাফা
প্রকাশিত: ১০:৩৭ এএম, ০১ মে ২০২৩

মনে পড়ে, মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের এক মিশনে চাকরি করতে গিয়ে দেখা পেয়েছিলাম বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া এক তরুণের। সেবা নিতে আসা তরুণটি কথা বলতে ভুলে গেছেন। ধু ধু মরুভূমিতে উট চরানোর কাজ তার। মাসে একবার খাবার আর পানি দিয়ে আসা হয়। একা একা উটের সাথে থাকতে থাকতে মানুষের ভাষা ভুলে গেছেন মানুষটা।

এক আরব শেখের বাগানবাড়িতে দেখা পেয়েছিলাম এক বৃদ্ধের। বাংলাদেশের সবুজ মাটিতে জন্ম নেওয়া মানুষটা তারুণ্যের সব দিন দিরহামে বেচে দিয়ে বয়সের শেষ সীমায় এসে একই রকমভাবে হারিয়ে ফেলেছেন মাতৃভাষার শব্দ। অনেক কষ্টে ইশারা মিশিয়ে যে কথা শোনালেন, তার অর্থ এরকম- কার সাথে কথা বলব? খেজুর গাছ, ছাগল আর উটদের সাথে কথা হয়? স্ত্রী মরে গেছেন বহুকাল হল, সন্তানদের লন্ডন-আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত করার পর ওদের সাথেও কথা কমতে কমতে কথারা হারিয়ে গেছে দীর্ঘশ্বাসে।

মহান মে দিবস আসলে কেবলই মনে পড়ে সেই তরুণ আর সেই বৃদ্ধের কথা। শ্রমিকের জীবনও যে মানুষেরই জীবন, এ কথা এদের বলে লাভ নেই। এরা বুঝবেন না। বুঝলেও পাল্টা প্রশ্ন রাখতে পারবেন না- যে জীবন তাদের, তার চেয়ে কি ফড়িং আর দোয়েলের জীবন লোভনীয় নয়?

মহান মে দিবস মানেই মে মাসের প্রথম দিন। মহান মে দিবস মানেই সারা বিশ্বে শ্রমের মূল্যায়ন ও মূল্যায়নে ন্যায়বিচারের আহ্বান। ১৮৮৬ সালের এই দিনে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা যে আহবান জানিয়েছিল, ১৩৭ বছর পরে এসেও শ্রমের মূল্যায়ন ও মূল্যায়নে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এ কথা বলার উপায় নেই। এখনো দৈনিক আট ঘন্টার বেশি শ্রম দিতে বাধ্য হন শ্রমিক, এখনো শ্রমের মূল্য নির্ধারণে নারী-পুরুষের বৈষম্য বজায় রেখে মুফতে ঠকানোর উৎসব চলে, সবার সব শ্রমের সমান মর্যাদা দেওয়া হয় না বলে ঘরের কাজ সামলানো নারীর শ্রমের মূল্য নির্ধারণের কথা বললে সমাজচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা আছে।

কাজী নজরুল ইসলামের ‘কুলি মজুর’ কবিতার মতো এখনো দধীচিদের হাড় দিয়ে বাষ্প-শকট চলে আর বাবু সা’বরা এসে তাতে চড়ে বসেন। শ্রমিকদের খুনে রাঙা অট্টালিকা, রাজপথের মোটর, সাগরের জাহাজ ইত্যাদির সত্যিকারের মানে আজও আমরা জানি না। কাতার বিশ্বকাপে হাজার হাজার শ্রমিক তীব্র গরমে নির্মাণ কাজ করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের মধ্যে এই বাংলাদেশের সন্তানরাও ছিলেন।

বিশ্বকাপের সময় তাদের নাম উৎকীর্ণ করা ফলক দেখে তৃপ্ত হয়েছেন সকলে, অথচ শ্রম আইন লঙ্ঘন করে অমানবিকভাবে তাদেরকে কাজ করানো হয়েছিল, জাতীয়তা দেখে বৈষম্য করা হয়েছে তাদের সাথে, ঠিকমতো বেতন পেতেন না, অতিরিক্ত সময়ে দেওয়া শ্রমের জন্য যথাযথভাবে অর্থ পাননি, ঠিকভাবে খেতে পাননি, চিকিৎসা হয়নি এবং এসব নিয়ে যেটুকু কথা হয়েছিল, তা বিশ্বকাপের উৎসবে নৃত্যরত নোরা ফাতেহির উপর পড়া স্পটলাইটের তুলনায় ছিল নিতান্তই জোনাকির আলো।

নিজের ভাগ ষোল আনা বুঝে নেওয়া পুঁজিবাদী বিশ্বে মহান মে দিবস পালন করা তাই এখনো জরুরি। মানুষের শ্রমের মূল্য এখনো ঠকবাজদের চালাকির খপ্পরে পড়ে কেতাবে আছে গোয়ালে নাই। অথচ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের (ডিজিটাল প্রযুক্তি) সাথে তাল মিলিয়ে খুব দ্রুত পঞ্চম শিল্প বিপ্লবে (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তি) শামিল না হলে পিছিয়ে পড়তে হবে বলে চাপা দুঃশ্চিন্তায় ছুটছি আমরা। মহান মে দিবস এরকম প্রেক্ষাপটে আরও নতুন নতুন আলোচনার খোরাক নিয়ে হাজির। প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষ কি মানুষকে শ্রমের বাজারে মূল্যহীন করে দেবে? দরকার নেই এরকম বিপ্লবের, এ কথা বলারও কিন্তু জো নেই বিশ্ব নামক গ্রামে। তাহলে, কী উপায় হবে শ্রমিকের?

সব শিল্প বিপ্লবের বাবা কিন্তু দশ হাজার বছর আগে মানুষের হাতে শুরু হওয়া কৃষি বিপ্লব। যখন মানুষ বন্য প্রাণীকে পোষা প্রাণীতে পরিণত করতে শিখল, প্রাণীকে ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন, পণ্য পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটালো, তখন থেকে শুরু হ’ল কৃষি বিপ্লব। এরপর জেমস ওয়াট বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার করলে শুরু হ’ল প্রথম শিল্প বিপ্লব। ১৭৬০ সাল থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত চলমান এই বিপ্লববের ধারাবাহিকতায় এল দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব, যার সূত্রপাত ঘটিয়েছিল বিদ্যুৎ।

বিদ্যুতের গণউৎপাদন শুরু হ’ল, এসেম্বলি লাইন বসল এবং বিদ্যুৎনির্ভর প্রযুক্তির ব্যাপকতা ছড়িয়ে পড়ায় মানুষের জীবনের মানেই গেল বদলে। ষাটের দশকে সেমি কন্ডাক্টর আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়। এরপর এসে গেল চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগ, যার সাক্ষী হতে পেরেছি আমরা। ডিজিটাল সংযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির সাথে রোবোটিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ন্যানো টেকনোলজি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, বায়ো টেকনোলজি, ফাইভজি, থ্রিডি মুদ্রণ, সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় যানবাহন প্রযুক্তিকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপকরণ হিসেবে কে কত আগে বাজারে হাজির করতে পারে, তার যুদ্ধ দেখেছি এবং এসবের ভোক্তাও বনে গেছি।

মানুষের শ্রমের বিনিময়ে কৃষি বিপ্লব থেকে এই যে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলভোগী হলাম, প্রযুক্তির মাঝে আত্মা ডুবিয়ে দেওয়া এই আমরাই এখন পড়ে গেছি বিশাল এক প্রশ্নের সামনে। আগামীর বিপ্লবে মানুষহীন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যে জগত তৈরি করতে যাচ্ছে মানুষ, (যার প্রকাশ ইতোমধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি) তা কি মানুষকে শ্রমহীন করে দেবে?

কৃষিতে শ্রম দিতে অভ্যস্ত বাংলাদেশের মানুষরা প্রযুক্তির জোয়ারে ভাসছে, যদিও এখনো আমাদের ভূমিকা মূলতঃ ভোক্তার। আমরা বাস করছি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মাঝে। এর হাল ধরতে শিখে উঠিনি এখনো, এখনো পুরো জনগোষ্ঠী বুঝে উঠতে পারেনি কেনো কৃষিনির্ভর শ্রমিকের হাতকে প্রযুক্তিশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে।

শুরুতে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এর ধারণা যখন দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, অনেকেই হাসিঠাট্টায় উড়িয়ে দিয়েছে এভাবে- কম্পিউটারে টাইপিং শিখতে পারব বড়জোর, এর বেশি আর কী হবে? চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সম্বন্ধে আমাদের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব ওয়াকিবহাল ছিলেন, এটাই সুখবর। একারণে নানান নীতি গ্রহণ করে সেই বাংলাদেশই হয়ে উঠেছে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে তরুণদের বেকারত্ব দূর করার পাশাপাশি বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী দেশ।

চতুর্থ বা পঞ্চম শিল্প বিপ্লবে মানুষের শ্রমের হাতকে নিষ্ক্রিয় করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর সমাজ গেলানোর একটি বিশাল চক্রান্ত আছে শিল্পোন্নত দেশগুলোর। মানুষের অভাবে বর্তমান শিল্প বিপ্লবের নেতৃত্ব যুৎসইভাবে দিতে পারছে না এবং বিপুল সংখ্যক মেধাবী তরুণের শ্রমনির্ভর বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর হাতে নেতৃত্ব চলে যায় কি না এই আতঙ্কে বিশেষ রকমের শিল্প বিপ্লবের নকশা আঁকা হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলি, পোষাকশিল্পে বাংলাদেশের প্রাধান্য বিস্তারের কথা।

