এই শহরকে মৃত্যুকূপ বানিয়েছি আমরাই
৪ এপ্রিল মঙ্গলবার দেশে মানুষের ঘুম ভেঙেছিল বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের আগুনের খবরে। ভয়াবহ সেই আগুনে পুড়ে গিয়েছিল বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চারটি মার্কেটের অন্তত ৫ হাজার দোকান। আগুনে শুধু মার্কেট পুড়েনি, পুড়ে গেছে লাখো মানুষের স্বপ্ন, বিবর্ণ হয়েছে কয়েক হাজার পরিবারের ঈদের আনন্দ।
সেই ক্ষত শুকানোর আগেই শনিবার আবার দেশের মানুষের ঘুম ভাঙালো আগুন। এবার পুড়লো রাজধানীর নিউ সুপার মার্কেটের অন্তত ২৫০ ব্যবসায়ীর স্বপ্ন। মাঝে বৃহস্পতিবার রাতে পুড়ে গেছে নবাবপুরের একটি গোডাউন। ঈদ সামনে রেখে একের পর এক মার্কেট আর গোডাউনের আগুন অসহায় করে তুলেছে ব্যবসায়ীদের। যত সাহায্যই আসুক, ঈদের আগে এই ব্যবসায়ীদের ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন।
আগুন লাগতেই পারে। তবে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স এবং নিউ সুপার মার্কেটের আগুনের টাইমিং সৃষ্টি করেছে নানা সন্দেহের। বঙ্গবাজারে আগুন লেগেছিল ভোর ৬টা ১০ মিনিটে আর নিউ সুপার মার্কেটে আগুন লেগেছে ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে। প্রথমে দুর্ঘটনা ভাবা হলেও টাইমিংয়ের কারণে অনেকে নাশকতার সন্দেহ করছেন। প্রধানমন্ত্রী নিজেও নাশকতা কি না তা খতিয়ে দেখতে বলেছেন।
শনিবার গণভবনে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, অগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটিয়ে বিএনপি-জামায়াত ভিন্ন পথ বেছে নিচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা উচিত। তাদের অগ্নিসন্ত্রাস অন্য কোনো উপায়ে আছে কি না বা তারা বিভিন্ন উপায়ে তা ঘটিয়েছে কি না, সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনার পর অগ্নিকাণ্ডের প্রতিটি ঘটনা খতিয়ে দেখার ঘোষণা দিয়েছে পুলিশ ও র্যাব। তবে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের অগ্নিকাণ্ডের প্রাথমিক তদন্তে সিগারেট বা কয়েল থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে দাবি করা হয়েছে। তবে সিগারেট বা কয়েল থেকে হলেও তা নাশকতা হতে পারে।
নিউ সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ীরা অবশ্য আগুনের জন্য ভোর রাতে সিটি করপোরেশনের মার্কেট সংলগ্ন ফুটওভার ব্রিজ ভাঙাকে দায়ী করেছেন। তাদের ধারণা সেই ব্রিজ ভাঙার সময় কোনোভাবে বৈদ্যুতিক সংযোগ থেকে আগুন লাগতে পারে। আবার বঙ্গবাজারের আগুনের পর অনেকেই এ আগুনকে মার্কেট খালি করার কৌশল হিসেবেও সন্দেহ করছেন। যদি দুর্ঘটনা হয়, তাহলে তো কিছু করার নেই। কিন্তু যদি সত্যি সতি নাশকতা হয়, তাহলে মানতেই হবে তাদের টাইমিংটা নিষ্ঠুর ও অমানবিক।
ঈদের আগে আগে ব্যবসায়ীদের পথের ফকির বানিয়ে দেওয়াটা খুবই অমানবিক। ঈদের পরেও আগুন লাগানোটা অমানবিকই হবে, তবে ঈদের আগের আগুন অমানবিকতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। যদি সত্যি সত্যিই নাশকতা হয়, দাবি করছি, সুষ্ঠু তদন্ত শেষে যেন দায়ীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। মানুষের জীবন আর সম্পদ নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার কারও নেই।
