প্রকৃতি

এই বসন্তে তিব্বতে যা না দেখলেই নয়

আলিমুল হক
আলিমুল হক আলিমুল হক
প্রকাশিত: ১০:০২ এএম, ১৩ এপ্রিল ২০২৩

ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ে পড়েছি, তিব্বত হচ্ছে ‘পৃথিবীর ছাদ’। প্রায় ২৫ লাখ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিশাল এই মালভূমির গড় উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৪ হাজার ফুট। আর পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টও তিব্বতেই অবস্থিত, যার উচ্চতা ২৯ হাজার ফুটের বেশি।

সাম্প্রতিককালে চীনের স্বায়ত্তশাসিত এই বিশেষ অঞ্চলটিতে পর্যটন খাতের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। তিব্বতের জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ৫০ শতাংশের বেশি। তিব্বতের জলবায়ু বছরের ৯ মাসই মারাত্মক রকমের শুষ্ক থাকে। এখানকার বেশি উঁচু জায়গাগুলোতে অক্সিজেনের স্বল্পতা আছে। বাইরে থেকে যারা এখানে বেড়াতে আসেন, তাদের কেউ কেউ শুরুর দিকে তাই সমস্যায়ও পড়েন। কিন্তু তাই বলে তিব্বতে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ছে বৈ কমছে না। তিব্বতের বিশুদ্ধ বাতাস, ঝকঝকে নীল আকাশ ও অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের সেখানে টেনে নিয়ে যায়।

পিচ ফুলের উপত্যকা

তিব্বতে দেখার মতো আছে অনেক কিছু। আমি এখানে কয়েকটি জায়গার কথা সংক্ষেপে উল্লেখ করব। আপনারা যারা তিব্বতে বেড়াতে যাবেন, তারা এসব জায়গায় যেতে ভুলবেন না। কারণ, এসব জায়গায় না গেলে আপনার তিব্বত ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

পিচ ফুলের উপত্যকা
নিংচিকে (Nyingchi) বলা হয় ‘পিচ ফুলের উপত্যকা’। বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর পিচ ফুল ফোটে এখানে। প্রতি বছর এখানে ‘পিচ ফুল উৎসব’ অনুষ্ঠিত হয়। নিংচি’র পিচ ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করার সবচেয়ে ভালো সময় প্রতি বছরের ২০ মার্চ থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত।

নিংচি-র বোমি (Bomi) কাউন্টিতে পিচ ফুল ফোটে টানা ৩০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। এখানে সর্বত্র দেখা যাবে পিচ ফুলের গোলাপি পাপড়ি—রাস্তাঘাট, আবাসিক এলাকা, খামার, নদীর তীর, সর্বত্র। পিচ ফুল ফোটে আবহাওয়া ও জায়গার উচ্চতার ওপর নির্ভর করে। তাই পর্যটকরা এপ্রিলজুড়েই এখানে পিচ ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন।

বিশ্বের গভীরতম গিরিসংকট

বিশ্বের গভীরতম গিরিসংকট
বিশ্বের গভীরতম গিরিসংকট বা খাদ দেখতে হলে আপনাকে আসতে হবে তিব্বতে। এখানকার ইয়ারলুং জাংবো রিভার গ্রান্ড ক্যানিয়ন (Yarlung Zangbo River Grand Canyon) বিশ্বের গভীরতম গিরিসংকট হিসেবে পরিচিত। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৫০০ কিলোমিটার। গভীরতা জায়গাভেদে সর্বনিম্ন ৫৫০ মিটার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৭৭৮২ মিটার পর্যন্ত। এখানে এলে আপনি পিচ ফুলের সৌন্দর্য ও তুষারাবৃত পর্বতশৃঙ্গের সৌন্দর্য একসঙ্গে উপভোগ করতে পারবেন। এ এলাকায় প্রতি বছর ‘পিচ ফুলের মেলা’ও অনুষ্ঠিত হয়, যা অনেক পর্যটককে আকর্ষণ করে।

পাখি-পর্যবেক্ষকদের স্বর্গ
পানকুং হ্রদের (Bangong Lake) বেশিরভাগই পড়েছে তিব্বতে। পাঁচটি উপ-হ্রদের সমন্বয়ে এটি গঠিত। প্রতিটি উপ-হ্রদ তুলনামূলকভাবে সরু পানিপথের মাধ্যমে একে অপরের সাথে সংযুক্ত। গোটা হ্রদের মোট আয়তন প্রায় ৭০০ বর্গকিলোমিটার। হ্রদটি সর্বোচ্চ ৫ কিলোমিটার চওড়া। পানকুং হ্রদ জাতীয় বনপার্ক (Bangong Lake National Forest Park) এই হ্রদেরই একটি দ্বীপ। অনেকে একে ‘পাখি-পর্যবেক্ষকদের স্বর্গ’ বলে ডাকেন।

