ঈদ আনন্দে ভেসে যাক সকল বিভক্তি
একেকটা উৎসব আসে আর আমরা তর্কে বিতর্কে দ্বিধা আর বিভক্তিতে আসক্ত হয়ে যাই। এই কয়বছর আগেও কিন্তু এমন বিতর্ক আসতোনা। ধর্ম আর উৎসবকে গুলিয়ে দিয়ে আনন্দের পরিবেশটাই নষ্ট করে দেয় কিছু উদ্দেশ্যবাচক লোকজন।
এইতো কয়দিন আগে বৈশাখ গেলো। কোনো রকম গ্রাউন্ড ছাড়াই একজন নোটিশ জারি করলো মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হারাম। ঈদ আসে কিছু লোক ফিল্ডে নামে এর সর্বজনীন চরিত্রকে কালিমালিপ্ত করতে। “বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ” কথাটি কিন্তু এমনি এমনি সৃষ্টি হয়নি।
আমরা উৎসবপ্রিয় জাতি। অভাব অনটনের মাঝেও আমরা আতিথেয়তায় কার্পণ্য করিনা। নিজে খেতে না পারলেও ঘরে অতিথি এলে ঘরের ডিমটা ভেজে খেতে দিতেই অভ্যস্ত বাঙালি। বিশ্বাস করি অতিথির মাঝে সৃষ্টিকর্তা বাস করে। অতিথিকে খাওয়ালে গৃহস্থের কমতি হয় না বরং বরকত হয়। এসব বিশ্বাসকে আঘাত করছে তবে কারা?
আমরা ছোটবেলা থেকেই শিখে এসেছি ধর্ম যার যার উৎসব সবার। এই কথাটির যে বৃহত্তর মর্ম বা অন্তর্নিহিত অর্থ সেটি বুঝার চেষ্টা করছি না আমরা কেউ। এই যে আমাদের হা হুতাশ যে সামাজিক সম্পর্কগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তরুণ প্রজন্ম বিপথে চলে যাচ্ছে, পারিবারিক বন্ধন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বা মানবিক বৃত্তিগুলোর বিকাশ আটকে যাচ্ছে এর পিছনের কারণগুলো কি কোনোদিন সবাই মিলে আমরা চিন্তা করেছি?
একটা উৎসব মানে কেবল একটি পরিবার বা কিছু আবদ্ধ মানুষের বিষয় নয়। এটি একটি সামাজিক বন্ধনেরও বিষয়। উৎসবের উপলক্ষে আমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হই, মিলিত হই, একসাথে খাওয়া দাওয়া শেয়ার করি। এর মাধ্যমে একে অপরের প্রতি সামাজিক হতে শিখি। আমাদের মধ্যে ভাতৃত্ববোধের উন্মেষ ঘটে। অন্যের কষ্টকে ভাগ করে নিতে শিখি।
শহুরে সমাজে আমরা ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে বিভক্তির জীবন কাটাই। পাশের ফ্ল্যাটের কেউ মারা গেলেও আমরা জানতে পারিনা কারণ কোনো স্বাভাবিক সৌহার্দের সম্পর্কটাও থাকেনা আমাদের মধ্যে। এমনকি পাশের ফ্ল্যাটে কারা থাকে অনেক সময় সেটাও জানিনা আমরা। এতোটাই বিচ্ছিন্নতার জীবন সবার।
আত্মীয় স্বজনের মধ্যে যোগাযোগ কমতে কমতে নাই হয়ে যাচ্ছে। কেউ মারা যাওয়া ছাড়া আজকাল আর দেখা হওয়ারও সুযোগ নেই। বিয়ে সাদির উৎসবে সবাই কেবল হাজিরাটুকু দেয় আর কিছু সেলফি তুলে মেমোরি রাখা ছাড়া কোন স্মৃতি থাকে না।
অথচ একটা সময় সবাই সবার বাসায় আসা যাওয়া করতো। ভালোমন্দ রান্না হলেও দেয়া নেয়া ছিল। শবে বরাতের সময়তো বাসায় বাসায় হালুয়া, রুটি বা রান্না করা খাবার দেয়াটাই রীতি ছিল। আমরা উৎসুক থাকতাম কে কত বাসায় যেতে পারছি। এই দেয়ানেয়ার মাধ্যমে যেটা হতো সেটা ছিলো আত্মার সম্পর্ক গড়ে উঠার মত।