অমানবিকতার পাশে এ দুটি অগ্নিকাণ্ডে আমরা মানবিকতার উদাহরণও দেখেছি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আগুন নেভানোর কাজ করেছেন। অনেকে আহত হয়েছেন। সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র্যাব, আনসারসহ সরকারের সব বাহিনী আগুন নেভানোর কাজে সত্যি সত্যি যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।
রেকর্ড গরমে নিউ সুপার মার্কেটের ভেতর থেকে পুলিশ সদস্যরা যেভাবে মাথায় করে মালামাল বের করে এনেছেন, সেই ছবি আমাদের আপ্লুত করে। পুলিশের হাজারটা অনিয়মের বিরুদ্ধে এমন একটা ছবি গোটা বাহিনীর ভাবমূর্তি অনেক উঁচুতে নিয়ে যাবে। দেশের সাধারণ মানুষও বঙ্গবাজারের আগুনে নিঃস্ব ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এমনকি আমরা যাদের সমাজেই ঠাঁই দেই না, সেই হিজড়া সম্প্রদায়ও বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের ২০ লাখ টাকা দিয়েছে। এভাবেই যুগে যুগে মানবতার জয় হয়।
তবে যতই নাশকতা আর দুর্ঘটনার গল্প বলি না কেন, এ বিপর্যয়ের দুয়ার কিন্তু আমরাই খুলে রেখেছি। বঙ্গবাজার পুড়েছে, নিউ সুপার মার্কেট পুড়েছে। এ দুটিই কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের তালিকায় অতি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। নিউ সুপার মার্কেটকে ২০১৯ সালেই ফায়ার সার্ভিস অতি ঝুঁকিপূর্ণের তালিকায় রেখেছে। ঢাকায় এমন আর অন্তত ২০টি মার্কেট অতি ঝুঁকিপূর্ণের তালিকায় আছে, তালিকায় আছে ১৩ হাজার দোকান।
ফায়ার সার্ভিস বারবার তাদের নোটিশ দেয়। কিন্তু সেই নোটিশে কান দেওয়ার সময় নেই কারও। ঝুঁকি জেনেই ব্যবসায়ীরা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরাও ঝুঁকি জেনেই এসব মার্কেটে যাই। দুদিন আগে ফায়ার সার্ভিসের একটি দল গুলিস্তান পাতাল শপিংমল পরিদর্শন করে ঝুঁকির কথা বলেছেন। আল্লাহ না করুক, গুলিস্তান পাতাল মার্কেটে আগুন লাগলে কী ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে, একবার ভাবা যায়।
কদিন আগে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকা এবং সিদ্দিকবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল। তখন অভিযোগের আঙুল ছিল তিতাস গ্যাসের অনিরাপদ লাইনের দিকে। আমি নিশ্চিত, এখনও ঢাকায় অতি ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট যেমন আছে, আছে তিতাসের হাজারো অনিরাপদ লাইন। দুর্ঘটনা ঘটলেই আমরা বিষয়গুলো নিয়ে হইচই করি বটে, কিন্তু দুদিন পরে ভুলে যাই। তারপর বসবাস করি এই ঝুঁকিপূর্ণ শহরে, যাকে আমরাই মৃত্যুকূপ বানিয়ে ফেলেছি।
আমরা জানি যেকোনো দিন আগুন লাগতে পারে, বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। তাও আমরা নির্বিকার। কারণ এতগুলো মানুষের পুনর্বাসনের কোনো তাৎক্ষণিক উপায় জানি না আমরা। কিন্তু উপায় একটা না একটা বের করতেই হবে। এই শহর নিরাপদ করে গড়ে তোলা, নিরাপদ রাখা আমাদের সবার দায়িত্ব। মানুষ বাঁচলে শহরও টিকবে।
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম