প্রভুত্বের অবসানে সরকারি নির্দেশনা জরুরি

ড. মো.শফিকুল ইসলাম
ড. মো.শফিকুল ইসলাম ড. মো.শফিকুল ইসলাম , সাবেক সভাপতি-শিক্ষক সমিতি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত: ১০:৪৩ এএম, ২৩ এপ্রিল ২০২৩

রংপুরের জেলা প্রশাসককে ‘স্যার’ না ডাকায় অশোভন আচরণের শিকার হন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক। সেই বিতর্কের রেশ না কাটতেই আরও অনেক ক্ষেত্রে ‘স্যার’ সম্বোধন না করায় বিতর্ক সৃষ্টি হয়। যেমন কিশোরগঞ্জের এক সরকারি কর্মকর্তা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে অসম্মানিত করেন।

অতীতে দেখা গেছে ‘স্যার’ সম্বোধন না করায় চট্টগ্রামের এক সংগঠকের সঙ্গে পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দুর্ব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাবিনা ইয়াছমিনকে আপা বলে সম্বোধন করায় রাগান্বিত হয়ে মা ডাকতে বললেন এক সেবা গ্রহীতাকে। এছাড়া ইউএনওকে স্যার না বলে আপা সম্বোধন করায় এক ব্যবসায়ীকে লাঠিপেটা করার অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক সদস্যের বিরুদ্ধে, যা গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়।

খুলনায় স্যার না বলায় নির্বাহী কর্মকর্তা এক সাংবাদিকের সাথে অসৌজন্যমূলক ও অশালীন আচরণ করেন। বিষয়টি নিয়ে তখন সাংবাদিক সমাজের মধ্যে ক্ষোভ ও তীব্র নিন্দার ঝড় ওঠে। অর্থাৎ কিছু ঘটনা তুলে ধরলাম মাত্র। কিন্তু সমাজে এ ধরনের বহু ঘটনা ঘটে। কিছু ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় আর অনেক ঘটনা বিভিন্ন কারণে মীমাংসা হয়ে যায় বা ভয়ে কোথাও প্রকাশ পায় না। তবে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

এ নিয়ে বিতর্ক, আলোচনা, সমালোচনা এবং লেখালেখি চলমান। এর মধ্যে এক চিকিৎসককে ম্যাডাম না বলায় চটে লাল তিনি। ঘটনাটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচনা হয়। সরকারি কর্মচারী সমাজের সেবক। তবে তারা কেন এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটিয়ে থাকে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। এরা সবাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। এদের বেতন হয় জনগণের করের টাকায়। অর্থাৎ সরকারি কর্মচারী কর্তৃক জনগণকে উল্টা স্যার বলে সম্মান করা উচিত এবং তাদের সেবা দেওয়া একান্ত প্রয়োজন।

অনেকেই বলেন যারা পড়ান, তাদের সাধারণত স্যার সম্বোধন করা হয়। নিম্ন লেভেলের কর্মচারী সিনিয়র লেভেলের কর্মচারীকেও স্যার বলে থাকে। তাহলেই জেলা প্রশাসক, চিকিৎসক বা শিক্ষককে অন্য কোনো নাগরিকের স্যার বলে সম্বোধন করার প্রয়োজন নেই। স্যার বা ম্যাডাম ডাকা নিয়ে সাধারণ নাগরিক হয়রানি বা নির্যাতন হবে কেন? এর মানে কি? অর্থাৎ তাদের চেয়ারকেও স্যার বলতে হবে কি। কারণ, তাদের হাতে ক্ষমতা বা তারা উচ্চ শ্রেণির চাকরি করে।

স্যার বা ম্যাডাম নিয়ে পুলিঙ্গ বা স্ত্রীলিঙ্গ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। একজন নারী শিক্ষককে অধ্যাপিকা বলে সম্বোধন করলে, তিনি অসম্মান মনে করেন বলে সমাজে অভিযোগ রয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে নারী কর্মকর্তাকে স্যার বলে সম্বোধন করতে করা হয়। স্ত্রীবাচক ম্যাডাম শব্দটির চেয়ে স্যার শব্দটি বেশি সম্মানজনক বলে মনে করছে কেউ কেউ। কারণ, স্যারের স্ত্রীকেও কিন্তু ম্যাডাম বলে সম্বোধন করা হয়।

পেশার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ তফাৎ বা বিভেদ রাখা ঠিক নয়। তাই সব নারী-পুরুষ শিক্ষককে অধ্যাপক বলে ডাকা হয়। অর্থাৎ নারী শিক্ষককে শিক্ষিকা বা অধ্যাপিকা বলা হয় না। আবার কোথাও কোথাও নারী চিকিৎসক স্যার সম্বোধন শোনার চেয়ে ম্যাডাম শুনতে বেশি আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে। তাহলে বাংলা ব্যাকরণে যা শিখেছে তার কি প্রয়োগ হবে না। না কি তা শুধু বই পুস্তকে সীমাবদ্ধ থাকবে। সেটা চিন্তার বিষয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তার মধ্যে স্যার বা ভাই সম্বোধন নিয়ে নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হয়। কোনো কোনো কর্মচারী শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে ইচ্ছা পোষণ করে, যা আমার শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার আলোকে দেখতে পেয়েছি। সরকারের কোনো নির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় ১৯৯০ সালের একটি নির্দেশনায় মৌখিক সম্বোধনের বেলায় পুরুষকে স্যার এবং নারীদের বেলায় ম্যাডাম সম্বোধন করা যাইতে পারে বলে উল্লেখ রয়েছে।

