শ্রমিক অধিকার রক্ষায় সংকল্পবদ্ধ হতে হবে

ইয়াসমিন আরা
ইয়াসমিন আরা ইয়াসমিন আরা , শিক্ষক
প্রকাশিত: ১০:২৫ এএম, ০১ মে ২০২৩

করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অস্থির সময়ে এবার মে দিবস পালন করছি আমরা। জ্বালানি সংকটের কারণে সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে। উচ্চ দ্রব্যমূল্য, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের মূল্যও অস্বাভাবিক। এ অবস্থায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। কিন্তু সে তুলনায় বাড়েনি মানুষের আয়। বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষ রয়েছে নিদারুণ দুর্দশায়। এরকম বৈরি একটি অর্থনৈতিক অবস্থায় সাধারণ মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। সে কারণেই এবারের মে দিবস আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।

মে দিবস হলো পৃথিবীর মেহনতি মানুষের সংগ্রামের দিন, নতুন করে সংকল্প গ্রহণের দিন। সামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শ্রেণিবৈষম্যের পুঁজিবাদের দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য শ্রমিকদের এক দৃঢ় অঙ্গীকারের দিন। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলোতে অধিক মুনাফা লাভের আশায় শ্রমিকদের অমানুষিকভাবে খাটানো হতো।

সময়ের কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম ছিল না। কখনো ১৪ ঘণ্টা বা ১৬ ঘণ্টা বা ১৮ ঘণ্টা শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো হতো। এর সাথে ছিল মজুরি বৈষম্য ও মজুরি সংকোচন। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই বৈষম্য ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই শ্রমিকরা মুখর হতে থাকে। ১৮৬৬ সালে উইলিয়াম সিলভিসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় হয় দ্য ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন। প্রতিষ্ঠার দিন থেকেই শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের জোরালো দাবি ওঠে।

১৮৬৮ সালে আমেরিকার আইনসভায় এ সংক্রান্ত আইন পাস হলেও বাস্তবে এর প্রতিফলন দেখা যায়নি। ফেডারেশন অব অর্গানাইজড ট্রেডস অ্যান্ড লেবার ইউনিয়নস দৃঢ়ভাবে দাবি করে যে ১৮৮৬ সালের ১ মে থেকে শ্রমিকরা আর ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করবে না। অতঃপর এই দিন আমেরিকার শিকাগো শহরে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে ৫ লাখেরও বেশি শ্রমিক ধর্মঘটে যোগ দেয়। ধর্মঘটের প্রথম দুই দিন ১ মে ও ২ মে শান্তিপূর্ণভাবে শ্রমিকরা ধর্মঘট পালন করে।

৩ মে ম্যাকরনি হারভেস্টার নামে করাখানার সামনে এক মালিকের উপর অজ্ঞাত নামার বোমা নিক্ষেপের পর শ্রমিকদের উপর নেমে আসে পুলিশদের বর্বর অত্যাচার। পুলিশের নির্বিচারে গুলিবর্ষণের ফলে শ্রমিকদের ৬ জন সেই দিন নিহত হন। ৪ মে শিকাগো শহরের হে মার্কেট স্কয়ারে জমা হয় হাজার হাজার শ্রমিকদের দল। পুলিশ আবারও গুলিবর্ষণ করায় অনেক শ্রমিকের রক্তে রঞ্জিত হয় হে মার্কেট স্কয়ারের রাস্তা। পুলিশের বিরুদ্ধে আক্রমণের অজুহাতে গ্রেফতার হয় অ্যালবার্ট পারসন, অগাস্ট স্পাইস, অ্যাডলফ ফিশ্চার, জর্জ অ্যাঙ্গেল নামে চার শ্রমিক নেতা। দেড় বছর ধরে বিচারের নামে প্রহসন হতে থাকে।

অবশেষে ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর ফাঁসি দেওয়া হয় সেই চার শ্রমিক নেতাদের। এর প্রতিবাদে শুরু হয় শ্রমিকদের সভা সমাবেশ ধর্মঘট। দেশের গন্ডি পেরিয়ে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে শ্রমজীবী মানুষের কাছে এই বর্বতার খবর। ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সের প্যারিসে ২য় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনের প্রথম দিন প্রস্তাব পাশ হয় ১৮৯০ সালের ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হবে।

পরবর্তীকালে ১৮৯০ সালে আমেরিকা, ফ্রান্স এবং গ্রেট ব্রিটেনে মে দিবস পালিত হয়। রাশিয়াতে প্রথমবারের মতো ১৮৯৬ সালে মে দিবস পালিত হয়। এরপর চীনে প্রথমবারের মতো মে দিবস পালিত হয় ১৯২৪ সালে । জার্মানিতে মে দিবস পালিত হয় ১৯৩৩ সাল থেকে। ভারতবর্ষে সিংগারা বেলুচেট্রিয়ার সভাপতিত্বে ১৯২৩ সালের ১ মে প্রথম মে দিবস পালিত হয়।

শ্রমিক আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাস ও সংগ্রামের প্রতি সংহতি স্বরূপ আজ পৃথিবীর প্রতিটি দেশে মে দিবস উদযাপিত হয়ে আসছে। মে দিবস আজ দুনিয়ার মেহনতি মানুষের সংগ্রামের দিন, সৌভাতৃত্বের দিন।

আজও শ্রমিক শ্রেণির এক বৃহৎ অংশ পুঁজিবাদের দাসত্ব থেকে মুক্তি পায়নি। যাতের হাত ধরে এই বিশাল অট্টালিকা, কারখানা, বিশাল স্থাপনা গড়ে ওঠে তারাই আজ বঞ্চিত। তাদের ঘরে নেই খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা কিংবা শিক্ষার মতো বেঁচে থাকার নিরাপদ স্থান। শোষণ আর বঞ্চনা নিয়ে শ্রমিকদের বেঁচে থাকার দিন বদল হবে যদি মালিক ও সরকারের সমন্বয়ে একটা শ্রেণি বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তুলতে পারি।

আসুন আমরা সবাই শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার রক্ষার জন্য সংকল্পবদ্ধ হই।

লেখক: শিক্ষক।

এইচআর/জিকেএস

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।