জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

শহীদ শেখ জামাল আজও স্মরণীয়

ড. মিল্টন বিশ্বাস
ড. মিল্টন বিশ্বাস ড. মিল্টন বিশ্বাস , অধ্যাপক, কলামিস্ট
প্রকাশিত: ১০:২২ এএম, ২৮ এপ্রিল ২০২৩

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদরের মেঝো ছেলে শেখ জামালের জন্মদিন আজ ২৮ এপ্রিল। বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’য় শেখ জামালের কথা এসেছে নানা প্রসঙ্গে।

যেমন ১৯৬৬ সালের ৯ই জুন বন্দি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বেগম মুজিব শেখ জামালসহ অন্য সন্তানদের নিয়ে সাক্ষাৎ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন-‘...জামালের জ্বর, দূরেই বসেছিল, কাছে ডেকে আনলাম। বড়মেয়ে, বড় ছেলে, খোকা, আমার স্ত্রী একে অন্যের দিকে চাইছে, কি যেন বলতে চায় বলতে পারছে না। আমি বললাম এত তাড়াতাড়ি দেখা করার অনুমতি দিল-ব্যাপার কি? আমার স্ত্রী আস্তে আস্তে বলল যে, “টেলিগ্রাম এসেছে মার শরীর খুব খারাপ। বুঝতে আর বাকি রইল না, মার শরীর বেশি খারাপ না হলে আমার আব্বা কোনোদিন টেলিগ্রাম করতেন না। তিনি খুব বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান লোক। মনটা আমার খুবই খারাপ হয়ে পড়ল। ছেলে-মেয়েদের বুঝতে দিলাম না যে আমি খুব মুষড়ে পড়েছি।’

১৯৬৬ সালের ১৫ই জুন পুনরায় সাক্ষাতের সময় তিনি লক্ষ করেছেন-‘জামালের শরীর খারাপ, গলা ফুলে রয়েছে। এ বড় খারাপ ব্যারাম। রেণুকে তাই বললাম, ডাক্তার দেখাইও। স্কুলে যেতে পারবে না। এছাড়াও আরো অনেক কথা হলো।’ বঙ্গবন্ধু জেলে বন্দি থেকেও সন্তানদের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারতেন তাদের কষ্টের কথা; উপলব্ধি করতেন জেলের বাইরের জীবনও চ্যালেঞ্জিং।

জাতির পিতার এই দ্বিতীয় পুত্রের ৭০তম জন্মদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনন্য নেতৃত্বের বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মুক্ত, মুজিববর্ষ অতিক্রান্ত ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী শেষে গৌরবের সঙ্গে আমরা উদযাপন করছি। একজন মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন গর্বিত সন্তানকে আমরা স্মরণ করতে পারছি সুন্দর বিশ্বে। ১৯৫৪ সালের এইদিনে তিনি টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। শেখ হাসিনার প্রবন্ধ পড়ে জানা যায় মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে গৃহবন্দী ছিলেন। কিন্তু তিনি পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে সক্ষম হন এবং বিজয়ের পর সগৌরবে ফিরে আসেন নিজ গৃহে।

১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ২ এপ্রিল মন্ত্রিসভা গঠন করে এবং ১৪ মে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। দুর্ভাগ্য হলো ৩০ মে তিনি পুনরায় গ্রেফতার হন। সাধারণ মানুষকে শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তির আলোয় আনতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। পরিবার-সন্তানাদি এবং আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে একজন রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে দিনের পর দিন কারাগারে কাটানো যে কষ্টের তা ভুক্তভোগী মুজিব উপলব্ধি করেছেন তিলতিল করে- ‘রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা আর তার আত্মীয়-স্বজন ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা কত যে জঘন্য কাজ তা কে বুঝবে? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়।’

ঠিক এরকম অনেক দিন গেছে যখন শিশু শেখ জামালকে নিয়ে বঙ্গমাতা তাঁর দুঃসময় অতিবাহিত করেছেন। তবে এর পরই সকলে মিলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। শেখ জামাল ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ থেকে ম্যাট্রিক ও ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। পরিবারের সাংস্কৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা শেখ জামাল গিটার শেখার জন্য একটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছিলেন এবং একজন ভাল ক্রিকেটার ছিলেন।

বঙ্গবন্ধুকে অধিকাংশ সময় জেলে থাকতে হয়েছিল বলে বঙ্গমাতা এবং বড় বোন শেখ হাসিনা শেখ জামালকে ছোটবেলা থেকে দিকনির্দেশনা দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের নিজেদের বাড়িতে অবস্থান করেই তাঁর রাজনৈতিক চেতনা গড়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধু ৩২ নম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে গ্রেফতার হবার আগেই পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে আত্মগোপন করেন শেখ জামাল।