পাখি-পর্যবেক্ষকদের স্বর্গ

চীনের ‘জাতীয় মহাসড়ক ২১৯’ হ্রদের পূর্ব দিকে অবস্থিত। রুটগ (Rutog) শহর থেকে এই মহাসড়কে ১২ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে আপনি পৌঁছাতে পারেন পানকুং হ্রদে। সেখানে ভাড়ায় নৌকা পাওয়া যায়, হ্রদে ভ্রমণে জন্য। নৌকায় বসেই আপনি পার্কের বিভিন্ন প্রজাতির পাখির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। বসন্তে এসব পাখি এখানে আসে মূলত ডিম দেওয়ার জন্য।

রাক্ষসতল হ্রদ
নামছো হ্রদকে (Lake Namtso) চীনা ভাষায় ডাকা হয় নামুছুও। নোনা পানির নামুছুও তিব্বতের বৃহত্তম হ্রদ। এটি মানস সরোবরের পশ্চিমে ও কৈলাস পর্বতের দক্ষিণে অবস্থিত। এই হ্রদে আছে পাঁচটি নির্জন দ্বীপ। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, রামায়নে বর্ণিত লংকাধিপতি রাক্ষসরাজ রাবণ, তপস্যাবলে, এই হ্রদ সৃষ্টি করেছিলেন। তাই এর আরেকটি নাম ‘রাক্ষসতল হ্রদ’। বিজ্ঞানীরা অবশ্য বলেন, হিমালয়ান টেকটনিক প্লেটের নড়াচড়ার কারণে এই হ্রদের জন্ম। যাই হোক, নামুছুও হ্রদ এলাকায় মার্চ ও এপ্রিলে অসাধারণ সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যের অবতারণা হয়। এসময় এখানে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ে।

রাক্ষসতল সরোবর

মানস সরোবর
মানাসারোভা হ্রদকে (Lake Manasarova) চীনা ভাষায় ডাকা হয় মা ফাং ইয়ং ছুও। এশীয় সংস্কৃতিতে এই হ্রদ পরিচিত ‘মানস সরোবর’ নামে। মানস সরোবর মানে ‘মনের দীঘি’। বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে এই হ্রদ অত্যন্ত পবিত্র হিসেবে গণ্য। বৌদ্ধ ধর্মানুসারে, ত্রিপিটকে বর্ণিত ‘অনবতপ্ত হ্রদ’ই মানস সরোবর। কথিত আছে, এই মহাপবিত্র হ্রদের কাছেই মায়াদেবী শাক্যমুনি বুদ্ধকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন।

তিব্বতের রাজধানী লাসা থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে, নারি (Ngari) অঞ্চলের পুরাং (Purang) কাউন্টিতে, এই হ্রদের অবস্থান। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে চার হাজার মিটার উঁচুতে অবস্থিত মিঠা পানির হ্রদ। এর পৃষ্ঠতলের আয়তন ৩২০ বর্গকিলোমিটার এবং এর গড় গভীরতা ৩০০ ফুট।

মানস সরোবর

মানস সরোবরের উত্তরে কৈলাস পর্বত। সংস্কৃতে কেলাস (Crystal) থেকে ‘কৈলাস’ শব্দটির উৎপত্তি। কারণ, তুষারাবৃত কৈলাসকে দেখতে স্ফটিকের মতো লাগে। তিব্বতি ভাষায় এই পর্বতের নাম ‘গাঙ্গো রিনপোচে’ (Gang Rinpoche)। তিব্বতে বৌদ্ধগুরু ‘পদ্মসম্ভবা’-কে ডাকা হয় ‘রিনপোচে’, যার অর্থ ‘বরফের তৈরি দামি রত্ন’।

তিব্বতে প্রচলিত প্রাচীন কিংবদন্তি অনুসারে, গুরু মিলারেপাই কেবল পা রাখতে পেরেছিলেন কৈলাসের শৃঙ্গে। সেখান থেকে ফিরে তিনি ভক্তদের নিষেধ করেছিলেন পর্বতের চূড়ায় উঠতে। কারণ, একমাত্র সেই মানুষই পারবে এর শীর্ষে যেতে‚ যার গায়ে কোনো চামড়া নেই।

এদিকে, হিন্দু ধর্মীয় পুরাণে কৈলাস পর্বতকে শিবের ‘লীলাধাম’ বলা হয়েছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, শিব, দুর্গা, কার্তিক, গণেশ ও শিবের অনুসারীরা কৈলাসে বসবাস করেন। জৈন ও বন ধর্মের মানুষও একে তীর্থস্থান গণ্য করে। মানস সরোবর ও কৈলাস পর্বতকে একসঙ্গে ডাকা হয় ‘পবিত্র হ্রদ ও পূত পর্বত’ নামে।

মানস সরোবর শুধু পুণ্যার্থীদেরই আকর্ষণ করে না, সাধারণ পর্যটকদেরও টেনে আনে এর অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিকে। এই হ্রদ-এলাকায় চার শতাধিক বিরল প্রজাতির প্রাণীর বাস। এসব প্রজাতির মধ্যে আছে কালো-গলা সারস ও তিব্বতের বন্য গাধা।