কোথাও স্পষ্ট করে বলা নেই, এটা বাধ্যতামূলক। বর্তমান সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রী বলেছেন, স্যার বা ম্যাডাম সম্বোধন করতে হবে এরকম কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সরকারি কর্মচারী আইন ২০১৮ অনুযায়ী সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সচিব থেকে অফিস সহকারী সবাইকে কর্মচারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তার মানে কর্মকর্তা নামে কোনো শব্দ এই আইনে নেই।

এই আইনে গ্রেড (১-২০) এর কথা বলা আছে, যার অর্থ দাঁড়ায় অফিস পরিচালনায় কে কাকে নির্দেশনা দেবে বা কার নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করবেন এটা বোঝানো হয়েছে। দেশ সেবায় কাজ করার উদ্দেশ্যে সরকারি কর্মচারীদের রাষ্ট্র নিয়োগ দিয়ে থাকে। সুতরাং জনগণকে মন থেকে সম্মান করা উচিত। নাগরিককে সেবা দেওয়ার জন্য ইতিবাচক ধারণা থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বাস্তবে রাষ্ট্রের কর্মচারীকে স্যার বা ম্যাডাম না ডাকায়, অনেক ধরনের বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় সাধারণ নাগরিকের, যা খুবই দুঃখজনক। সম্মান কখনই জোর করে আদায় করে পাওয়া যায় না, সম্মান বা মর্যাদা অর্জন করতে হয়। কিছু ক্যাডারের কর্মচারীরা ক্ষমতার দাপটে অহংকারী হয়ে পড়ছে। রাষ্ট্রের কিছু কর্মচারী ক্ষমতার দাপটে কিছুকে কিছুই মনে করছেন না বলে সমাজে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।

তাই রাষ্ট্রের একই গ্রেডের সব কর্মচারীর সমান সুযোগ-সুবিধা, ক্ষমতা থাকা বাঞ্ছনীয়। শিক্ষকদের যে আমরা সম্মান করি, তা কিন্তু পদ-পদবির জন্য নয়। মন থেকে শিক্ষককে স্যার ডাকার মাধ্যমে সম্মান জানানো বা বিভিন্ন আচরণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয়। যদিও সমাজে এখন অনেক শিক্ষক রয়েছেন, তাদের সম্মান বা শ্রদ্ধা জানাতে মানুষ এগিয়ে আসে না। কারণ, সমাজে প্রকৃত শিক্ষকের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। কিছু শিক্ষক সমাজে এমন অন্যায় বা নেতিবাচক কাজ করে যার জন্য আমি শিক্ষক হিসেবে লজ্জিত।

এখনকার সমাজে ডিসি, ইউএনও বা চিকিৎসককে স্যার না বলায় সাধারণ মানুষ হয়রানি হওয়া, বিচারকের পা ধরে শিক্ষার্থীর অভিভাবককে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা সমাজের অবক্ষয় মাত্র। এসব সংস্কৃতি প্রভুত্বের লক্ষণ। এটা হলো মানসিকতার বিষয়। শিক্ষিত হয়েও যদি মানসিকতার পরিবর্তন না হয়, তাহলে সাধারণ নাগরিক কোথায় যাবে? স্যার বলার বিষয়টি ঔপনিবেশিক। যারা এটা শুরু করে গিয়েছিল তাদের দেশে কিন্তু স্যার বলার সংস্কৃতি নেই।

বাইরের দেশে স্যার বা ম্যাডাম সম্বোধন না করার প্রবণতা নেই, তা ঠিক। কিছু সরকারি কর্মচারী নর্থ আমেরিকা এবং ইউরোপীয় দেশের উদাহরণ দিয়ে তারা বলতে চাইছে যে শিক্ষকদেরও স্যার না বলে প্রফেসর বা নাম ধরে সম্বোধন করা উচিত। তবে মজার বিষয় হচ্ছে ওইসব দেশে পাবলিক সার্ভিসে চাকরিজীবীদের সেবাগ্রহণকারী কীভাবে সম্বোধন করে বা সরকারি কর্মচারীরা জনগণকে কীভাবে সম্বোধন করে সেই কথা কিন্তু তারা বলছে না। এখানে রয়েছে গলদ। এই গলদ সমাধান করলেই সমাজের মঙ্গল হবে।

বিশ্বের অনেক দেশে নাম বা পদবি ধরে সম্বোধন করা হয়। তবে আমাদের দেশে কর্মচারীরা প্রভুত্বের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি এখনও। তাই প্রভুত্বের অবসানে সরকারি নির্দেশনা হওয়া জরুরি। অন্যথায় ভবিষ্যতে আরও খারাপ অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। এই অবস্থা থেকে বের হওয়া সময়ের দাবি। দেশের জনগণের জন্য যাতে সব কর্মচারী সেবক হিসেবে কাজ করে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ,জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম

বিশ্বের অনেক দেশে নাম বা পদবি ধরে সম্বোধন করা হয়। তবে আমাদের দেশে কর্মচারীরা প্রভুত্বের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি এখনও। তাই প্রভুত্বের অবসানে সরকারি নির্দেশনা হওয়া জরুরি। অন্যথায়, ভবিষ্যতে আরও খারাপ অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। এ অবস্থা থেকে বের হওয়া সময়ের দাবি। দেশের জনগণের জন্য যাতে সব কর্মচারী সেবক হিসেবে কাজ করে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।