শিল্পোন্নত দেশগুলোকে বাধ্য হয়েই নির্ভর করতে হচ্ছে জরিনা-আব্বাসদের হাতে তৈরি পোশাকের উপর। সমালোচকরা বলবেন, সস্তা শ্রমের কথা। মেধাশ্রমের কথাটাও ভাবতে হবে। বাংলাদেশের পোষাকের গুণগত মান কেবলমাত্র কায়িক শ্রমে গড়ে ওঠেনি, মেধাশ্রমেরও বিশাল ভূমিকা আছে। যাদের দেশে মানুষই নেই, তারা মেধাশ্রমই বা কোথায় পায়? মানুষ ছাড়া মেধার বিকাশ ঘটে না, বোদ্ধাদের জানা থাকা উচিত। সাদা চামড়ার বোদ্ধারা কিন্তু জানে, আর তাই মানুষের ঘাটতি মেটাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করে বাকিদের উপর টেক্কা দিতে চায়।

আমাদের শীর্ষ নেতৃত্ব এবিষয়ে ওয়াকিবহাল আছেন, তা একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় এবং এতে স্বস্তি মেলে। আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ কিছুতেই মানুষের শ্রমকে অবমূল্যায়ন করে কেবলমাত্র কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যথেচ্ছ ব্যবহারকে সমর্থন করে না বলে তথাকথিত ধরণের চতুর্থ বা পঞ্চম শিল্প বিপ্লবের মতো নয়। তাতে মানুষের শ্রমের মূল্যায়ন এবং মূল্যায়নের ন্যায়বিচারের কোনো ঝামেলা নেই।

মানুষবিহীন গাড়ির দরকার নেই আমাদের। কেয়ার গিভার রোবট চাই না আমরা। প্রযুক্তিশিক্ষায় শিক্ষিত জনশক্তি চাই, যারা পোশাকশিল্পের মতোই বাংলাদেশের প্রাধান্য গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশে দক্ষশ্রমিকের কর্মসংস্থান গড়ে তুলে উদ্ভাবন ও উৎপাদনশীলতায় সারা বিশ্বকে অবাক করে দিতে হবে, দূর করতে হবে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য, গড়ে উঠতে হবে নতুন ধরনের ব্যবসা, দুর্নীতিমুক্ত গতিশীল প্রশাসন যোগ্য হয়ে উঠবে নেতৃত্ব দানে।

মানুষের শ্রমকে বাদ দেওয়ার প্রশ্নই যদি না ওঠে, শ্রমের মূল্যায়ন ও মূল্যায়নে ন্যায়বিচারের চ্যালেঞ্জ কিন্তু থেকেই যায়। যারা মানুষকে বাদ দিয়ে বিপ্লবের কথা ভাবছে, তারাই কিন্তু মানুষকে দাস বানানোর কু-ইতিহাস গড়ে তুলেছিল। বলে রাখি, আমেরিকা মে মাসের প্রথম দিনটাকে এখনো সচেতনভাবে এড়িয়ে শ্রম দিবস পালন করে সেপ্টেম্বর মাসে। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড হে মার্কেটের হত্যাকাণ্ডের পর মে মাসের প্রথম দিনে দিবসটি পালনের সাহস পাননি। এখনো সেই সাহস আমেরিকার হয়নি।

বাংলাদেশের ইতিহাস অন্য রকম। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎও অন্য রকমের হতে হবে। কাজেই, নতুন যে পৃথিবী গড়ে উঠছে, তাতে বাংলাদেশ স্বমহিমায় যে বিপ্লব ঘটাতে চাইছে, তাতে মহান মে দিবসের শিক্ষা অন্য রকমের তাৎপর্য বহন করে নিশ্চয়ই।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার।

এইচআর/জিকেএস

যারা মানুষকে বাদ দিয়ে বিপ্লবের কথা ভাবছে, তারাই কিন্তু মানুষকে দাস বানানোর কু-ইতিহাস গড়ে তুলেছিল। বলে রাখি, আমেরিকা মে মাসের প্রথম দিনটাকে এখনো সচেতনভাবে এড়িয়ে শ্রম দিবস পালন করে সেপ্টেম্বর মাসে। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড হে মার্কেটের হত্যাকাণ্ডের পর মে মাসের প্রথম দিনে দিবসটি পালনের সাহস পাননি। এখনো সেই সাহস আমেরিকার হয়নি। বাংলাদেশের ইতিহাস অন্য রকম। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎও অন্য রকমের হতে হবে।

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।