তিব্বতের 'মিনি সুইজারল্যান্ড'

মিনি সুইজারল্যান্ড
লুলাং সিনিক জোন (Lulang Scenic Zone) তিব্বতের নিংচি (Nyingchi) এলাকার লুলাং শহরে অবস্থিত। ৮ লাখ ৫৯ হাজার বর্গমিটার আয়তনের এই জোনে একাধিক কৃত্রিম হ্রদ আছে। এখানে আরও আছে সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক দৃশ্য। আর এর ব্যাকগ্রাউন্ডে আছে তুষারাবৃত শুভ্র পর্বতমালা।

নিংচি এলাকায় অবস্থিত লুলাং বনকে, এর মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে, ‘মিনি সুইজারল্যান্ড’ বলে ডাকা হয়। প্রতি বছর এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে জুনের শুরু পর্যন্ত, এখানকার তৃণভূমিতে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি দেখা যায়; দেখা যায় নানান ধরনের বন্য ফুল। সবমিলিয়ে এক অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্য! তিব্বতি ভাষায় ‘লুলাং’ মানে ‘দেবতাদের বাসস্থান’। দেবতাদের দেখা না গেলেও, বসন্তে এখানে দেশি-বিদেশি অনেক পর্যটক দেখা যায়।

রান উ হু চীনা ভাষায় ‘হু’ মানে হ্রদ। রানউ হ্রদকে (Ranwu Lake) চীনা ভাষায় বলা হয় ‘রান উ হু’। এটি তিব্বতের ছামডো (Chamdo) এলাকার পাসোই (Baxoi) কাউন্টিতে অবস্থিত। এর আয়তন প্রায় ২৭ বর্গকিলোমিটার এবং এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২ হাজার ৬২০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। হ্রদ এলাকার গড় তাপমাত্রা সাড়ে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

রান উ হু

রান উ হু স্বচ্ছ নীল জলের জন্য বিখ্যাত। হ্রদের ধারে আছে সবুজ তৃণভূমি, বন, সাদা জলচর পাখির আনাগোনা এবং নানান রঙের নুড়ি। বসন্তে হ্রদের নীল জলে গাছপালার প্রতিবিম্ব ফুটে ওঠে; বাতাসে যখন গাছের ডালপালা নড়ে, তখন মনে হয় হ্রদের জলে সেগুলো নৃত্য করছে। সে এক অসাধারণ সুন্দর দৃশ্য!

তিব্বতের ‘ওষুধের রাজ্য’
চীনের ঐতিহ্যবাহী ওষুধের কথা আমরা সবাই কমবেশি জানি, যা সংক্ষেপে টিসিএম (TCM) নামে পরিচিত। কোভিড মহামারি মোকাবিলায় এই ওষুধ কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। শুধু চীনেই নয়, বিশ্বের বহু দেশে বর্তমানে টিসিএম ব্যবহার করা হচ্ছে। চীনের তিব্বত বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলেরও আছে বিশেষ ও রহস্যময় স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী ওষুধ। আর এই বিশেষ তিব্বতি ওষুধের জন্মস্থান হচ্ছে নানই (Nanyi) উপত্যকা।

তিব্বতের মিলিন (Milin) কাউন্টি থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নানই উপত্যকা পর্যটনকেন্দ্র। এই কেন্দ্রের মোট আয়তন ৮২০ হেক্টর। এখানকার চমৎকার প্রতিবেশ একে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর অভয়ারণ্যে পরিণত করেছে। বিভিন্ন ধরনের বৃক্ষ-লতাপাতায়ও এটি সমৃদ্ধ।

তিব্বতের 'ঔষধের রাজ্য'

নানই উপত্যকাকে বলা হয় ‘তিব্বতের ওষুধের রাজ্য’। একে ‘বিশ্বের সর্বোচ্চ সবুজ রহস্যময় অঞ্চল’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। বসন্তে পর্বতঘেরা ও মেঘে আবৃত এই উপত্যকার সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফোটে পিচ ও আজ্যালিয়া ফুল। প্রতি বছরের বসন্তে তাই এখানে ভিড় জমান দেশি-বিদেশি পর্যটকরা। তিব্বতে এলে এখানে একবার ঢুঁ মারতেই হবে।

লেখক: বার্তাসম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি), বেইজিং।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/এএসএম

নানই উপত্যকাকে বলা হয় ‘তিব্বতের ঔষধের রাজ্য’। একে ‘বিশ্বের সর্বোচ্চ সবুজ রহস্যময় অঞ্চল’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। বসন্তে পর্বতঘেরা ও মেঘে আবৃত এই উপত্যকার সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফোটে পিচ ও আজ্যালিয়া ফুল। প্রতি বছরের বসন্তে তাই এখানে ভিড় জমান দেশি-বিদেশি পর্যটকরা। তিব্বতে এলে এখানে একবার ঢুঁ মারতেই হবে

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।