চেনাজানা হতো, সুখ দুঃখের খোঁজ খবর নিতাম। একে অপরের বিপদে দৌড়ে যেতো। অথচ আজকাল কারও বাসায় আগুন লাগলেও ভিডিও করতে যাওয়ার লোকের অভাব না হলেও সাহায্য করার লোক যেন স্বপ্নে পাওয়া জিলাপির মতই দুর্লভ। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে গেলে বলতেই হয় যে আগে সকল উৎসবে আমরা পরিবারের সবাই একসাথে হতাম। হৈ হুল্লোড় করে নিজেদের মধ্যে হৃদ্যতাকে ঝালাই করার সুযোগ পেতাম। এমনকি বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করলেও পরিবারের সবাই এক হতাম উৎসবের দিনেই। কিন্তু সে দিনগুলো যেন আজ অতীত। ভাই বোনের দেখা হয় না কতদিন হয়ে যায়। কারও কোনো বিকার নেই। আমাদের সন্তানেরা তাদের পূর্ব পুরুষ বা নিকট আত্মীয়দের সাথেও পরিচিত হবার সুযোগ পাচ্ছে না। ভিডিও কলেই যেন সব সেরে ফেলছি আমরা।
এই যে আত্মীয়হীনতা, সম্পর্কগুলোর মাঝে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে এর পিছনের কারণ কিন্তু আমরা উৎসবকে ভুলে যাচ্ছি। আমরা আনন্দ করতে ভুলে যাচ্ছি। উৎসবকে উৎসবের সংজ্ঞায় রাখতে পারছি না আমরা। বিতর্কের ইস্যু টেনে এর রঙ মলিন করে দিচ্ছি। সবাই যেন এক অদ্ভুত সংকটের মাঝে পড়ে যাচ্ছি। কোনটা পালন করা উচিত আর কোনটা উচিত না এই দ্বিধায় পড়ে হারিয়ে ফেলছি আমাদের স্বাভাবিক মানবিক সম্পর্কের ধরনকে।
এটা খারাপ হচ্ছে। খুব অনিষ্ট হয়ে যাচ্ছে আমাদের। বাঙালির এই চির উৎসবের চরিত্রকে যদি আমরা হারিয়ে যেতে দেই তাহলে একদিন হয়তো আমাদেরকেও পশ্চিমা বিশ্বের মত আবারও যৌথ পরিবারের জন্য কাঁদতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে কিন্তু এতোটাই বিচ্ছিন্ন হওয়া উচিত না যা করতে গিয়ে মানুষে মানুষে সম্পর্কগুলো নষ্ট হয়ে যায়।
পশ্চিমা বিশ্বে সবাই চলে মেশিনের মত। ঘড়ি ধরা সম্পর্কের মধ্যে কেউ কাউকে চিনেনা। কিছু মেকি উৎসবে মেতে উঠে তারা। ফলাফল তাদের মধ্যে পারিবারিক বন্ধন নাই, সামাজিক বন্ধন নাই। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে হতাশা বেড়ে উঠে। আমরা কি সেই দিনের অপেক্ষায় থাকবো?
তাই এখনও সময় আছে, আমাদেরকে মানবিক হতে হবে। উৎসবের রূপ রসকে হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না। ধর্ম আগেও ছিল, এখনও আছে সামনের দিনেও হয়তো থাকবেই তার মত করে। ধর্মের আড়ালে উৎসব বা আনন্দকে আটকে দেয়াকে বন্ধ করতে হবে।
ঈদ আমাদের ধর্মীয় উৎসব। মনে রাখতে হবে এটা উৎসব। আর উৎসবের নিজস্ব কিছু আয়োজন থাকে যেখানে কোনো ভেদাভেদ থাকে না। তাই আসুন সবাই মিলে সকল বিভক্তি ভুলে ঈদ উৎসবে মেতে উঠি আত্মার খোরাকের সন্ধানে।
লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, কলামিস্ট।
এইচআর/এমএস