গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্স ২০২৩

সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় বাংলাদেশ এখন রোল মডেল

কামাল উদ্দিন মজুমদার
কামাল উদ্দিন মজুমদার কামাল উদ্দিন মজুমদার , গবেষক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৯:৪৮ এএম, ২৭ এপ্রিল ২০২৩

সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বর্তমান আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পূর্বে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বিশ্বের নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে সন্ত্রাসী ও জঙ্গী সংগঠনগুলো সারা বিশ্বে তাদের জাল বিস্তার করেছে। ফলে সন্ত্রাসবাদ বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিক এবং আন্তঃমহাদেশীয় রূপ নিয়েছে।

বাংলাদেশ বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ সূচকে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ১৩ ধাপ, ভারতের চেয়ে ৩০ ধাপ এবং পাকিস্তানের চেয়ে ৩৭ ভাগ এগিয়ে আছে। প্রতিবেদন অনুসারে, পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মার্কিন যুক্তরাজ্যের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান অনেক ভালো।

একটি দেশের বার্ষিক সন্ত্রাসী ঘটনা, জিম্মি ও হতাহতের সংখ্যা বিশ্লেষণ করে এই সূচক তৈরি করা হয়। ১০ এপ্রিল, ২০২৩-এ প্রকাশিত অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা দ্য ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড পিস-এর বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ দমন সূচকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বিষয়টি, যা বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই গৌরবের।

ইন্সটিটিউট ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড পিস-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে বাংলাদেশ ৪০তম এবং ২০১৬ সালে ২২তম স্থানে ছিল। ২০১৬ সাল থেকে, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলাদেশ ক্রমাগত উন্নতি করছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলো বরাবরই বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে ছিল। এ কারণে প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের জন্য খুবই ইতিবাচক।

শেখ হাসিনার সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পরিকল্পনা করে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে যার মধ্যে সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রণয়ন এবং প্রাসঙ্গিক আইন সংশোধন করা অন্তর্ভুক্ত।২০০৯-২০১৩ সালে, ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ পুরোহিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মানবাধিকার কর্মী, ভিন্নমতের ইসলামী মতাদর্শের অনুসারী, আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা এবং বিদেশিদের উপর ধারাবাহিক আক্রমণ দেশে শেখ হাসিনার সরকারের জঙ্গিবাদ বিরোধী কার্যক্রমকে চ্যালেঞ্জে ফেলেছিল।

নিঃসন্দেহে, ঢাকার হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে বড় ধাক্কা দিয়েছে। অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশে তাদের অফিস বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং হামলার পর বিপুল সংখ্যক বিদেশী দেশ ছেড়ে চলে গেছে, যা বৈদেশিক সম্পর্ক বজায় রাখা এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের গতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে সরকারের কাছে একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। পরবর্তীতে সরকার বিষয়টিকে এতটাই কার্যকরভাবে পরিচালনা করেছে যে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের কাছে রোল মডেল হয়ে উঠেছে।

বিভিন্ন পদক্ষেপ বাংলাদেশকে সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আস্থা পুনরুদ্ধারে সহায়তা করেছিল, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি ঢাকায় তাদের অফিস বন্ধ করার সিদ্ধান্ত বাদ দেয়, ঢাকা ছেড়ে যাওয়া বিদেশীরা ফিরে এসেছিল। বর্তমানে বিপুল সংখ্যক বিদেশী দেশে কর্মরত এবং নির্ভয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করছেন।

জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির কারণে বাংলাদেশ উপকৃত হয়েছে। এখন পর্যন্ত, জেএমবি, শাহাদাত-ই-আল-হিকমা, জেএমজেবি, হিজবুত তাহরির, হুজি-বি, এবিটি, আনসার আল ইসলাম এবং আল্লাহ দল নামে আটটি জঙ্গি সংগঠনকে বাংলাদেশ সরকার নিষিদ্ধ করেছে। শেখ হাসিনার কঠোর অবস্থানের ফলে বাংলাদেশে জঙ্গি নেটওয়ার্ক ধ্বংস করা সম্ভব হয়েছে।

রাষ্ট্রের নীতি, অসাম্প্রদায়িক আদর্শে বিশ্বাস এবং শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ, দক্ষ ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশ আজ সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ দমনে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সন্ত্রাসীদের দমনে সাফল্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। জার্মানির হেসে প্রদেশের সংসদ সদস্যরা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য শেখ হাসিনার সরকারের প্রশংসা করেছেন।

বিশ্ব সন্ত্রাসবিরোধী সংস্থা আয়োজিত সভায় বক্তারা বলেন, সন্ত্রাস দমনে শেখ হাসিনার সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি বিশ্ব শান্তির দৃষ্টান্ত। সন্ত্রাসী হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি দেশকে বাংলাদেশকে অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছে জাতিসংঘ।