পরবর্তীতে পাকিস্তানিদের হাতে সকলে গ্রেফতার হলে ধানমন্ডি ১৮ নম্বর রোডের বাড়িতে গৃহবন্দি অবস্থায় ছিলেন। সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। যুদ্ধের ময়দানে কিংবা পালানোর সময় পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়লে তাঁর মৃত্যু ছিল অনিবার্য। কিন্তু তিনি ছিলেন পিতার মতো নির্ভীক ও দেশপ্রেমের মূর্ত প্রতীক। তিনি পাকিস্তানি পাহারাদারদের চোখে ফাঁকি দিয়ে ৫ আগস্ট পলায়ন করে ভারতের আগরতলা চলে যান। সেখান থেকে কলকাতা হয়ে পৌঁছান উত্তর প্রদেশের কালশীতে।

মুজিব বাহিনীর ৮০ জন নির্বাচিত তরুণের সঙ্গে ২১ দিনের বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি ছিলেন ৯ নম্বর সেক্টরের যোদ্ধা। রাইফেল কাঁধে অসীম সাহসের সঙ্গে পাকিস্তানি শত্রুর মোকাবেলা করে দেশকে মুক্ত করেন তিনি।

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৮ ডিসেম্বর ফিরে আসেন বঙ্গমাতা ও শেখ হাসিনাসহ ভাইবোনদের কাছে। উদ্বেগ উৎকণ্ঠা দূর হয়। ওই দিন বিকেলে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনসভায়ও যোগ দেন তিনি। তারপর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে পিতার কাছে সামরিক পোশাকেই অন্য দুই ভাই শেখ কামাল ও শেখ রাসেলসহ উপস্থিত ছিলেন তিনি।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পূর্ণাঙ্গরূপে গঠিত হলে শেখ জামাল সেনাবাহিনীর লং কোর্স-এর প্রথম ব্যাচের কমিশন্ড অফিসার হন। লন্ডনে লেখাপড়ার পরে তিনি লেফটেন্যান্ট হন। জনৈক গবেষক লিখেছেন- ‘শেখ জামাল পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মা বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের আশীর্বাদ নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে। পেশাগত দক্ষতা ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ করে রেখেছিলেন সেখানে সবাইকে। সৈনিক থেকে সিনিয়র অফিসার, সবারই হয়ে উঠেছিলেন নয়নমণি।

কাজের প্রতি একনিষ্ঠতা আর অহংকারহীন জীবনযাপনে সবাইকে আপন করে নিতে তার তুলনা মেলানো প্রায় অসম্ভব। আর সেই কারণেই তিনি তার পরিচিতদের কাছে হয়ে আছেন ইতিহাসের উজ্জ্বল অংশ।’ তিনি যুক্তরাজ্যের রয়েল মিলিটারি একাডেমি স্যান্ডহার্স-এ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সেখান থেকে কমিশন লাভ করে পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মকুশলতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার রাষ্ট্রনায়ক মার্শাল টিটোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ হয় ১৯৭৩ সালে ন্যাম সম্মেলনে যোগ দেবার সময়। সেই সূত্রে তিনি যুগোশ্লাভিয়ায় শেখ জামালকে পাঠিয়েছিলেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যখন হত্যার শিকার হন তখন শেখ জামালের পরিচয় দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে গেছে। তিনি নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন সেই সেনাবাহিনীরই একটি অংশের হাতে যারা মনে-প্রাণে পাকিস্তানি ও আমেরিকার মদদপুষ্ট গোষ্ঠী ছিল। এই মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারের রক্তপাত যে সেনাবাহিনীর সদস্যরা করেছিল, তাদের সেনা আইনে বিচার করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন সেসময়ের সেনাপ্রধান।

শহীদ শেখ জামাল শুয়ে আছেন বনানী কবরস্থানে, তার পাশেই আছেন স্ত্রী রোজী জামাল। যিনি ওই রাতেই শহীদ হয়েছিলেন সকলের সঙ্গে। তাদের বিয়ে হয়েছিল আগের মাসে ১৭ জুলাই। ঘাতকের বুলেট তাঁদের স্মৃতিকে বিলোপ করতে পারেনি বরং মৃত্যু অমর করেছে তাঁদের অবদানকে। ৭০তম জন্মবার্ষিকীতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শহীদ শেখ জামালকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন গর্বিত সন্তান হিসেবে স্মরণ করা হচ্ছে।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম এবং অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

এইচআর/জেআইএম

শহীদ শেখ জামাল শুয়ে আছেন বনানী কবরস্থানে, তার পাশেই আছেন স্ত্রী রোজী জামাল। যিনি ওই রাতেই শহীদ হয়েছিলেন সকলের সঙ্গে। তাদের বিয়ে হয়েছিল আগের মাসে ১৭ জুলাই। ঘাতকের বুলেট তাঁদের স্মৃতিকে বিলোপ করতে পারেনি বরং মৃত্যু অমর করেছে তাঁদের অবদানকে। ৭০তম জন্মবার্ষিকীতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শহীদ শেখ জামালকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন গর্বিত সন্তান হিসেবে স্মরণ করা হচ্ছে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।