দেশে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে নিরাপত্তা বাহিনী, বিশেষ করে এলিট ফোর্স র্যাব অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। এর বাইরেও মাদক ব্যবসা ও পাচার প্রতিরোধ, মানুষ-নারী-শিশু পাচার রোধ, অবৈধ ক্যাসিনো বা জুয়া বন্ধের জন্য বিভিন্ন ক্লাবে র্যাবের দুঃসাহসী অভিযান, ভেজাল খাদ্য ও ওষুধ বিরোধী অভিযান সর্বোপরি দুর্নীতি-অনিয়ম প্রতিরোধ এবং নির্মূলেও র্যাবের অবদান অনস্বীকার্য। সুন্দরবন ও উপকূলীয় অঞ্চলে জলদস্যু দমনেও র্যাবের ভূমিকা স্বীকার করতে হবে। সে অবস্থায় এ বাহিনীর কতিপয় সদস্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত নিষেধাজ্ঞা একেবারেই অনভিপ্রেত ও অগ্রহণযোগ্য।

সরকার শুধু জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য একটি বিশেষ ইউনিট হিসেবে সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিট (এটিইউ) গঠন করে। পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট, ডিএমপির কাউন্টার-টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম, সাইবার ক্রাইম, ইনভেস্টিগেশন সেন্টার এবং পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের ল-ফুল ইন্টারসেপশন ইউনিট জঙ্গিবাদ দমনে সরাসরি কাজ করছে। র্যাব, পুলিশ, এনটিএমসি এবং সাইবার টিম সকল প্রকার উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করতে একসঙ্গে কাজ করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইনে জঙ্গিদের তৎপরতা ঠেকাতেও সতর্ক রয়েছে এসব বাহিনী। এই প্রচেষ্টা বেশ কার্যকর।

বাংলাদেশের মানুষ ধার্মিক কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। তারা ধর্মান্ধ হলে ১৯৭১ সালে দেশকে পাকিস্তান থেকে মুক্ত করতে পারতো না। বাংলাদেশ একটি শান্তিপূর্ণ দেশ যেখানে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও জাতিগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় মানুষ রয়েছে। দেশের সংবিধান প্রত্যেক নাগরিকের স্বাধীনতা ও স্বাধীন পরিবেশে তার নিজস্ব ধর্মীয় বিধি-বিধান মেনে চলার অধিকার নিশ্চিত করেছে। এদেশে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, চাকমা, মারমা, সাঁওতালসহ বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মানুষ মিলেমিশে একত্রে বসবাস করে আসছে।

সন্ত্রাস দমন সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। একইভাবে জনগণের জঙ্গিবাদবিরোধী মানসিকতা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য জঙ্গিবাদ মোকাবেলাকে সহজ করে তোলে। জঙ্গিবাদ ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য রাজনৈতিক সংগঠন, নাগরিক সমাজ, শিক্ষক-ছাত্র সমাজ, অভিভাবক, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন এবং সর্বস্তরের জনগণের ঐক্যের নজির পৃথিবীতে আর নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বিত প্রচেষ্টার পাশাপাশি।

সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ পুরোপুরি নির্মূল করা না গেলেও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং জনগণের সচেতনতা ও দায়িত্ববোধের কারণে উগ্র চরমপন্থী জঙ্গিগোষ্ঠী বাংলাদেশে তাদের অবস্থান সুসংহত করতে পারেনি।

টেকসই গণতন্ত্র ও উন্নয়নের জন্য টেকসই শান্তি প্রয়োজন এবং টেকসই শান্তির জন্য টেকসই নিরাপত্তা প্রয়োজন। বাংলাদেশের সকল গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পেছনে রয়েছে দেশের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। হাসিনা সরকার সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমন করে নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তে পেরেছে বলেই বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম বিস্ময়।

বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদ দমন পরিস্থিতি দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা তো বটেই, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের চেয়েও ভালো অবস্থানে রয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবিল অনুযায়ী, ২০৩৫ সালে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহত্তম অর্থনীতি। অর্থনীতিতে এই অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে সন্ত্রাস ও জঙ্গিমুক্ত দেশ গড়তে হবে। তাই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে এবং প্রত্যেককে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।

এইচআর/এমএস

বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদ দমন পরিস্থিতি দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা তো বটেই, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের চেয়েও ভালো অবস্থানে রয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবিল অনুযায়ী, ২০৩৫ সালে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহত্তম অর্থনীতি। অর্থনীতিতে এই অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে সন্ত্রাস ও জঙ্গিমুক্ত দেশ গড়তে হবে। তাই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে এবং প্রত্যেককে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।